কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ব্যস্ত জনপদে, প্রতিদিন গিটারের সুরে পথচলতি মানুষকে থমকে দিচ্ছে ১৫ বছর বয়সি এক কিশোর—দেবরাজ ভট্টাচার্য। বাস্কিংকে পেশা নয়, মনের ভাষা করে তুলেছে সে। মুম্বইয়ে জন্ম, কলকাতায় বসবাসকারী দেবরাজ এখন NIOS-এর নবম শ্রেণির ছাত্র। সংগীতেই ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্প তার, লক্ষ্য—বোস্টনের খ্যাতনামা বার্কলি কলেজ অব মিউজিক। প্রয়াত গায়িকা মা’র ইচ্ছাই তার পথপ্রদর্শক। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে তার গান। বিদেশে সংগীতে পরিশ্রমে সুযোগ মেলে—এই বিশ্বাসে গানই এখন তার একমাত্র সম্বল।

🟩 STORY HIGHLIGHTS

  • পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় বাস্কিং করা ১৫ বছরের কিশোর দেবরাজ

  • সংগীতের অনুপ্রেরণা এসেছে প্রয়াত মা’র কাছ থেকে

  • পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন NIOS-এর মাধ্যমে, পাশাপাশি চলছে সুরচর্চা

  • দেশি-বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে খুঁজে পান প্রেরণা

  • ভবিষ্যতের লক্ষ্য—বার্কলি কলেজে সংগীত নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা

পার্ক স্ট্রিটের কারনানি ম্যানসনের সামনে প্রতিদিনই থাকে ব্যস্ততা, থাকে গাড়ির হর্ন, পদচারণার কোলাহল। কিন্তু হঠাৎ করেই, সেই চেনা কোলাহলের মাঝে এক অন্য সুর বেজে ওঠে—গিটারের ঝংকার। ভিড়ের মধ্যে কেউ থেমে যায়, কেউ মোবাইলে রেকর্ড করতে শুরু করে, কেউ আবার নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানেই দেখা মেলে ১৫ বছর বয়সি দেবরাজ ভট্টাচার্যর, যার চোখে যেন ভেসে ওঠে এক ভিন্ন পৃথিবীর ছবি—বোস্টনের বার্কলি কলেজ অব মিউজিক।

এই কিশোর কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ কিশোরের মতো নয়। যাদের সপ্তাহান্ত মানেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ক্যাফে, সিনেমা বা সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রলে ডুবে থাকা—দেবরাজের জীবনের ছুটির মানে একটু অন্যরকম। ২০২২ সাল থেকে পার্ক স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে, নিজের গিটারে গান বাজিয়ে, জনতার সামনে সংগীত পরিবেশন করছেন তিনি—একটা প্রক্রিয়া, যাকে বলে বাস্কিং

“বিদেশে লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেভাবে গানের মাধ্যমে মানুষকে ছুঁয়ে দেয়, সেসব ভিডিও অনেক দেখতাম সোশ্যাল মিডিয়ায়,”
বলছিলেন দেবরাজ,
“সেইসব দেখে আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি এখানে কিছু করি, তবে কেমন হয়! সেই সাহসটা সেখান থেকেই এল।”

মাত্র দুই বছর ছয় মাস বয়সে মা’কে হারিয়েছিলেন দেবরাজ। মা ছিলেন একজন গায়িকা, যিনি বাড়িতে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। সেই গানের ধ্বনি আজও যেন কানে বাজে তার।

“মায়ের মুখটা অনেকটাই ঝাপসা, তবে তাঁর সুরের মধ্যে যেন একটা আলো ছিল। বাবা-মা ঠিক করেছিলেন, আমি গান শিখব। মা এখন আর নেই, কিন্তু তাঁর স্বপ্নটা আমি সঙ্গে নিয়ে চলি,”
বলছিলেন দেবরাজ, চোখে একটা শান্ত কিন্তু দৃঢ় দৃষ্টি।

মুম্বইয়ে জন্ম, তবে বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা তিনি। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয় না, কারণ পড়ছেন National Institute of Open Schooling (NIOS)-এর অধীনে, নবম শ্রেণিতে। নিজের সময় অনুযায়ী পড়াশোনা এবং সংগীতচর্চার সমন্বয় ঘটাচ্ছেন। ২০১৯ সালে গিটার শেখা শুরু করেছিলেন। তার পর থেকে গিটারের প্রতি এক ধরনের আত্মিক টান তৈরি হয়েছে।

অনুপ্রেরণার তালিকাটা দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভারতের অরিজিত সিং বা আমজাদ আলি খান থেকে শুরু করে ইয়ানি, লিওনার্ড কোহেন, অ্যারোসমিথ কিংবা দ্য ঈগলস—সবার সংগীতের মধ্যে কিছু না কিছু খুঁজে পান তিনি।

“আমার সংগীতবোধ খুবই আবেগপ্রবণ,”
বললেন দেবরাজ,
“কখনও রক, কখনও কান্ট্রি, কখনওবা নিছক হিন্দি সিনেমার গান। মেজাজ যেমন থাকে, তেমন গান বেছে নিই। জন ডেনভার, হ্যারি বেলাফন্টে—সব শুনি।”

বাস্কিং-এর জন্য গান বেছে নেন খুব বুঝে-শুনে। পার্ক স্ট্রিটের পথচলতি মানুষের মেজাজ বুঝে বদলান নিজের গান।

“সব সময় জানি না কারা দাঁড়াবেন, কিসে মন দেবে তারা। তাই চেষ্টা করি এমন গান পরিবেশন করতে, যেটা সবাই কোনও না কোনও ভাবে শুনেছেন। বেশিরভাগ সময় হিন্দি গানই রাখি তালিকায়,”
বললেন দেবরাজ।

তার বাস্কিং-এর অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইনে। তার ভিডিও দেখে অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন।

“বন্ধু তেমন একটা নেই এখানে, কিন্তু একজন আছে, যার রিয়্যাকশন বেশ ভালো ছিল ভিডিও দেখে। মানুষজনের প্রতিক্রিয়া বেশ ইতিবাচক। এটা খুব প্রেরণাদায়ক,”
বললেন দেবরাজ।

সংগীতের এই পথচলা এখানেই থামাতে চান না তিনি। ভবিষ্যতে বার্কলি কলেজ অব মিউজিক থেকে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স করতে চান, বিশেষ করে কম্পোজিশন ও প্রোডাকশন বিভাগে।

“বিদেশে পরিশ্রম করলে ফল পাওয়া যায়, এখানে সবকিছু অনেকটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। আমি চাই পরিশ্রমের যথাযথ মর্যাদা পেতে,”
সরাসরি বললেন এই কিশোর শিল্পী।

এ কথা শুধু দেবরাজের নয়, আজকের বহু তরুণ শিল্পীর ভাবনা। শুধু ভাইরাল হওয়া নয়, নিজেদের পরিশ্রম, প্রতিভা আর দৃঢ়তার মাধ্যমে একটা স্থায়ী জায়গা তৈরি করতেই চাইছেন তারা—সংগীতের জগতে, জীবনের মঞ্চে।

সংগীত কখনও শুধু সুর নয়, তা হয়ে ওঠে জীবনের ভাষা, নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার উপায়। দেবরাজ ভট্টাচার্যর গল্প ঠিক তেমনই—পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে শুধু গান নয়, গড়ে তুলছে নিজের ভবিষ্যৎ। প্রতিদিনের চেনা কোলাহলের মাঝেও তার গিটারের সুর জানিয়ে দেয়, স্বপ্ন যদি সত্যি হয় অন্তর থেকে, তবে পথ নিজেই তৈরি হয়। গানের মধ্যে দিয়ে দেবরাজ দেখাচ্ছে যে প্রতিভা আর সাহস থাকলে, যেকোনও মঞ্চেই বাজানো যায় জীবনের সেরা সুর।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply