উত্তম মহান্তি – ওড়িয়া চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আজ অস্ত গেলেন। তাঁর প্রয়াণে যেন এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল, যে অধ্যায় ওড়িয়া সিনেমাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে লিভারের অসুখে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসার জন্য প্রথমে ভুবনেশ্বরের এক হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও, অবস্থার অবনতি ঘটলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ৬৬ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন এই কালজয়ী শিল্পী।
সিনেমার এক স্বর্ণযুগের নায়ক: এক বহুমুখী প্রতিভার অসামান্য যাত্রা
উত্তম মহান্তি শুধুমাত্র ওড়িয়া চলচ্চিত্রের এক স্বর্ণযুগের নায়ক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন সর্বগুণ সম্পন্ন শিল্পী, যাঁর প্রতিভা সিনেমার গণ্ডি ছাড়িয়ে নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর অভিনয়শৈলী ছিল বহুমাত্রিক—তিনি যেমন সহজাত রোমান্টিক নায়ক ছিলেন, তেমনই ছিলেন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা। কমেডি থেকে শুরু করে সিরিয়াস ড্রামা, অ্যাকশন থেকে পিরিয়ড ফিল্ম—প্রতিটি চরিত্রকে তিনি প্রাণবন্ত করে তুলতেন।
১৯৭৭ সালে ‘অভিমান’ ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় তাঁর পথচলা শুরু। এরপর ধাপে ধাপে তিনি ওড়িয়া চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হয়ে ওঠেন। ১৯৮০-৯০ এর দশকে তিনি ওড়িয়া সিনেমার একক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ের প্রায় প্রতিটি জনপ্রিয় ছবির মূল নায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর ‘ধারিত্রি দেবী’, ‘পুয়া মোরে রাগীলা’, ‘দুয়ি প্রতিজ্ঞা’, ‘চেলিবেটস’, ‘সনিকা’, ‘ভাগ্যরেখা’ এবং আরও অনেক চলচ্চিত্র দর্শকদের হৃদয়ে আজও অমর হয়ে আছে।
বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে তাঁর পদচিহ্ন
ওড়িয়া সিনেমার বাইরে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রেও তিনি দাপুটে অভিনয় করেছেন। তাঁর বাংলা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘কালসন্ধ্যা’, যেখানে তিনি শক্তিশালী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও, তিনি কাজ করেছেন বহু টলিউড পরিচালকের সঙ্গে। তাঁর অসাধারণ স্ক্রিন প্রেজেন্স এবং সংলাপ বলার দক্ষতা তাঁকে বাংলার দর্শকদের মাঝেও জনপ্রিয় করে তোলে।
হিন্দি চলচ্চিত্র ‘নয়া জহের’-এও তিনি নিজের প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন। যদিও বলিউডে তিনি খুব বেশি কাজ করেননি, তবু তাঁর অভিনীত সিনেমাগুলো সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
টেলিভিশন ও থিয়েটারে অবদান
চলচ্চিত্রে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনের পর উত্তম মহান্তি ওড়িয়া টেলিভিশন জগতেও পা রাখেন। সিনেমার মতোই ছোটপর্দাতেও তিনি নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। তাঁর অভিনীত বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক দর্শকদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে ‘সুর্য প্রভা’, ‘উত্তরণ’ এবং ‘তুফান মেল’ নামক ধারাবাহিকগুলো তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজগুলোর মধ্যে গণ্য হয়।ওড়িয়া টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি যখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করছিল, তখন উত্তম মহান্তির মতো বড় তারকার অংশগ্রহণ সেই ইন্ডাস্ট্রিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। তাঁর সহজাত সংলাপ বলার ক্ষমতা, অভিব্যক্তির গভীরতা, এবং চরিত্রকে প্রাণবন্ত করে তোলার ক্ষমতা তাঁকে ছোট পর্দাতেও সমান জনপ্রিয় করে তোলে।
উত্তম মহান্তির অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল থিয়েটারের মঞ্চ থেকে। সিনেমায় জনপ্রিয় হওয়ার আগেই তিনি ওড়িয়া নাট্যদুনিয়ার এক পরিচিত মুখ ছিলেন। থিয়েটারই তাঁকে অভিনয়ের মূল শিক্ষা দিয়েছিল, যা পরে সিনেমায় তাঁর অসাধারণ পারফরম্যান্সের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।তিনি ওড়িয়ার বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করেছেন এবং বহু সফল মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁর কণ্ঠস্বরের গভীরতা, সংলাপ বলার দক্ষতা, এবং চরিত্রের অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাঁকে একজন শক্তিশালী মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এমনকি সিনেমায় জনপ্রিয়তার পরও তিনি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ওড়িয়া নাট্যজগতের উন্নতির জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
সঙ্গীত জগতে সংযোগ
উত্তম মহান্তির প্রতিভা শুধুমাত্র অভিনয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সুরের জগতের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর টান। যদিও তিনি পেশাদার গায়ক ছিলেন না, তবুও সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম এবং আবেগপূর্ণ। তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল এক বিশেষ আকর্ষণ, যা সংলাপ বলার সময় স্পষ্টভাবে অনুভূত হতো। হয়তো এ কারণেই, তিনি যখন কোনো গানে কণ্ঠ দিতেন, সেটির আবেদন হয়ে উঠত অনন্য।
উত্তম মহান্তি নিজের অভিনীত বেশ কয়েকটি সিনেমায় গান গেয়েছেন, যা দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে গভীরভাবে জায়গা করে নেয়। তাঁর কণ্ঠস্বরের সুরেলা গভীরতা এবং আবেগমিশ্রিত উপস্থাপনা গানগুলোর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলত। ওড়িয়া সিনেমায় অভিনেতারা সচরাচর গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন না, কিন্তু উত্তম মহান্তি ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি গায়ক হিসেবেও নিজের প্রতিভা তুলে ধরেছিলেন।তিনি বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “কাহি দিলা জওয়ানি”, “প্রেমিকা”, “তুমে মোরে জীবনসাথী”, এবং “সুখা দু:খা”। এই গানগুলোর অধিকাংশই রোমান্টিক এবং আবেগপ্রবণ, যা দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিল। তাঁর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই সেই সময়ের সুপারহিট ট্র্যাক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও সমাজসেবা
উত্তম মহান্তি শুধুমাত্র এক দক্ষ অভিনেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী প্রযোজকও। তিনি বিশ্বাস করতেন, ওড়িয়া চলচ্চিত্রকে আরও উন্নত করতে হলে নতুন প্রতিভাদের সুযোগ দিতে হবে। এই কারণেই তিনি নিজেই সিনেমা প্রযোজনায় নামেন এবং নতুন প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তুলে ধরতে কাজ করেন।তিনি ওড়িয়া চলচ্চিত্রের মানোন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন, নতুন ধরনের গল্পকে বড় পর্দায় আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রযোজিত বেশ কিছু সিনেমা বক্স অফিসে দারুণ সাড়া ফেলে এবং সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে। তাঁর পরিচালিত ও প্রযোজিত বেশ কিছু প্রজেক্ট নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
উত্তম মহান্তি কেবলমাত্র বিনোদন জগতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি সমাজসেবাতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বরাবরই বিশ্বাস করতেন, জনপ্রিয়তা মানে শুধুমাত্র খ্যাতি নয়, বরং মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ। তাই তিনি সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
দরিদ্র ও অসহায় শিল্পীদের সাহায্য করতে তিনি একাধিকবার এগিয়ে এসেছেন। তিনি বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে দান করেছেন, দুস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষার প্রসারের জন্যও তিনি কাজ করেছেন। ওড়িশার গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা করেছেন।
তিনি ওড়িশার বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপ ফান্ড গঠনে অবদান রেখেছেন। বহু দরিদ্র ও প্রতিভাবান ছাত্র তাঁর সহায়তায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে।
রাজনীতিতে যোগদানের প্রস্তাব, কিন্তু…
তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ছিল যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একাধিকবার তাঁকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে তিনি সবসময় রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতির চেয়ে বড় সেবা মানুষের মন জয় করা, এবং সেটি তিনি তাঁর অভিনয় দিয়েই করে যেতে চেয়েছিলেন।
তাঁর মতে, *“আমি অভিনয়ের মানুষ, আমার কাজ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া। আমি চাই মানুষ আমাকে আমার সিনেমা, আমার অভিনয়, আর আমার ভালোবাসার জন্য মনে রাখুক। রাজনীতি আমার জন্য নয়।”