মাত্র দুই টাকায় রোগ নিরাময় করে অর্ধশতাব্দী ধরে অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন কান্নুরের ডঃ এ.কে. রাইরু গোপাল। আধুনিক চিকিৎসার কর্পোরেট ছায়ার বাইরে থেকে, বিনা স্বার্থে বিপুল জনতার পাশে দাঁড়ানো এই মানবদরদী চিকিৎসক পরলোকগমন করেছেন ২ আগস্ট ২০২৫, শনিবার। বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ, গরীবের দুধের সংস্থান এবং সর্বোপরি বিনয়ের চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এক অনবদ্য মানবিক জীবনের অবসান হলেও, তাঁর ‘দুই টাকার চিকিৎসা’ আজও জনসাধারণের স্মৃতিতে চিরস্মরণীয়।
🟨 STORY HIGHLIGHTS PRECAP
মাত্র ₹২ নিয়ে অর্ধশতাব্দী ধরে অসংখ্য রোগীকে চিকিৎসা
নিজস্ব গরুর দুধ, খাবার ও ওষুধ বিলি করেছেন দরিদ্র পরিবারে
কোনও পুরস্কার গ্রহণ করেননি, ছিলেন বিলাসিতামুক্ত
রোগীদের মানসিক অবস্থাকেও গুরুত্ব দিতেন
চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন “মানুষের ডাক্তার” হিসেবে
স্বল্প মূল্য, অমূল্য সেবা: ইতিহাসে রয়ে গেলেন ডঃ রাইরু গোপাল
এক সময় মানুষ বলত, চিকিৎসা শুধু ধনীদের জন্য। কিন্তু কান্নুরের এক সাধারণ ঘরের মানুষ সেই ধারণাকে চূর্ণ করেছিলেন মাত্র ₹২ র বিনিময়ে। আজ তাঁর প্রয়াণে যেন স্তব্ধ হয়ে আছে পুরো কান্নুর শহর—অন্তরালে রয়ে গেছে অসংখ্য কণ্ঠ, যাঁদের জীবনে আলোর দিশা দেখিয়েছেন এক মানুষের অবিচল মানবতা।
শুক্রবার (২ আগস্ট, ২০২৫) ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ডঃ এ.কে. রাইরু গোপাল, বয়স হয়েছিল ৮৬। দীর্ঘদিন ধরে বয়সজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। আগামীকাল, রবিবার পায়্যাম্বালামে অনুষ্ঠিত হবে তাঁর শেষযাত্রা।
কতটা ভালোবাসা থাকলে একটা জীবন এমন হয়?
ডঃ গোপাল, যাঁকে সবাই ‘দুই টাকার ডাক্তার’ নামে চিনত, শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক আশ্রয়, এক আশ্বাস। তাঁর কাছে মানুষ শুধু রোগ সারাতে আসেনি, এসেছিল একটু মনোযোগ, একটু শ্রদ্ধা, একটু মানবিক ছোঁয়ার আশায়।
তাঁর চিকিৎসালয়ের দরজা খুলে যেত ভোরবেলা—প্রথমে ভোর ৪টায়, পরে তা সামান্য পিছিয়ে ভোর ৬টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, রোগীর লাইন তবু ফুরোতো না। দিনে দিনে কয়েকশো রোগী, কোনওদিন সংখ্যা ছাড়িয়ে যেত ৩০০-ও।
এক অনন্য পরিবার, এক আদর্শ চেতনা
প্রখ্যাত চিকিৎসক ও দয়ালু সমাজসেবী ডঃ এ.জি. নাম্বিয়ারের বড় ছেলে ছিলেন রাইরু গোপাল। নাম্বিয়ার একদিন তাঁর সন্তানদের বলেছিলেন,
“যদি টাকাই কামাতে চাও, তবে ব্যাঙ্ক ভেঙে ফেলো, চিকিৎসা পেশাকে ব্যবহার কোরো না।”
এই বাণী যে তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল, তা তাঁর কর্মজীবন দেখলেই বোঝা যায়।
তাঁর ভাইয়েরা—ভেনুগোপাল, কৃষ্ণগোপাল ও রাজগোপাল—তাঁর সঙ্গে পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে বড় হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ডঃ পি.ও. শঙ্কুন্তলা এবং ছেলে ডঃ বালাগোপাল প্রাথমিক সময় থেকে পাশে ছিলেন তাঁর। কন্যা বিদ্যা, পুত্রবধূ ডঃ তুষারা, ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও একজোট ছিলেন মানবিক এই পথচলায়।
দৈনন্দিন জীবনের ছকে এক আশ্চর্য সাধনা
ডঃ গোপালের জীবনযাত্রা ছিল যেন এক নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা।
রাত ২.১৫টায় ঘুম ভাঙত তাঁর। এরপর নিজের গোয়ালঘরে গিয়ে গরুদের পরিচর্যা করতেন।
তারপর গোসল, প্রার্থনা ও খবরের কাগজ পড়া।
ভোর ৬টার মধ্যে রোগীরা এসে যেতো।
তাঁর গোয়াল থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে গরীব পরিবারে দুধও পৌঁছে যেত।
তিনি একবারও সরকারি পুরস্কার গ্রহণ করেননি। ২০১৭ সালে Mathrubhumi-এর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“আমি যা করছি, সেটাই আমার পুরস্কার। স্বীকৃতির জন্য করিনি, হৃদয়ের তাগিদেই করছি।”
কম্পানির প্রলোভন থেকে দূরে, মানুষের কাছে নতজানু
আজকের দিনে যখন বড় বড় ওষুধ কোম্পানি ডাক্তারদের উপহার, বিদেশ ভ্রমণ কিংবা মোটা কমিশনের অফার দেয়, তখন ডঃ গোপাল তাঁদের জন্য ছিলেন এক ‘নো-এন্ট্রি’ চিহ্ন।
তিনি সচেতনভাবে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের তার দরজায় আসতে দিতেন না। রোগীদের জন্য সহজলভ্য, সস্তা ও কার্যকর ওষুধই দিতেন।
কোনও ওষুধের রঙিন মোড়ক বা বিলাসবহুল প্রেসক্রিপশন তাঁর চেম্বারে দেখা যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা বিবেক (৫৮), যিনি একাধারে তাঁর রোগী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বলেন—
“ওনার কাছে গেলে শুধু ওষুধ নয়, সাহস পাওয়া যেত। একসময় আমি একটা কঠিন রোগে ভুগছিলাম, তখন একমাত্র উনি বলেছিলেন, ‘চিন্তা কোরো না, আমি আছি।’ সত্যিই, ওনার কথা শুনেই সেরে উঠেছিলাম।”
“তিনি কখনও অতিরিক্ত ওষুধ দিতেন না। ওষুধের প্যাকেট খুলে সেইগুলো একটা ছোট বাক্সে রেখে দিতেন। যেন কেউ আবার নিজে নিজে খেয়ে না নেয়। এটা ছিল রোগীদের সুরক্ষার জন্য।”
আর্থিক অনটনের চিকিৎসক হয়ে উঠেছিলেন তিনি
যখন ডাক্তার দেখাতে গিয়ে মানুষ হাজার হাজার টাকা খরচ করে, তখন ডঃ গোপাল ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর কাছে মানুষ আসত পয়সার জন্য নয়, পরামর্শের জন্য।
কিছু মানুষ তাঁর চেম্বারে শুধু মন হালকা করতে আসত।
কারও মাথা ধরেছে, কারও মনে দুঃখ—একবার তাঁর চেম্বারে ঢুকলেই যেন বুকের ভার হালকা হয়ে যেত।
শেষ সময়েও থেমে যাননি তিনি
শরীর দুর্বল হয়ে আসছিল, হাঁটাচলায় কষ্ট হচ্ছিল।
তবু থেমে যাননি। রোগী দেখার সময় ছিল তাঁর কাছে পবিত্র সময়।
এক সময় হুইলচেয়ারে বসে রোগী দেখেছেন, কখনও চিকিৎসার মাঝখানে বিশ্রাম নিয়েছেন, আবার ফিরে এসে কাজ করেছেন।
শেষ শ্রদ্ধা ও স্মৃতির ঝলক
কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন—
“ডঃ গোপাল ছিলেন সত্যিকারের ‘জনগণের ডাক্তার’। আধুনিক সময়ের বাণিজ্যিক চিকিৎসার পরিবেশে তাঁর মতো মানুষ এক বিরল উদাহরণ। ₹২-তে যে ভরসা পাওয়া যেত, তা কোনও দামে মেলে না।”
মানবতার এক দীপ্ত পথপ্রদর্শক
ডঃ রাইরু গোপালের মৃত্যু কেবল একজন চিকিৎসকের মৃত্যু নয়, এটা এক আদর্শের পরিসমাপ্তি।
একটি যুগের সমাপ্তি, যেখানে একজন ডাক্তার অর্থ নয়, ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সারিয়ে তুলতেন।
কান্নুরের মানুষরা হয়তো এখন আর তাঁর কাছে যেতে পারবে না।
কিন্তু সেই বাড়ি, সেই চেম্বার, সেই কাঠের টেবিল আর সরল মুখের হাসি—চিরদিন থেকে যাবে হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে।
ডঃ এ.কে. রাইরু গোপালের প্রয়াণ কেবল একজন চিকিৎসকের বিদায় নয়, এটি এক মহৎ দর্শনের অবসান। দুই টাকার বিনিময়ে অগণিত মানুষের দুঃখ লাঘব করে তিনি প্রমাণ করে গেছেন—সত্যিকারের চিকিৎসা কেবল প্রেসক্রিপশন বা ওষুধ নয়, তা হতে পারে স্নেহ, শ্রদ্ধা ও নিঃস্বার্থ সেবার মিশেল। কর্পোরেট চিকিৎসার যান্ত্রিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি এক মানবিক ব্যতিক্রম হয়ে থেকে গেলেন। তাঁর জীবন আজও বলে—বিনয়, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা থাকলে, চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারেন একজন সমাজগুরু। কান্নুর হারাল এক আশ্রয়, কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন “দুই টাকার ডাক্তার”।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো