ভারতের সমুদ্রসীমা সম্প্রসারণের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। সরকার প্রাচীন ‘এভারেস্ট এলিপসয়েড’ পদ্ধতি ছেড়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘WGS84’ পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিবর্তনের ফলে ভারতের উপকূলরেখা নতুনভাবে নির্ধারিত হবে, বাড়তে পারে একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল (EEZ) ও আঞ্চলিক জলসীমার পরিসর। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এই আধুনিক ভূ-পরিমাপকরণ পদ্ধতির প্রয়োগ ভারতকে সামুদ্রিক কূটনীতি ও অর্থনীতিতে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে। জলে জমি বাড়ার এই সমুদ্রগাথা আজ শুধু পরিমাপ নয়, এক নতুন ভৌগোলিক সম্ভাবনার দরজা।

📌 স্টোরি হাইলাইটস

  • এভারেস্ট এলিপসয়েড থেকে ভারতের সরে যাওয়ার প্রস্তুতি, আসছে WGS84

  • নতুন পদ্ধতিতে পরিমাপ হলে ভারতের সমুদ্রসীমা কয়েক মিটার থেকে কয়েকশ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে

  • আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিতে ভারতের কূটনৈতিক ও আইনি অবস্থান শক্তিশালী হবে

  • বাংলাদেশের দিকে সমুদ্রসীমার সীমান্তে হবে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন

  • সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৩৩টি স্থানাঙ্ক পুনর্নির্ধারণ হবে

  • ১৯৭০ সালে ভারতের উপকূল ছিল ৭,৫১৬ কিমি, যা ২০২৩-২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১১,০৯৮ কিমিতে

  • গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গে উপকূলরেখা বেড়েছে সর্বাধিক

  • পরিমাপের পদ্ধতিতে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন

  • অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কৌশলগত পরিকল্পনায় পড়বে ব্যাপক প্রভাব

সমুদ্র কখনও স্থির থাকে না—প্রবাহিত হয়, ধুয়ে-মুছে দেয় সীমান্তের রেখাও। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই জলরেখাই স্থির করে দেয় কতখানি জলজ সম্পদের ওপর থাকবে সার্বভৌম অধিকার। আর সেই সীমানা নির্ধারণের পদ্ধতিতেই এবার বড় পরিবর্তনের পথে এগোচ্ছে ভারত। একদিকে উপকূলরেখার বাস্তব সম্প্রসারণ, অন্যদিকে প্রাচীন ও সীমিত ব্যবহৃত পদ্ধতি থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও নির্ভুল একটি জ্যামিতিক পদ্ধতিতে উত্তরণ—এই দুইয়ের যুগপৎ প্রক্রিয়ায় শীঘ্রই বাড়তে চলেছে ভারতের সমুদ্রসীমা।

এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে ‘WGS84’—বা ‘ওয়ার্ল্ড জিওডেটিক সিস্টেম ১৯৮৪’। বর্তমানের ‘এভারেস্ট এলিপসয়েড’ নামক ভূগোলিক পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হলেও, তা আজকের বৈশ্বিক মানদণ্ডে পড়ছে পিছিয়ে। ফলত, ভারতের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক সার্বভৌমত্বর সংজ্ঞায়নে ক্রমশ দেখা দিচ্ছিল অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা।

WGS84 পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা

প্রযুক্তির হাত ধরে যখন বিশ্ব আগাচ্ছে নির্ভুল তথ্য নির্ভরতার দিকে, তখন ভারতের দীর্ঘদিনের ব্যবহার করা ‘এভারেস্ট এলিপসয়েড’ পদ্ধতি আজ পড়ে আছে প্রায় এক কোণায়। সমুদ্রসীমা নির্ধারণে এই পদ্ধতির অচলতা নতুন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্রে আইনি লড়াই কিংবা কূটনৈতিক আলোচনায় যখন অন্য দেশগুলি ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ‘WGS84’, তখন ভারতের পক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরা ছিল একরকম চ্যালেঞ্জ।

এই পটভূমিতে সরকারের পদক্ষেপ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ যখন সমুদ্র অর্থনীতির গুরুত্ব বুঝে তা ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল সাজাচ্ছে, তখন এই মাপজোকের ভিত্তি-রেখাকে নতুন করে নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়ে উঠেছে অবশ্যম্ভাবী।

বেইসলাইনের পরিবর্তন ও সম্ভাব্য পরিণতি

WGS84 পদ্ধতিতে পরিমাপের সময় ভারতের উপকূলরেখা কিছুটা উত্তর-পশ্চিম বা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সরে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সির ক্রীক সংলগ্ন এলাকায় ভারতের উপকূলরেখা প্রায় ৫৭ মিটার উত্তর-পশ্চিমে সরে গেলে সমুদ্রসীমা সেই অনুযায়ী সম্প্রসারিত হবে। এই পরিবর্তন শুধু কাগজে-কলমে নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মাছ ধরার অধিকার, খনিজ সম্পদ আহরণ, বন্দর নির্মাণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার মতো নানা বিষয়ের বাস্তবতা।

প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমার ভারসাম্য

ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে অতীতে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছিল, সেই মামলায় WGS84 ব্যবহৃত হয় এবং সেটি ভারতের পক্ষেও সুরক্ষা তৈরি করে। ফলে, এবার এই একই পদ্ধতিকে গ্রহণ করার মাধ্যমে ভারত নিজেদের আগের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে পারবে। যদিও কিছু সীমান্তে জলসীমা সরবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ঘেঁষা অঞ্চলে, তবু এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভারতকে রাখবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য অবস্থানে।

সরকারি প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি

পরিকল্পনার কথা উঠেছে তো উঠছে সেই অনুযায়ী বাস্তব রূপ দেওয়ার কাজও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বয় করছে একাধিক সংস্থার সঙ্গে। মোট ১৩৩টি ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক পুনর্নির্ধারণ করে তা গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। এই আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে আন্তর্জাতিকভাবে ভারত তার নতুন সমুদ্রসীমার বৈধতা পাবে।

উপকূলরেখার প্রকৃত সম্প্রসারণ

পরিমাপের পদ্ধতিই শুধু পাল্টাচ্ছে না, উপকূলরেখার বাস্তব ছবিটিও অনেক বদলে গিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে ভারতের উপকূলরেখা ছিল ৭,৫১৬ কিমি। কিন্তু ২০২৩-২৪ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, সেই সীমা এখন ১১,০৯৮ কিমি—অর্থাৎ ৪৭.৬% বৃদ্ধি। গুজরাটের উপকূল প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে—১,২১৪ কিমি থেকে ২,৩৪০ কিমি। পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে সর্বাধিক হারে—১৫৭ কিমি থেকে ৭২১ কিমি, যা ৩৫৭% বৃদ্ধি।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভূমিকা

এই বিস্ময়কর পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে জিওস্পেশিয়াল প্রযুক্তি ও উন্নত হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে পদ্ধতি। এখন আর সরল রেখায় উপকূল পরিমাপ হয় না—ধরা হচ্ছে খাঁড়ি, নদীমোহনা, খাল ও অন্যান্য জটিল ভূ-রূপের বিবরণ। জাতীয় সমুদ্র নিরাপত্তা সমন্বয়ক আধুনিক পরিমাপকরণ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও বন্দর বিকাশ

যে কোনও দেশের অর্থনীতি তার সমুদ্রসীমা থেকে যথেষ্ট উপকৃত হতে পারে, যদি তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবস্থাপিত হয়। ভারতেও এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই উপকূলবর্তী রাজ্যগুলি বন্দর উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে রামায়পটনম, কৃষ্ণপটনম এবং কাকিনাড়া গেটওয়ের মতো প্রকল্প চলছে পূর্ণ উদ্যমে। এই বন্দরগুলির মাধ্যমে তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান, বাণিজ্যের পথ খুলবে আন্তর্জাতিক জলে, এবং দেশের অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত হবে।

নিরাপত্তা, কূটনীতি ও কৌশলগত অবস্থান

সমুদ্র সীমার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমা কেবল আইন প্রয়োগেই সাহায্য করে না, এটি প্রতিরোধ করে অনুপ্রবেশ, অবৈধ মাছ ধরা ও জলপথে চোরাচালানের মতো সমস্যাগুলিও। পাশাপাশি, সামুদ্রিক বিরোধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের বক্তব্য আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।

সার্বভৌমত্বর নতুন দিগন্ত

এই পরিমাপকরণ শুধুমাত্র কাগজে একটি সীমানা বড় করা নয়; এটি এক দেশের ভূখণ্ডগত, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অধিকারকে আন্তর্জাতিক পরিসরে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা। ভারত যখন ওয়ার্ল্ড জিওডেটিক সিস্টেম গ্রহণ করে এগিয়ে চলে, তখন সেটি শুধু এক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তা—এই যে, ভারত এখন সমুদ্রপথে বিশ্বমানের সার্বভৌম শক্তি হয়ে ওঠার পথে, এবং সেই পথে তারা প্রস্তুত, নির্ভুল ও আত্মবিশ্বাসী।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply