নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহ বারবার সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। ভারত-পাকিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্য, শান্তির বার্তা ছড়ানোর দাবি করছেন তিনি নিজেই। মনোনয়ন মিললেও আজও অধরা সেই বিশ্বজয়ী পুরস্কার। বারাক ওবামার আগাম প্রাপ্তি যেন তাঁর দীর্ঘশ্বাসের অন্যতম কারণ। প্রশংসা, স্বীকৃতি আর ইতিহাসে নিজেকে বসানোর আকাঙ্ক্ষায়, ট্রাম্পের পুরস্কারপ্রীতি যেন অবিরাম এক প্রচেষ্টা। আবারও দাবি তুলেছেন—অন্যায়ভাবে তাঁকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সত্যিই কি তাঁর কূটনৈতিক ভূমিকা অবহেলিত? নাকি এ কেবল উচ্চাশার এক রাজনৈতিক কাহিনি?
সূচিপত্র
Toggle📌 স্টোরি হাইলাইটস (Story Highlights):
ট্রাম্প দাবি করেন, ভারত-পাকিস্তান, সার্বিয়া-কসোভো এবং মিসর-ইথিওপিয়ার মধ্যে শান্তি আনার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন
পাকিস্তান তাঁর নাম সুপারিশ করে এক্স (সাবেক টুইটার)-এ পোস্ট করে বলেছে, ২০২৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত তিনি
ওবামার নোবেল জয় নিয়ে ট্রাম্পের অসন্তোষ বহুবার প্রকাশিত
তাঁর উপদেষ্টাদের মতে, নোবেল চাওয়া প্রতীকি নয়, বরং তা তাঁর কূটনৈতিক অবস্থান নির্ধারণের অন্যতম উপায়
বারবার মনোনয়ন পাওয়া সত্ত্বেও নোবেল কমিটি এখনো তাঁকে পুরস্কার দেয়নি
ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, রাজনীতি, ব্যবসা কিংবা বিতর্ক—সব ক্ষেত্রেই নজরকাড়া নাম। তবে একটি বিষয় আছে যা তাঁকে বছরের পর বছর তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে—নোবেল শান্তি পুরস্কার। নিজের রাজনৈতিক জীবনের একাধিক পর্যায়ে তিনি প্রকাশ্যে এই পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জানিয়েছেন, কখনও সরাসরি, আবার কখনও পরোক্ষভাবে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর কথিত ভূমিকা, বিশেষত আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টাগুলিকে বারবার তিনি নোবেল পাওয়ার যৌক্তিকতা হিসেবে তুলে ধরেছেন।
সম্প্রতি আবারও ট্রাম্প এই পুরস্কার নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। তাঁর দাবি, “আমি যা-ই করি না কেন, কেউ আমাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেবে না।” এই মন্তব্য আসে এমন সময়ে যখন তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক সংঘাত নিরসনে নিজের ভূমিকা উল্লেখ করে পুরস্কার না পাওয়াকে ‘অন্যায় অবহেলা’ বলে ব্যাখ্যা করেন।
ট্রাম্পের শান্তি কূটনীতির দাবি
ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন যে, তাঁর প্রেসিডেন্সি চলাকালে বিশ্বরাজনীতির বিভিন্ন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তিনি শান্তির বার্তা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত উত্তেজনা, সার্বিয়া ও কসোভোর বৈরিতা, মিসর ও ইথিওপিয়ার জলবণ্টন বিরোধ—সব ক্ষেত্রেই তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় “গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা” রেখেছেন।
তিনি বলেন,
“এই সব সংকটের সময়, আমার প্রশাসন সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করেছে যাতে যুদ্ধের পরিবর্তে আলোচনার পথ তৈরি হয়।”
তবে এসব দাবির অনেকাংশই সংশ্লিষ্ট দেশগুলির পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বিশেষত ভারত, বারবার জানিয়ে দিয়েছে যে, ভারত-পাকিস্তান বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক এবং কোনও তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়ায় সমর্থন
২০২৪ সালের জুন মাসে, পাকিস্তান সরকার এক্স-এ একটি পোস্ট করে ট্রাম্পের নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করে। সেখানে বলা হয়,
“সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সঙ্কটে ট্রাম্পের দৃঢ় নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ বিশ্বশান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”
এমন সময়ে এই আহ্বান এল যখন ট্রাম্প নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নোবেল নিয়ে একাধিক মন্তব্য করছেন।
“আমি শান্তি এনেছি, যুদ্ধ ঠেকিয়েছি—তবুও আমার স্বীকৃতি নেই,”
এমন অভিযোগ তুলে তিনি লেখেন,
“আমি নোবেল পাব না, কারণ আমি ডোনাল্ড ট্রাম্প।”
মনোনয়ন তো বহুবার, স্বীকৃতি কই?
ট্রাম্প প্রথমবার মনোনীত হন তাঁর প্রেসিডেন্সির সময়েই। এরপর একাধিকবার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের তরফে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। নরওয়ের সাংসদ ক্রিশ্চিয়ান টাইব্রিং-গ্যেদে, সুইডিশ সাংসদ ম্যাগনাস জ্যাকবসন এবং মার্কিন কংগ্রেসওম্যান ক্লডিয়া টেনি সবাই তাঁকে মনোনীত করেছেন। তাঁরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন আব্রাহাম অ্যাকর্ডস এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টার কথা।
২০২৪ সালে ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত আইন অধ্যাপক আনাত এলন-বেকও ট্রাম্পের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন,
“ট্রাম্পের প্রচেষ্টাই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রথম ধাপ তৈরি করেছিল, এবং তাঁর ভূমিকা উপেক্ষা করা উচিত নয়।”
ইউক্রেনের রাজনীতিবিদ ওলেকসান্দার মেরেজকোও এর আগে তাঁকে মনোনীত করেন।
নোবেল কমিটির নীরবতা ও ট্রাম্পের অসন্তোষ
নরওয়ের পার্লামেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত নোবেল কমিটি সবসময়ই নিরপেক্ষতা, গোপনীয়তা ও স্বতন্ত্র মূল্যায়নের কথা বলে আসছে। কিন্তু ট্রাম্প এই পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।
“এটা রাজনৈতিক পক্ষপাত, অন্য কিছু নয়,”—এই অভিযোগ নিয়েই তিনি বলেন,
“ওরা আমাকে পুরস্কার দেবে না কারণ আমি জনপ্রিয় না, কারণ আমি মিডিয়ার প্রিয় নই।”
ওবামার পুরস্কার: অভিমান নাকি প্রতিযোগিতা?
২০০৯ সালে, বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার কিছু মাসের মধ্যেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। ওই পুরস্কারকে ঘিরেই ট্রাম্পের বহু ক্ষোভ জমে আছে। ২০১৯ সালে তিনি বলেছিলেন,
“ওবামাকে তারা শুধু প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য পুরস্কার দিয়েছে। এমনকি ওবামাও জানত না কেন তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এটাই আমি ওর সঙ্গে একমত।”
প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের মতে,
“ট্রাম্প মনে করেন, যদি ওবামা প্রেসিডেন্সির শুরুতেই পুরস্কার পেতে পারেন, তাহলে তিনি কেন নয়, যিনি এত আন্তর্জাতিক শান্তি আলোচনায় যুক্ত ছিলেন?”
পুরস্কার কেন চাইছেন ট্রাম্প?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে উঠে আসে তাঁর রাজনীতির গভীরে থাকা স্বীকৃতির খোঁজ। ট্রাম্প বহুবারই বলেছেন,
“এই পুরস্কার শুধু পুরস্কার নয়, এটা ইতিহাসের পাতায় আমার অবস্থান ঠিক করে দেবে।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং অ্যাক্সিওস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাঁর পররাষ্ট্রনীতির অনেক সিদ্ধান্তই এই পুরস্কার জয়ের কৌশলের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
পুরস্কার চাই না, কিন্তু মানুষ জানে?
বহুবারই ট্রাম্প এই ধরণের বক্তব্য রেখেছেন:
“পুরস্কার না পেলেও আমার কিছু যায় আসে না… কিন্তু মানুষ জানে আমি কী করেছি।”
তবে সমালোচকরা বলেন, এই বক্তব্যে যে অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার সুর রয়েছে, তা বোঝা যায় সহজেই।
ইতিহাসের পাতায় মার্কিন প্রেসিডেন্টদের নোবেল জয়
ট্রাম্প একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন যিনি নোবেল পেতে চেয়েছেন। এর আগে চারজন প্রেসিডেন্ট এই পুরস্কার অর্জন করেছেন—থিওডোর রুজভেল্ট (১৯০৬), উড্রো উইলসন (১৯১৯), জিমি কার্টার (২০০২), এবং বারাক ওবামা (২০০৯)। কিন্তু তাঁদের কেউই ট্রাম্পের মতো এত খোলামেলা আকাঙ্ক্ষা দেখাননি।
ট্রাম্পের জন্য এই পুরস্কার শুধু সম্মান নয়, বরং নিজের নীতির বৈধতা, নিজের ভাবমূর্তির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং ওবামার সঙ্গে একপ্রকার প্রতিযোগিতারও প্রতিফলন। তবে তিনি আদৌ এই পুরস্কার পাবেন কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়—এই পুরস্কার নিয়ে তাঁর ব্যাকুলতা আগামী দিনেও বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় থাকবে।
নোবেল শান্তি পুরস্কারকে ঘিরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরাগ যেন একটি চলমান রাজনৈতিক নাটক। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিজের ভূমিকা নিয়ে তাঁর দাবিগুলি যেমন একদিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, তেমনি বিতর্কও তৈরি করেছে যথেষ্ট। মনোনয়ন পাওয়া সত্ত্বেও পুরস্কার অধরাই থেকে যাওয়ায় তাঁর ক্ষোভ আরও জোরালো হয়েছে। ওবামার আগাম প্রাপ্তি ও নিজের বঞ্চনার অনুভূতি মিলিয়ে এই পুরস্কার যেন ট্রাম্পের রাজনৈতিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত পুরস্কার আদৌ তাঁর ঝুলিতে যাবে কি না, তা ভবিষ্যতের বিষয়; কিন্তু নোবেল ঘিরে তাঁর জেদ যে আন্তর্জাতিক আলোচনায় রয়ে যাবে, তা বলাই যায়।