🔥 বাংলার শেষ নবাবের ট্র্যাজেডি: ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র নাকি অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা?

বাংলার শেষ নবাব ইতিহাসে এক রহস্যময় প্রতীক—গৌরব, বিশ্বাসঘাতকতা আর সাম্রাজ্য বিস্তারের নাটকের মাঝে যাঁর জীবন পরিণত হয়েছিল এক করুণ মহাকাব্যে। ক্ষমতার ঝলমলে আবরণ ভেদ করে প্রকাশ পেয়েছিল অন্তর্দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র এবং অদম্য লোভের ছায়া। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা আর ইংরেজ শক্তির উত্থান মিলিয়ে নবাবের পরিণতি যেন এক বিস্মৃত রূপকথার মতো। তিনি নন সম্পূর্ণ খলনায়ক, নন একান্ত নায়ক—বরং বিতর্কিত উত্তরাধিকার নিয়ে বেঁচে আছেন আজও, বাংলার ইতিহাসের এক অমোচনীয় নাম হয়ে।

স্বাধীনতার শেষ প্রহর

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন—পলাশীর যুদ্ধ। ইতিহাসে এ দিনটি এক মর্মান্তিক অধ্যায়, যেখানে শেষ হয়ে গেল বাংলার স্বাধীন নবাবতন্ত্র। মুর্শিদাবাদের তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা—যিনি মাত্র কুড়ি-বছর বয়সে সিংহাসনে বসেছিলেন—অল্প সময়েই হয়ে উঠলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। কেউ তাঁকে দেখেন ব্যর্থ, হঠকারী শাসক হিসেবে; আবার কেউ তাঁকে মনে করেন ষড়যন্ত্রের শিকার, বিশ্বাসঘাতকতার বলি।

শৈশব ও উত্থান

সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ১৭৩৩ সালে। দাদু আলিবর্দি খাঁ ছিলেন বাংলার অন্যতম শক্তিশালী নবাব। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন দাদুর প্রিয়, এবং আলিবর্দি তাঁকে নিজের উত্তরসূরি করার ঘোষণা দেন।
তবে এই উত্তরাধিকারের ঘোষণাই নবাবি দরবারে তৈরি করে অসংখ্য শত্রু। ফুফু ঘসেটি বেগম, সেনাপতি মীর জাফর, মহাজন জগৎ শেঠ—সবার চোখে কাঁটা হয়ে ওঠেন তরুণ সিরাজ।

চরিত্র নিয়ে বিতর্ক: নায়ক নাকি উচ্ছৃঙ্খল?

ব্রিটিশ নথিতে সিরাজকে বর্ণনা করা হয়—“আতঙ্কপ্রদ, উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ, নারীলোলুপ”। এটি উপনিবেশবাদী ইতিহাসে একটি প্রচলিত চিত্র। কিন্তু ফরাসি ব্যবসায়ীদের লেখা বর্ণনা একেবারেই ভিন্ন। তাঁদের মতে, সিরাজ ছিলেন ধার্মিক, মসজিদ-ইমামবারায় দানশীল, আবার যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসী।

বাংলা ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী একবার বলেছিলেন—

“সিরাজের প্রকৃত দুর্বলতা তাঁর চরিত্রে নয়, বরং তাঁর চারপাশের বিশ্বাসঘাতকতায়।”

অর্থাৎ, ইংরেজরা তাঁর চেহারাকে বিকৃত করে দেখিয়েছিল, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁকে কখনও নায়ক ভাবতে না পারে।

অর্থনীতি ও কর ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব

আলিবর্দির আমলে বাংলার অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্য করত, ফলে রাজকোষে রাজস্ব কমতে থাকে। সিরাজ এই অপব্যবহার বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নেন।
তিনি ঘোষণা দেন—“ইংরেজ বা ফরাসি, যে-ই হোক, সবাইকে সমান শুল্ক দিতে হবে।”
এই সাহসী পদক্ষেপেই তিনি ব্রিটিশ স্বার্থে বড় হুমকি হয়ে ওঠেন।

কলকাতা আক্রমণ ও ‘ব্ল্যাক হোল’ বিতর্ক

১৭৫৬ সালে সিরাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেনা পাঠান কলকাতায়। এর কারণ—ইংরেজরা নবাবের অনুমতি ছাড়াই ফোর্ট উইলিয়াম শক্তিশালী করছিল। সিরাজের সৈন্যরা শহর দখল করে নিলে ঘটে তথাকথিত ‘ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডি’।

ব্রিটিশরা দাবি করে—১৪৬ জন ইউরোপীয়কে একটি ছোট্ট ঘরে বন্দি করা হয়েছিল, এবং ১২৩ জন শ্বাসরোধে মারা যায়। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, এই সংখ্যা বিপুলভাবে অতিরঞ্জিত। অনেকের মতে, পুরো ঘটনার উদ্দেশ্য ছিল সিরাজকে “দানব” বানানো, যাতে ইংরেজ আক্রমণকে বৈধতা দেওয়া যায়।

ভারতীয় ঐতিহাসিক সুভাষ চক্রবর্তী বলেছেন—

“ব্ল্যাক হোল কাহিনি আসলে ছিল এক রাজনৈতিক প্রচারণা; যার প্রমাণ আজও প্রশ্নবিদ্ধ।”

দরবারের ষড়যন্ত্র: নারী, স্বর্ণ ও বিদেশি চুক্তি

বাংলার শেষ নবাব সিরাজ উদ্দৌলার জীবন কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, প্রাসাদের অন্তরালেও প্রবল বিতর্কে ঘেরা ছিল। সমকালীন ইংরেজ পর্যটক রবার্ট অর বলেছিলেন, “Siraj was brave in the field but careless in his court.”—এই মন্তব্য অনেকটাই ব্যাখ্যা করে নবাবের ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে।

সিরাজের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিপদ আসে তাঁর নিজের পরিবার ও দরবার থেকে।

• গাসেতি বেগম (তাঁর ফুফু) ইংরেজদের কাছে খবর ফাঁস করতেন।

• জগৎ শেঠ (বাংলার মহাজন) ইংরেজদের বিপুল অর্থসাহায্য দেন।

• মীর জাফর, সেনাপতি হয়েও, যুদ্ধের আগেই ক্লাইভের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেন।

ইতিহাসবিদ ড্যালরিম্পল লিখেছেন—

“পলাশীর যুদ্ধ কামান-বন্দুকের খেলা ছিল না, ছিল অর্থের অঙ্ক। মহাজনরা নবাবকে নয়, ইংরেজদের বেছে নিয়েছিল।”

নবাব সিরাজের ব্যক্তিগত জীবনের অজানা অধ্যায়

ইতিহাসে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সাধারণত এক যোদ্ধা, এক ব্যর্থ শাসক এবং এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হিসেবে চিত্রিত করা হয়। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও কম বিতর্কিত ও রোমাঞ্চকর নয়।

 প্রেম ও বিবাহ

ইতিহাসবিদদের মতে, সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী ছিলেন লুৎফুন্নেসা বেগম। তাঁকে তিনি অগাধ ভালোবাসতেন, এবং নবাবের জীবনের সবচেয়ে বড় আবেগের আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। বহু সমালোচক বলেন, রাজনীতির চাপে থেকেও তিনি স্ত্রীর প্রতি একান্ত অনুরাগী ছিলেন। সিরাজের জীবনে আরও একটি কাহিনি প্রচলিত—তাঁর যুবক বয়সে এক রাজকীয় নর্তকীর প্রতি আকর্ষণ, যা সমসাময়িক দরবারে আলোড়ন তুলেছিল।

 উত্তরসূরি ও পরিবারের ট্র্যাজেডি

সিরাজের পুত্রের নাম ছিল ইকবাল উদ্দৌলা। প্লাসির যুদ্ধে নবাব পতনের পর তাঁর সন্তানের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরা এবং মীর জাফরের গোষ্ঠী নবাব পরিবারকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়। স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং সন্তানদের জীবন বাকি সময়ে রাজনীতির ষড়যন্ত্র ও অপমানের মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল।

 পারিবারিক ট্র্যাজেডির প্রতিধ্বনি

ঐতিহাসিক জদুনাথ সরকার উল্লেখ করেছেন—

“Siraj was not merely a ruler defeated at Plassey; he was a young husband and father whose family bore the silent wounds of betrayal.”

এই ব্যক্তিগত অধ্যায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইতিহাস শুধু যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্র নয়, বরং প্রেম, পরিবার আর অদৃশ্য অশ্রুরও গল্প।

পলাশীর যুদ্ধ: যুদ্ধ নাকি নাটক?

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভোর। সিরাজের সেনা সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার, আর ক্লাইভের ছিল মাত্র ৩ হাজার। সংখ্যার দিক থেকে জয়ের সম্ভাবনা নবাবের পক্ষেই ছিল।
কিন্তু মীর জাফরের সৈন্যরা দাঁড়িয়ে রইল নিষ্ক্রিয়। শুধু মীর মদন ও কিছু সৈন্য সাহসিকতার সঙ্গে লড়লেন। মীর মদনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নবাবের সেনাদল ভেঙে পড়ে।

একজন সমসাময়িক ফরাসি সেনা কর্মকর্তা লিখেছিলেন—

“এ যুদ্ধ আসলে যুদ্ধ ছিল না, ছিল পূর্বপরিকল্পিত বিশ্বাসঘাতকতা।”

সিরাজের পতন ও মৃত্যুর রহস্য

যুদ্ধ হারের পর সিরাজ পালিয়ে যান। কিন্তু মীর জাফরের সৈন্যরা তাঁকে ধরে ফেলে। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, তাঁকে হত্যা করে গঙ্গার তীরে গোপনে কবর দেওয়া হয়।
তবে কিছু ইতিহাসবিদ দাবি করেন—

• তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল মীর জাফরের নির্দেশে, যাতে তিনি সিংহাসনে নিশ্চিন্তে বসতে পারেন।

• অন্যদের মতে, ইংরেজরাও হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।

অর্থাৎ, সিরাজের মৃত্যুও আজও এক অমীমাংসিত রহস্য।

সাহিত্য ও ইতিহাসে সিরাজ

বাংলা সাহিত্য সিরাজকে কখনও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার, কখনও করুণ নায়ক হিসেবে দেখেছে।

• নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ লিখেছিলেন “সিরাজউদ্দৌলা” নাটক, যেখানে নবাবকে নায়ক রূপে চিত্রিত করা হয়।

• কবি কাজী নজরুল ইসলাম সিরাজকে স্মরণ করেছিলেন দেশপ্রেমিকের প্রতীক হিসেবে।

• আবার ব্রিটিশ ঐতিহাসিক গ্রন্থে তিনি আজও “অক্ষম” শাসক হিসেবে উপস্থাপিত।

সমালোচকদের চোখে

• ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ মার্ক বেন্স-জোনস: “তাঁর প্রধান দুর্বলতা ছিল পরিবর্তনশীল মেজাজ ও সাহসের অভাব।”

• ভারতীয় সমালোচক সুশীল চৌধুরী: “সিরাজ একা ব্যর্থ হননি; ব্যর্থ হয়েছে তাঁর চারপাশের সমাজ।”

• উইলিয়াম ড্যালরিম্পল: “কোম্পানি-রাজের জন্ম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট লুটের গল্প।”

 শেষ নবাব, প্রথম শিকার

সিরাজউদ্দৌলার পতন শুধু একজন তরুণ নবাবের ব্যর্থতা নয়। এটি ছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রদীপ নিভে যাওয়ার মুহূর্ত। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার, ব্ল্যাক হোলের বিতর্ক, দরবারি ষড়যন্ত্র, মহাজনদের বিশ্বাসঘাতকতা আর মীর জাফরের পিঠে ছুরি—সব মিলেই তাঁকে ইতিহাসে পরাজিত করল।

আজও প্রশ্ন থেকে যায়—
👉 যদি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা না করতেন, তবে কি ভারতের ইতিহাস অন্য পথে যেত?
👉 যদি নবাবের সেনারা ঐক্যবদ্ধ থাকত, তবে কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এত দ্রুত ভারতের শাসক হতো?

সিরাজ তাই থেকে গেছেন—একদিকে নিন্দিত, অন্যদিকে করুণ-নায়ক। কিন্তু অস্বীকার করা যায় না, তিনি ছিলেন বেঙ্গলের শেষ স্বাধীন নবাব।

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা শুধু একটি পরাজিত যুদ্ধের নাম নন, তিনি এক অসমাপ্ত স্বপ্ন, এক অনির্বচনীয় ট্র্যাজেডি। প্লাসির যুদ্ধ শুধু বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসই পাল্টে দেয়নি, নবাবের ব্যক্তিগত জীবনকেও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, পুত্রের প্রতি মমতা এবং পরিবারের ভয়াবহ পরিণতি তাঁকে মানুষের চোখে আরও বেশি মানবিক করে তোলে। আজও ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম জ্বলজ্বল করে—একদিকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার এক শাসক, অন্যদিকে ভালোবাসা ও পরিবারের প্রতি নিবেদিত এক মানুষ হিসেবে। সিরাজ শুধু অতীতের একটি চরিত্র নন, তিনি বাংলার হৃদয়ে বেঁচে থাকা চিরন্তন এক বেদনা

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো