একজন প্রকৌশলী, একজন উদ্ভাবক, একজন চিন্তানায়ক—সোনম ওয়াংচুকের নাম শুধু প্রযুক্তি নয়, সামাজিক দায়িত্ববোধের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হিমালয়ের কোলে দাঁড়িয়ে শিক্ষা ও পরিবেশ রক্ষায় তাঁর নিরন্তর প্রয়াস আজ আন্তর্জাতিকভাবেই পরিচিত। এবার সেই মানুষটি এসে হাজির হলেন কলকাতার বুকে, জিআইএস গ্রুপ এডুকেশনাল ইনিশিয়েটিভস আয়োজিত ‘মেড ইন জিআইএস সেলিব এডিশন’-এর প্রধান অতিথি হিসেবে, ধনধান্য অডিটোরিয়ামে। এখানে ‘মাই কলকাতা’র সঙ্গে এক অনবদ্য আলাপচারিতায় উঠে এলো শিক্ষকতাকে ঘিরে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজগঠনে প্রজন্মের ভূমিকা এবং ক্রমবর্ধমান পরিবেশ সংকট নিয়ে তাঁর চিন্তা ও উদ্বেগ।

শিক্ষকেরা যেন পথপ্রদর্শক, কেবল পাঠদানকারী নন

ওয়াংচুক বলেননি, শিক্ষকরা যেন শুধু বই পড়ান—তিনি বলেছেন, “শিক্ষকরা হতে হবে স্রষ্টা, সমস্যা সমাধানে পারদর্শী, এবং অবশ্যই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব।” তাঁর চোখে শিক্ষকতা একটি কৌশলগত পেশা, কোনও বিকল্প বা ব্যর্থতার পরে বেছে নেওয়া কাজ নয়। বরং দেশ গঠনের মেরুদণ্ড।

“শিক্ষকেরা কেবল পাঠ্যবইয়ের বাহক নন। তাঁরা যদি নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করতে পারেন, তাহলে তার প্রভাব কয়েকটি ছাত্রের নয়, একটি প্রজন্মের উপর পড়ে,”—এই ভাবনাই তাঁর স্পষ্ট বার্তা।

তিনি সাবধান করেন, “একজন খারাপ ইঞ্জিনিয়ারকে এড়ানো যায়, একজন খারাপ চিকিৎসকও ধরা পড়ে যায়, কিন্তু একজন খারাপ শিক্ষক—তিনি প্রজন্মকে ধ্বংস করতে পারেন। এই পেশাকে অবহেলার জায়গা থেকে তুলে আনতে হবে মর্যাদার উচ্চতায়।”

আরামের অভিশাপ এবং বাংলা

কথা প্রসঙ্গে সোনম ওয়াংচুক ফিরে দেখালেন বাংলার ইতিহাস। একসময়ে যাকে ভারতীয় বুদ্ধিবৃত্তির রাজধানী বলা হত, আজ সে অঞ্চলেই তিনি দেখতে পাচ্ছেন আত্মতৃপ্তির ছায়া।

তিনি বললেন, “প্রথম প্রজন্ম সংগ্রাম করে উঠে আসে। দ্বিতীয় প্রজন্ম সেই সংগ্রামের মূল্য বোঝে বলেই সেই ধারা বজায় রাখে। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্ম, যারা সব কিছু প্রস্তুত অবস্থায় পায়—তাদের সামনে নেই প্রতিকূলতা, নেই কষ্ট—তাদের অনেক সময়ই পথ হারায়।”

ওয়াংচুকের মতে, এটাই হল ‘তৃতীয় প্রজন্মের অভিশাপ’। আর এটাই বর্তমানে বাংলার একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, “আরামের ছায়া শিশুদের ভিতর থেকে লড়াই করার স্পৃহা নষ্ট করে দেয়। আর প্রতিকূলতাই তো চরিত্র গঠনের কারখানা।”

তিনি অনুরোধ করেন অভিভাবকদের প্রতি—সন্তানদের সব কষ্ট থেকে রক্ষা করার চেষ্টা না করে বরং তাদের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে গড়ে তুলতে দিন। শুধু ডিগ্রি নয়, তৈরি করতে হবে এমন এক প্রজন্ম, যারা নেতৃত্ব দিতে পারে বাস্তব জীবনে।

হিমবাহের গলন ও পাহাড়ের কান্না

কলকাতার ওই অনুষ্ঠানে শিক্ষার পাশাপাশি আরও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তুলে ধরেন ওয়াংচুক—হিমালয়ের পরিবেশ সংকট। তিনি বলেন, “হিমবাহ আসলে জলের ব্যাঙ্ক। কিন্তু আজ তা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে, নিঃশব্দে। আর এই নিঃশব্দ বিপর্যয় যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী প্রজন্ম পড়বে জলবিহীন সংকটে।”

তিনি স্পষ্ট করলেন, শুধু হিমবাহ নয়, বনাঞ্চলও যখন হারিয়ে যাবে, তখন বর্ষাকালে দেখা দেবে আকস্মিক বন্যা আর গ্রীষ্মে থাকবে শুষ্ক নদীর খাঁড়ি। তখন আর উন্নয়ন বলে কিছু থাকবে না।

“কোনও উন্নয়নই সম্ভব নয় যদি জলের উৎস না থাকে। সীমান্তের নামে পাহাড়ের উপর যেভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা ভবিষ্যতের আত্মহত্যার পথ,” বলেন তিনি।

তিনি সরাসরি বার্তা দেন, “যারা আজ নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি গড়ছে, তাদের অনুকরণ করো না। বরং যুক্তির পথে ফেরাও তাদের। এই হিমালয় আমাদের নয় শুধু, গোটা এশিয়ার পানীয় জলের ভাণ্ডার।”

দায়িত্বশীল ভবিষ্যৎ গড়ার রূপরেখা

এই পুরো সংলাপ যেন ছিল ভবিষ্যতের প্রতি এক নীরব আহ্বান। একটি সমাজ তখনই টিকে থাকতে পারে, যদি তার নেতৃত্ব গড়ে ওঠে শিক্ষিত, সংবেদনশীল এবং পরিবেশসচেতন ভিত্তির উপর।

ওয়াংচুকের কথায়, “শিক্ষক পেশায় বিনিয়োগ করুন। সচেতন উদ্যোগকে উৎসাহ দিন। ভবিষ্যতের প্রজন্মকে শুধু আরামের জন্য নয়, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত করুন। এবং প্রকৃতিকে প্রতিপক্ষ নয়, উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে দেখুন।”

এই বক্তব্য শুধু একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না—তা ছিল এক সমষ্টিগত চেতনার উন্মোচন, যেখানে শিক্ষা, সমাজ এবং পরিবেশ একসূত্রে গাঁথা। এখন সময় এসেছে, এই বীজগুলিকে গ্রহণ করার, যেন ভবিষ্যতের ভার বহন করতে পারে আরও সুস্থ, আরও সংবেদনশীল এক সমাজ।

সোনম ওয়াংচুকের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, গভীর ও সময়োপযোগী। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে শুধু পাঠদান নয়, নেতৃত্ব গঠনের ভিত্তি হিসেবে দেখতে বলেন। বাংলা ও ভারতের প্রজন্ম যাতে দিশাহীন না হয়, তার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজকে একযোগে দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি, পরিবেশ-সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি মনে করিয়ে দিলেন—প্রকৃতি ধ্বংস হলে উন্নয়নের অঙ্ক মিলবে না। শিক্ষকতা হোক মর্যাদার পেশা, প্রজন্ম হোক সচেতন, আর প্রকৃতি হোক রক্ষিত—এই ছিল তাঁর বার্তা, যা উপেক্ষা করার সময় আর নেই।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply