কলকাতার বুকে আজও বিরাজ করছে এক রাজকীয় অতীত—১৯৩৭ সালের রোলস-রয়েস ফ্যান্টম III, এক সময় বম্বের গভর্নরের জন্য নির্মিত এই গাড়ি আজও সচল ও গর্বিতভাবে এক পরিবারের স্মৃতির বাহক। পুনঃনির্মাণ ছাড়াই অক্ষত অবস্থায়, এটি শুধু যন্ত্র নয়, উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যের জীবন্ত নিদর্শন। ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রেশন ‘WBC 1’-সহ কলকাতার ভিনটেজ র্যালিগুলিতে বারবার বিজয়ী এই গাড়ি, প্রযুক্তি ও আবেগের নিঃশব্দ মিলনস্থল। এক ঝলকে অতীত, চলমান বর্তমান আর এক অনিবার্য প্রশ্ন—আধুনিকের ভিড়ে কি পুরাতনই শ্রেষ্ঠ?
সূচিপত্র
Toggle■ STORY HIGHLIGHTS:
গভর্নর স্যার রজার লামলির জন্য বানানো হুপার-বডি যুক্ত ফ্যান্টম III
১৯৫০-এর দশকে কলকাতায় ফিরে আসে, গাড়িপ্রেমিক খান বাহাদুর গুলাম কিবরিয়ার হাত ধরে
আধুনিকতার ভিড়ে এখনও চলাচলে সক্ষম, কোনও পূর্ণ পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়নি
রাজকীয় রেজিস্ট্রেশন ‘WBC 1’-সহ কলকাতার ভিনটেজ গাড়ি শোতে বারংবার পুরস্কৃত
পারিবারিক বিয়ে, কলেজ যাওয়া এমনকি প্রজন্মান্তরের স্মৃতির গাড়ি এই ফ্যান্টম
কলকাতার কোলাহল, ভিড় আর ইট-পাথরের মাঝে আচমকাই যদি চোখে পড়ে ধীরে চলা এক বিশাল রাজকীয় গাড়ি, তখন তা নিছক যানবাহন নয় — যেন অতীতের এক জলছবি। এই শহরের বুকে এমনই এক দৃষ্টিনন্দন অতীতকে বহন করে চলেছে একটি ১৯৩৭ সালের রোলস-রয়েস ফ্যান্টম III। আর এই গাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্মের আবেগ, যত্ন আর অসম্ভব ভালোবাসার গল্প।
এক মহারাজকীয় যানের আগমন
যার জন্মের পেছনে আছে ব্রিটিশ প্রশাসনিক শাসনের উচ্চপর্যায়ের আদেশ, সে তো নিঃসন্দেহে বিশেষ কিছু। এই রোলস-রয়েস ফ্যান্টম III প্রথমে তৈরি হয়েছিল বম্বের তৎকালীন গভর্নর স্যার রজার লামলির জন্য। গাড়িটিতে তখন ছিল গভর্নরের জন্য নির্ধারিত লাল বাতি ও পতাকার জায়গা। স্বাধীনতার পরে সেই আলোকচিহ্ন সরিয়ে গাড়িটি ফিরে যায় ব্রিটেনে। তবে তা শেষ নয়, বরং অন্য এক অধ্যায়ের শুরু।
পারিবারিক উত্তরাধিকার: ব্রিটেন থেকে কলকাতার প্রত্যাবর্তন
গাড়িটি ফের ভারতে আসে ১৯৫১-৫২ সালের দিকে, এক বিশিষ্ট ব্যক্তির হাত ধরে — খান বাহাদুর গুলাম কিবরিয়া, যিনি জলপাইগুড়ির নবাবের জামাতা ছিলেন। নিজে এককালে একটি ফ্যান্টম I-এর মালিক ছিলেন তিনি, কিন্তু এই ফ্যান্টম III-এর বেলায় তার চোখে তা ছিল নিছক যানবাহন নয় — এক যান্ত্রিক বিস্ময়।
“এই গাড়ি আমাদের পরিবারের সঙ্গে আমার জন্মের আগেই ছিল,” বলেন আজম মোনেম, যিনি এখন এই গাড়ির অভিভাবক। ৬৫ বছর বয়সী এই চা পরীক্ষক ও ব্যবসায়ী গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ফ্যান্টম III-কে আগলে রেখেছেন।
ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অপূর্ব এক অধ্যায়
যাঁরা যন্ত্রপ্রেমী, তাঁদের কাছে এই গাড়ি যেন এক স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং। ১২ সিলিন্ডার, ২৪ স্পার্ক প্লাগ, ডুয়াল ইগনিশন কয়েল, ডুয়াল ফুয়েল পাম্প এবং ডুয়াল ডিস্ট্রিবিউটর — যেন একাধিক হৃদয় নিয়ে তৈরি কোনও জীবন্ত অস্তিত্ব।
মোনেম বলেন,
“এটা প্রায় দুটো ইঞ্জিন একসঙ্গে। ছয় কিংবা বারো সিলিন্ডারে চালানো যায়। রোলস-রয়েস একে বিমানের মতো ডিজাইন করেছিল, যাতে ব্যর্থতা ঘটলেও বিকল্প থাকে।”
এই গাড়ির নকশাই একসময় স্পিটফায়ার যুদ্ধবিমানের মার্লিন ইঞ্জিনের প্রোটোটাইপ হয়ে উঠেছিল — ইতিহাস ও প্রযুক্তির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এক নিদর্শন।
যত্নে বাঁচে ঐতিহ্য
এই ফ্যান্টম III-এর সবচেয়ে আলাদা দিক — এটি কখনও পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করা হয়নি। রঙের খোসা, যন্ত্রের অচলাবস্থা বা আধুনিক অংশ সংযোজনের কোনও প্রয়োজন হয়নি।
“এটা সংরক্ষণ, পুনর্গঠন নয়,” — মোনেমের স্পষ্ট বক্তব্য।
“দাদুর মৃত্যুর পর ১০-১৫ বছর বন্ধ ছিল, তবে শুধু তেল আর পেট্রোল বদলে স্টার্ট দিলেই চলতে শুরু করে।”
তবে কলকাতার বর্তমান পরিস্থিতিতে এই গাড়িকে সচল রাখা সহজ নয়। এথানল-যুক্ত পেট্রোল, যান্ত্রিক জটিলতা ও কার্বুরেটর ফাটার মতো সমস্যার সমাধানে মোনেমকে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে যন্ত্রাংশ আনতে হয়েছে। তবুও, মূল কাঠামো অক্ষত রেখেই চলছে গাড়ির চলমান ইতিহাস।
পুরনো বনাম নতুন: রোলস-রয়েসের আত্মার সন্ধানে
যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, নতুন কোনও রোলস-রয়েস কিনবেন কি না — যেমন Wraith বা Phantom VIII, মোনেম একটু হাসেন।
“নতুন রোলস আমার কাছে একেবারেই আকর্ষণীয় নয়।”
তিনি বলেন,
“আমার এক আত্মীয় ঢাকায় নতুন স্পেকট্রা কিনেছেন, কিন্তু তিনিও বলেন যে ফ্যান্টম III থাকলে সেটাই নিতেন।”
এক অন্য আত্মীয় ইংল্যান্ডে একটি আধুনিক ফ্যান্টম এবং একটি ১৯৩৬ সালের ফ্যান্টম III কিনেছেন — এক কথায়, আবেগের কাছে প্রযুক্তি নতি স্বীকার করেছে।
ক্যাম্পাস থেকে কান্না-হাসির দিন
এই গাড়ির সঙ্গে পারিবারিক জীবনের বহু অধ্যায় জড়িয়ে। আজম মোনেম বলেন,
“সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে গাড়ি নিয়ে গেলে প্রিন্সিপাল নিজে নেমে এসে বললেন, কেন ওটা প্রফেসরের পার্কিংয়ে রেখেছি। আমি বললাম, ‘এটা এত বড়, আর কোথাও রাখার জায়গা পাইনি!’”
নিজের বিয়ে থেকে শুরু করে কন্যার বিয়ে পর্যন্ত — প্রতিটি প্রজন্মের বরের বাহন এই ফ্যান্টম III।
“আমার স্ত্রী মজা করে বলতেন, এটা আমার আরেক স্ত্রী। তখন বাবা বলতেন, ওকে বলো যেন তোমার প্রিয় স্ত্রী হয়ে ওঠে — কারণ তোমার প্রথম স্ত্রী তো রোলস।” — মোনেম হেসে বলেন।
রেজিস্ট্রেশনেই রাজকীয় ছাপ
“WBC 1” নাম্বার প্লেটটি একে শহরের অন্যান্য গাড়ির থেকে আলাদা করে তোলে। বহুবার কলকাতার স্টেটসম্যান র্যালি বা কনকোর্সে অংশ নিয়ে এসেছে সেরা পুরস্কার।
২০২৩ সালে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোটরিং গ্রুপের কনকোর্সে এই গাড়ি “Judges Choice” এবং “Best of Show” পুরস্কার জেতে।
কিন্তু আজম মোনেমের কাছে এই স্বীকৃতি নয়, গাড়ির ধারাবাহিকতা বড় কথা।
“এমন গাড়ির মালিক হওয়া যায় না। কেবল যত্ন নেওয়া যায়, সময়ের জন্য তার রক্ষক হওয়া যায়। এই উত্তরাধিকার চালিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।”
এই ফ্যান্টম III যেন কলকাতার রাজপথে চলমান এক অতীত — যেখানে প্রযুক্তির সঙ্গে মিশে আছে ভালোবাসা, যেখানে গাড়ি নয়, এক পরিবারের আত্মপরিচয় পথ খুঁজে নিচ্ছে সময়ের মধ্য দিয়ে।
রোলস-রয়েস ফ্যান্টম III শুধু একটি গাড়ি নয়, এক জীবন্ত ইতিহাস, যা কলকাতার রাজপথে চলতে চলতে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে একটি যুগের ছাপ, এক পরিবারের উত্তরাধিকার এবং এক শহরের আবেগ। আধুনিক প্রযুক্তির চমক থাকলেও এই গাড়ির মতো ঐতিহ্য, অনুভূতি ও শ্রদ্ধা আজও তুলনাহীন। পুরনো আর নতুনের দোলাচলে ফ্যান্টম III প্রমাণ করে, কিছু যন্ত্র কেবল যন্ত্র থাকে না—তারা হয়ে ওঠে সময়ের সাক্ষী, গর্বের প্রতীক, এবং ভালবাসার স্থায়ী ছায়া।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো