পর্যটনের নিষেধাজ্ঞায় থমকে সুন্দরবন
বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গোপন নিবাস সুন্দরবনে ২০২৫ সালের ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সম্পূর্ণ পর্যটন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই মৌসুমি নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমবঙ্গ বন দফতরের এক সূক্ষ্ম পরিবেশ-নির্ভর পদক্ষেপ, যার মূল লক্ষ্য সংবেদনশীল প্রজনন ঋতুতে প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ইউনেস্কো স্বীকৃত এই বনাঞ্চলে মাছ ধরা, বনভ্রমণ ও নৌপর্যটন সবকিছুতেই কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান অনুযায়ী প্রকৃতির নিঃশব্দ আহ্বানে সাড়া দেওয়া এই সিদ্ধান্ত এক ভবিষ্যৎমুখী পরিবেশনীতির প্রতিচ্ছবি।
গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে গভীর ব-দ্বীপে অবস্থিত সুন্দরবন—যেখানে রাজসিক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ও বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিরাজমান—সেই অঞ্চল ২০২৫ সালের ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ বর্ষার বন্ধ নয়। পশ্চিমবঙ্গের বন দফতর সম্পূর্ণ মানবিক কার্যকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে—এর মধ্যে রয়েছে পর্যটন, মাছ ধরা, বন পরিদর্শন প্রভৃতি—যার মূল উদ্দেশ্য হল সংবেদনশীল এই বাস্তুতন্ত্রকে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ঋতুতে পুনরুজ্জীবনের সুযোগ দেওয়া।
গত বছরের তুলনায় এবারের এই বার্ষিক বন্ধ এক মাস আগে শুরু হয়েছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়কাল বনের প্রাকৃতিক ছন্দ অনুসরণ করে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে এই ইউনেস্কো স্বীকৃত জীবমণ্ডলের অন্তর্গত জলজ ও স্থলচর প্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া যায়। এই সিদ্ধান্ত ‘ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ (IRMP)-এর অংশ, যার মাধ্যমে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ধনকে সংরক্ষণের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বনাঞ্চলের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন সময়কাল
সুন্দরবন শুধুই একটি অরণ্য নয়, এটি একটি জৈব-ঘড়ির মতো চলমান প্রাকৃতিক ল্যাবরেটরি—যেখানে প্রতিটি ঋতু, প্রতিটি স্রোত আর প্রতিটি নিঃশ্বাস নির্দিষ্ট ছন্দে আবদ্ধ। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়টি সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানিক ছন্দের এক সংবেদনশীল স্তর, যা প্রজননের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত। এই পর্বে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজস্ব প্রস্তুতিতে মগ্ন থাকে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তৃত প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সুন্দরবন এককভাবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।মিষ্টি ও নোনাজলের মিশ্রণে তৈরি ট্রানজিশন জোন হওয়ায় সুন্দরবনে একধরনের বিশেষ বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়েছে, যেখানে জোয়ার-ভাটার প্রভাব সরাসরি প্রাণজগতে পড়ে।এই অঞ্চলে প্রচুর জলাভূমি, খাঁড়ি, নদী ও দ্বীপ রয়েছে, যা প্রজনন-উপযোগী নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
প্রজাতি ও প্রজননের সময়কাল
সুন্দরবন মূলত জুন-আগস্ট সময়ে প্রজনন মৌসুমে প্রবেশ করে, যখন একাধিক প্রজাতি ডিম পাড়ে, বাসা বানায় ও নবজাতক লালনে ব্যস্ত থাকে।
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, সুন্দরবনের প্রতীক হলেও এই ঋতুতে তার চলাফেরা অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়ে।
মোহনাচর কুমির, যারা সাধারণত নির্জনে ডিম পাড়ে, এই সময়ে ঘনভাবে নদীপাড়ে সক্রিয় থাকে।
চিতল হরিণ নিরব নিরাপদ স্থানে নবজাতক জন্ম দেয়, যা মানুষের উপস্থিতিতে বিঘ্নিত হতে পারে।
সুন্দরবন-এর ২৯০টিরও বেশি পাখির প্রজাতি এই সময়ে নিজেদের বাসা গড়ে তোলে গাছের কাণ্ড ও শিকড়ে।
সুন্দরবন-এর ভেতরে ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী, বিশেষত কাঁকড়া, চিংড়ি ও মৎস্যজাত প্রাণী এই মৌসুমেই সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত হয়।
বহু উদ্ভিদ প্রজাতি (৩৪৪টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক) বর্ষার জলে নিজস্ব পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
বিপন্ন ও সংবেদনশীল প্রাণীর তালিকা
সুন্দরবন-এর ২৮৯টি স্থলচর প্রাণীর মধ্যে ২৫টি পাখি, ১৪টি সরীসৃপ, ৫টি স্তন্যপায়ী ও ২টি উভচর প্রাণী সংবেদনশীল বা বিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত।
এই প্রজাতিগুলি সাধারণত খুব নির্দিষ্ট ও সীমিত এলাকায় প্রজনন করে, যা সহজেই বিঘ্নিত হতে পারে।
সুন্দরবন-এর এই প্রজাতিগুলির দীর্ঘমেয়াদী অস্তিত্ব নির্ভর করে এই মৌসুমে নিরব ও নিস্তরঙ্গ পরিবেশের উপর।
বিশেষ কিছু তথ্য
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সাধারণত মাটি খুঁড়ে এক ধরনের গর্তে প্রজননকালীন বিশ্রাম নেয়, যাকে “ডেন” বলা হয়। এই সময় তাদের চলাচল ন্যূনতম হয়।
সুন্দরবন-এর চিংড়ি ও কাঁকড়ার প্রজননচক্রের সময় সমুদ্রের জোয়ারের সাথে সরাসরি যুক্ত। ফলে এই সময়ে নদীপথে শব্দ ও কম্পন মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
বহু পাখি কেবল সুন্দরবনেই প্রজননের জন্য আগমন করে, অর্থাৎ এটি তাদের “ব্রিডিং গ্রাউন্ড”—তাদের অস্তিত্ব এই তিন মাসের নিরবতার সঙ্গে জড়িত।
নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব
সুন্দরবনের অধিকাংশ জলজ ও স্থলচর প্রাণীর প্রজনন ঋতু জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে পড়ে। এই সময়ে মানুষের উপস্থিতি ও কার্যকলাপ প্রাকৃতিক মিলন ও বাসা বাঁধার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে, নবজাতকের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমাতে পারে এবং ম্যানগ্রোভ পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তিন মাসব্যাপী এই নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করে যে বন্যপ্রাণীরা কম বিঘ্নে চলাফেরা ও প্রজনন করতে পারে, ও তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থানে বেড়ে উঠতে পারে।
এই নিষেধাজ্ঞা মৎস্য আহরণ, নৌকা ভ্রমণ, মৌচাক সংগ্রহ ও অন্যান্য বন-নির্ভর জীবিকাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। জলপথে যাতায়াত ও সংবেদনশীল এলাকায় পদচারণা কমিয়ে, এই বন্ধ একটি প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই তিন মাসে সুন্দরবন নিজেকে সজীব করে।পাতা পড়ে নতুন চারা গজায়, কাদা জমে নতুন জলজ গৃহ তৈরি হয়।বন্যপ্রাণীরা চলাফেরা করে সহজভাবে—চিন্তাহীন, শব্দহীন, নিরুদ্বিগ্নভাবে।কোন রকম বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সুন্দরবনের প্রাণজগত নিজস্ব গতিতে সামনের প্রজন্মের প্রস্তুতি নেয়।
সুন্দরবন এই তিন মাসে তেমন কিছু “দেখার” জন্য নয়, বরং “অদেখা” এক প্রস্তুতির গোপন পর্ব, যার ভিতেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের প্রাণের মূল। নিষেধাজ্ঞা তাই শুধু প্রশাসনিক আদেশ নয়, বরং এক গূঢ় অনুপস্থিতির ছাঁদে রচিত প্রকৃতির নিজস্ব পুনরায় আত্মপ্রকাশ।
পর্যটকদের জন্য নির্দেশনা
১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট, ২০২৫ পর্যন্ত সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সব এলাকায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর।
এই সময়কালে সমস্ত পর্যটন ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ।
পর্যটকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বর্ষা শেষে ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে, যখন বন আবার খুলে যাবে।
নির্ভরযোগ্য ও সঠিক তথ্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বন দফতরের অফিসিয়াল আপডেট দেখে নেওয়া উচিত।
এই মৌসুমি বন্ধ পর্যটন ও সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে এবং নিশ্চিত করে যে সুন্দরবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক নিরাপদ বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল হিসেবেই রয়ে যাবে।