সোশ্যাল মিডিয়ার একটিমাত্র পোস্ট ঘিরে শুরু হওয়া বিতর্কে এবার নাটকীয় মোড়। শর্মিষ্ঠা পানোলির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরকারী ওয়াজাহাত খান নিজেই এখন আইনের মুখোমুখি। কলকাতা পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক ও সাম্প্রদায়িক পোস্টের অভিযোগে মামলা করেছে। রাশিদি ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা খান এখন পলাতক, খোঁজ করছে দিল্লি ও অসম পুলিশ। দেবী কামাখ্যার বিরুদ্ধে ‘অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য’-এর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে অসমেও মামলা রুজু হয়েছে। একের পর এক অভিযোগ, সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তেজক বার্তা, আর পুলিশের জোরদার তল্লাশি—এই কাহিনিতে কোথায় গিয়ে শেষ হবে বিতর্ক, তা এখনই বলা কঠিন।
ধর্মীয় উত্তেজনা ইস্যুতে নতুন মোড়, শর্মিষ্ঠার বিরুদ্ধে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেই মামলা, খোঁজে দিল্লি ও অসম পুলিশ
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া আইন পড়ুয়া তথা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার শর্মিষ্ঠা পানোলির মামলায় নতুন মোড়। যাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে শর্মিষ্ঠাকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ, সেই ওয়াজাহাত খানের বিরুদ্ধেই এবার ঘৃণাত্মক মন্তব্য এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
কলকাতা পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, গল্ফ গ্রিন থানায় এক সুজিত ঘোষ নামে ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে খানের বিরুদ্ধে এফআইআর নথিভুক্ত হয়েছে। অভিযোগ, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু পোস্ট করেছেন, যা সরাসরি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দিতে পারে।
পুলিশ সূত্রের দাবি, ৩০ বছর বয়সি ওয়াজাহাত খান রাশিদি ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির নব সংস্করণে (BNS) একাধিক ধারায় মামলা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ১৯৬(১)(এ) (বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা প্রচারে উসকানি), ২৯৯ (ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত), ৩৫২ (ইচ্ছাকৃত অপমান যার ফলে শান্তিভঙ্গ হতে পারে), এবং ৩৫৩(১)(সি) (সাধারণ জনগণকে উসকানোর মত বক্তব্য)।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ৩০ মে, যখন শর্মিষ্ঠা পানোলিকে গুরগাঁও থেকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। অভিযোগ ছিল, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু পোস্ট করেছিলেন, যা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে পারে। সেই মামলার মূল অভিযোগকারী ছিলেন ওয়াজাহাত খান। কিন্তু ঠিক এরপর থেকেই একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে খানের বিরুদ্ধেই।
সূত্রের খবর, শুধুমাত্র কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ওয়াজাহাত খানের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দায়ের হয়েছে। গার্ডেনরিচ থানায় দু’টি, মেটিয়াবুরুজ থানায় একটি, আসানসোল দুর্গাপুর কমিশনারেটে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তরফে একটি এবং জেটিয়া থানাতেও একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রত্যেকটি অভিযোগেই বলা হয়েছে, খান তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের মাধ্যমে ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়েছেন এবং জনমানসে বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছেন।
খানের ‘X’ অ্যাকাউন্ট (পূর্বে টুইটার) বর্তমানে ‘লকড’ থাকলেও সূত্রের দাবি, তিনি সেখানে শর্মিষ্ঠা পানোলির গ্রেফতারির পরে একাধিক পোস্টে তা প্রকাশ্যে উদ্যাপন করেছেন এবং উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বর্তমানে খান পলাতক। কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, তিনি শেষবার রবিবার নিজের এলাকায় দেখা গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের পক্ষ থেকেও এখনও পর্যন্ত কোনও নিখোঁজ ডায়েরি দায়ের করা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে দিল্লি ও অসম পুলিশও তাঁর খোঁজে তৎপর হয়েছে।
সূত্রের দাবি, অসম থেকে তিন সদস্যের একটি পুলিশ দল খানের বাড়িতে এসে খোঁজ করেছে। কারণ, সম্প্রতি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জানিয়েছেন, খান দেবী কামাখ্যা সম্পর্কে ‘অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য’ করেছেন এবং এই মন্তব্যে অসমের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে অশান্তি ছড়াতে পারে। তাই অসম পুলিশের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ওয়াজাহাত খানকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানানো হবে বলেও তিনি জানান। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “ওঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি, বাকিটা সময় বলবে।”
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রী রাম স্বাভিমান পরিষদের তরফেও গার্ডেনরিচ থানায় প্রথম অভিযোগ দায়ের করা হয়। সংগঠনের সম্পাদক সুরজ কুমার সিং বলেন, “হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন মন্তব্য করেছেন ওয়াজাহাত খান। তাঁকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।”
অন্যদিকে, শর্মিষ্ঠা পানোলির অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের একক বেঞ্চ খারিজ করে দিয়েছে। বিচারপতি পার্থ সারথি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অভিব্যক্তির স্বাধীনতা মানে এই নয় যে কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে বারবার আঘাত করবে।”
এই ঘটনায় রাজনৈতিক থেকে প্রশাসনিক মহল, সকলেই সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সামান্য উত্তেজক বার্তাও যে কীভাবে ধর্মীয় ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করতে পারে, তা এই ঘটনা ফের প্রমাণ করে দিল। প্রশাসন জানিয়েছে, কোনও ভাবেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বরদাস্ত করা হবে না, এবং যারাই এতে যুক্ত থাকুক না কেন, কড়া আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই ঘটনার জেরে সামাজিক মাধ্যমে ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং উত্তেজক বক্তব্যের পরিণতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হলেও, একের পর এক অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ওয়াজাহাত খানের খোঁজে যখন একাধিক রাজ্যের পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, তখন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমারেখা নিয়েও জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। আইনি প্রক্রিয়া এখন কোন পথে এগোয়, এবং সত্য উদঘাটনের পথে এই বিতর্ক কোথায় দাঁড়িয়ে শেষ হয়, তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে সচেতন সমাজ।