কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরেই কি লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের আসল জন্মসূত্র?

বিগ ব্যাং তত্ত্ব দীর্ঘদিন ধরে মহাবিশ্বের উৎপত্তির মূল ভিত্তি হলেও, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে চমকে দেওয়া মতামত। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের মহাবিশ্ব সম্ভবত জন্মেছে এক বিশাল কৃষ্ণগহ্বরের গভীরে ঘটে যাওয়া এক বিরল ‘বাউন্স’-এর মাধ্যমে। এই তত্ত্বে নেই কোনও কল্পিত শক্তি বা অদৃশ্য উপাদান, বরং পুরনো বিজ্ঞানেরই নতুন ব্যাখ্যা। সহজ যুক্তি, চোখ ধাঁধানো ভাবনা ও অজানার হাতছানি—এই নতুন মত মহাবিশ্বকে নিয়ে ভাবনার দিগন্ত খুলে দিচ্ছে এক অভিনব পথে।

🔍 স্টোরি হাইলাইটস: এক নজরে জানুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • নতুন তত্ত্ব বলছে, মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে এক কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে সংঘটিত ‘বাউন্স’-এর ফলে

  • প্রচলিত বিগ ব্যাং মডেলের ‘সিঙ্গুলারিটি’র সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়েছে এই মডেল

  • কোয়ান্টাম এক্সক্লুশন প্রিন্সিপলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা: পদার্থ একই কোয়ান্টাম অবস্থানে থাকতে পারে না

  • এই মডেল অনুযায়ী, মহাবিশ্ব সামান্য ঊর্ধ্ব-বক্র, সমতল নয়

  • ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ইউক্লিড টেলিস্কোপ এবং মিশন ‘আরাকিহস’ এই তত্ত্ব যাচাই করতে পারে

  • এই মডেল ইনফ্লেশন ও ডার্ক এনার্জির প্রয়োজন ছাড়াই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম

আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে, একটি অসীম ঘনত্ব ও তাপমাত্রার বিন্দু থেকেই মহাবিশ্বের উদ্ভব—এমন ধারণাই এতদিন আমাদের মহাকাশবিজ্ঞানের মূল স্তম্ভ ছিল। এই তত্ত্ব, যা ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ নামে সুপরিচিত, যুগের পর যুগ ধরে বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে আধিপত্য করে এসেছে। কিন্তু, বিজ্ঞান তো চিরকালই প্রশ্ন করে, খোঁজে বিকল্প পথ। আর ঠিক সেই জায়গা থেকেই উঠে এল এক নতুন ব্যাখ্যা, যা প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ দেখাতে চাইছে।

সম্প্রতি ফিজিক্যাল রিভিউ ডি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে একটি ব্যতিক্রমী গবেষণা। সেখানে বলা হয়েছে, আমাদের মহাবিশ্ব আসলে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল কৃষ্ণগহ্বরের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া মহাকর্ষীয় সংকোচন এবং একধরনের ‘কোয়ান্টাম বাউন্স’-এর মাধ্যমে। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ পোর্টসমাউথ-এর ইনস্টিটিউট অফ কসমোলজি অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশন-এর অধ্যাপক এনরিকে গাজটানাগা এবং তাঁর সহকর্মীরা।

Universe may have started inside black hole, not from Big Bang, study  suggests | The Independent

প্রচলিত ধারণার সীমাবদ্ধতা এবং নতুন আলোচনার জন্ম

বিগ ব্যাং তত্ত্ব আজও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলেও, এর ভিতরেই রয়ে গেছে বেশ কিছু প্রশ্ন যার উত্তর আমরা জানি না। এই মডেলে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটে একটি ‘সিঙ্গুলারিটি’ থেকে—যেখানে ঘনত্ব ও তাপমাত্রা অসীম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন একটি সিঙ্গুলারিটি কি কখনও বিদ্যমান ছিল? আরও বড় কথা, সেই সিঙ্গুলারিটির উৎপত্তি কোথা থেকে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কখনও মেলেনি।

তার উপর, এই মডেল নির্ভর করে বেশ কিছু এমন উপাদানের উপর যাদের অস্তিত্ব আজও পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়—যেমন ইনফ্লেশন ফিল্ড, ডার্ক এনার্জি ইত্যাদি। ফলে, নতুন একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন

এই নতুন মডেলটি সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি সমন্বয়। এর মূল ভিত্তি হলো কোয়ান্টাম এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল—যা বলে, কোনও দুই ফার্মিয়ন বা অভিন্ন কণা একই কোয়ান্টাম অবস্থানে একসঙ্গে থাকতে পারে না। এই নিয়ম যখন কৃষ্ণগহ্বরে পতিত পদার্থে প্রয়োগ করা হয়, তখন এক সময়ে এসে সংকোচন থেমে যায় এবং ঘটতে থাকে প্রতিঘাত বা ‘বাউন্স’। সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন এক মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ।

এই প্রক্রিয়াটি ঘটে এক বৃহৎ ‘প্যারেন্ট ইউনিভার্স’-এর কৃষ্ণগহ্বরে। সেখানে পতিত এক বৃহৎ ভর প্রথমে সংকুচিত হয়ে একটি অত্যন্ত ঘন অবস্থায় পৌঁছে, তারপর কোয়ান্টাম প্রভাবের ফলে সেটি আবার প্রসারিত হতে শুরু করে। এই ঘটনার ফলেই সম্ভব হয় একটি নতুন মহাবিশ্বের উদ্ভব।

25 times more powerful than Supernovae': Astronomers identify the brightest  blast since Big Bang

পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের প্রয়োগ ক্ষেত্র

গবেষকরা দাবি করেছেন, এই মডেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাস হলো—মহাবিশ্ব একেবারে সমতল নয়, বরং এতে রয়েছে সামান্য ঊর্ধ্ব-বক্রতা। এই তথ্য যদি পরীক্ষায় সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রচলিত কসমোলজিকাল মডেলকে নতুন করে ভাবতে হবে। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ESA-র ইউক্লিড টেলিস্কোপ এই বক্রতা নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।

পাশাপাশি, ভবিষ্যতের একটি গবেষণা প্রকল্প ‘Arrakihs’ ছায়াপথের দুর্বল কাঠামো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অতীতের সেই ‘সংকোচন ধাপ’-এর কিছু সম্ভাব্য অবশেষ চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। যদি সেই চিহ্নগুলি পাওয়া যায়, তাহলে এই নতুন তত্ত্ব আরও মজবুত ভিত্তি পাবে।

অন্যতর আলোচনার দরজা খুলছে

এই নতুন মডেল শুধু মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেই থেমে নেই, এটি একই সঙ্গে দুটি দ্রুত সম্প্রসারণ পর্ব—প্রথম ইনফ্লেশন এবং বর্তমানে ডার্ক এনার্জি—কোনও কাল্পনিক ফিল্ড ছাড়াই ব্যাখ্যা করতে পারছে। সেই সঙ্গে এটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলির জন্ম ও ছায়াপথের বণ্টন সম্পর্কেও নতুন দিকনির্দেশ দিতে পারে।

সব মিলিয়ে, এই তত্ত্ব যদি ভবিষ্যতের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে পরীক্ষিত হয়ে ওঠে, তবে এটি কেবল একটি বিকল্প ব্যাখ্যা নয়—বরং মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত ভাবনার গোড়াকেই নাড়া দিতে পারে। আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো কোনও এক বৃহৎ চক্রের এক খণ্ডমাত্র, আর এই চক্রের কেন্দ্রে রয়েছে এক অলক্ষ্য কৃষ্ণগহ্বর—যার ভিতরেই লুকিয়ে আছে সব কিছুর সূচনা।

মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে বহু দশক ধরে প্রচলিত বিগ ব্যাং তত্ত্বকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক নতুন বিতর্কের আবহ। কৃষ্ণগহ্বরের গভীরে এক ‘কোয়ান্টাম বাউন্স’-এর সম্ভাবনায় উঠে আসছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে কোনও কাল্পনিক উপাদানের প্রয়োজন নেই। এই তত্ত্ব শুধু সৃষ্টির প্রশ্নেই নয়, মহাবিশ্বের গঠন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও নতুন আলো ফেলছে। যদিও এই ধারণা এখনও পরীক্ষাধীন, তবু আসন্ন মহাকাশ মিশন ও পর্যবেক্ষণই ঠিক করে দেবে, আদৌ কি আমাদের জন্ম কৃষ্ণগহ্বরের হৃদয়েই, নাকি আমরা এখনো অজানার মধ্যেই ভেসে চলেছি।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply