“মুর্শিদাবাদ—এক শহর যেখানে গঙ্গার স্রোত বয়ে আনে নবাবি আভিজাত্যের গল্প। হাজারদুয়ারির রহস্য, ইমামবাড়ার আভা, কাঠগোলার বাগান আর কাশিমবাজারের রাজপ্রাসাদ—প্রতিটি কোণ যেন সময়ের পাতায় আটকে থাকা এক ছবি। এখানে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের ফিসফিসানি শোনা যায়, মিষ্টির দোকানে অতীতের স্বাদ মেলে। এক ভ্রমণকারীর কথায়— ‘মুর্শিদাবাদ শুধু ঘোরার জায়গা নয়, এটি অতীতের দরজা, যা একবার খোলার পর মন আর ফিরে যেতে চায় না।’”
যে শহর সময়কে থামিয়ে রেখেছে
গঙ্গার ঢেউ যখন অলস দুপুরে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে চলে, তখনই মনে হয়—এ শহরের সময় যেন ১৮শ শতকে আটকে আছে। মুর্শিদাবাদ শুধু একটি জেলা নয়, এটি বাংলার নবাবদের রাজধানী, ভারতের ইতিহাসে বাণিজ্য ও রাজনীতির মঞ্চ, আর ভ্রমণকারীদের কাছে এক অপূর্ব খোলা পাঠ্যবই।
এখানে হাঁটলেই আপনার পায়ের নিচে কড়মড় করে বাজবে পুরনো ইটের আওয়াজ, আর দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে কান পাতলেই শোনা যাবে ফিসফিস—“পলাশীর ময়দানে আমরা হারিনি, আমরা গল্পে বেঁচে আছি।”
কীভাবে যাবেন মুর্শিদাবাদে?
ট্রেনে
শিয়ালদহ → লালগোলা লোকাল বা ভাগীরথী এক্সপ্রেস — ভ্রমণ সময় ৪–৫ ঘণ্টা।
হাওড়া → আজিমগঞ্জ প্যাসেঞ্জার — সুন্দর গ্রামীণ দৃশ্যের ভেতর দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবেন।
স্টেশন থেকে টোটো, অটো বা রিকশায় সহজে পৌঁছানো যায় হাজারদুয়ারি, ইমামবাড়া ইত্যাদিতে।
বাসে
কলকাতা থেকে বহরমপুর পর্যন্ত এসটিএসসি বা প্রাইভেট বাস (₹300–₹500)।
বহরমপুর থেকে স্থানীয় টোটো বা শেয়ার-অটোতে পর্যটন স্পটগুলো ঘোরা যায়।
প্রাইভেট গাড়ি
NH-34 ধরে প্রায় ২০০ কিমি, পথে শক্তিগড়ে “ল্যাংচা” আর কৃষ্ণনগরে “শীতলপাটি” না কিনলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ।
থাকার বন্দোবস্ত—রাজকীয় থেকে সাধারণ
ক্যাটেগরি | নাম | মূল্য (প্রতি রাত) | বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|---|
বাজেট | Hotel Sagnik, Hotel Indrajit | ₹800–₹1,200 | সাধারণ রুম, লোকাল বাজারের কাছে |
মিড-রেঞ্জ | The Fame Hotel, Hotel Manjusha | ₹1,500–₹2,500 | এসি রুম, রেস্টুরেন্ট সুবিধা |
লাক্সারি | Bari Kothi Heritage Stay, Resort Sagnik Premium | ₹3,000+ | নবাবি রাজপ্রাসাদের ঘর, ঐতিহ্যবাহী সাজ |
দেখতেই হবে—মুর্শিদাবাদের রত্নভাণ্ডার
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ
নবাব নাজিম হামিদুল্লাহর তৈরি, ১৮৩৭ সালে নির্মিত। ১,০০০ দরজার মধ্যে ৯০০ সত্যি, ১০০ নকল—চোর ধরার নবাবি কৌশল। প্রবেশ ফি ₹50, সোমবার বন্ধ।নিজামত ইমামবাড়া
এশিয়ার অন্যতম বড় ইমামবাড়া। মহরমের সময় আলোর স্রোতে সাজে নবাবি আঙিনা।কাঠগোলা বাগানবাড়ি
জৈন ব্যবসায়ী ধনপতির প্রাসাদ, ভিতরে প্রাচীন আসবাব, সোনার কারুকাজ, আর সুবিশাল বাগান।ওয়াসিফ মঞ্জিল
ইউরোপীয় শৈলীর স্থাপত্য, ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ স্থান।
কাশিমবাজার রাজবাড়ি
জমিদারদের ঐতিহ্যের স্মারক, যেখান থেকে ইংরেজদের রাজনৈতিক চাল শুরু।কুটিবাড়ি
রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্মকালীন আশ্রয়। এখানেই সৃষ্টি হয়েছিল বহু অমর কবিতা ও গান।জাহানকোষ কামান
৭ টন ওজনের লৌহদানব, যুদ্ধক্ষেত্রের এক ঐতিহাসিক স্মৃতি।
গঙ্গার ঘাট
আজিমগঞ্জ, করিমপুরের ঘাটে সূর্যাস্তের দৃশ্য হৃদয়ে দাগ কাটবে।
খাওয়া-দাওয়া—রসনাতৃপ্তির নবাবি ডাক
সকাল: গরম লুচি, আলুর দম, জিলিপি (₹40–₹50)।
দুপুর: দেশি মুরগির ঝোল বা শুক্তো-ভাত (Hotel Sunshine বা Nabab’s Kitchen) — ₹150–₹300।
বিকেল: চায়ের কাপে গঙ্গার ধারে আড্ডা, সঙ্গে সিঙাড়া।
রাত: পাবদা বা চিংড়ি মাছের ঝোল — ₹200–₹400।
বিশেষ মিষ্টি: ছানার পোলাও, চানার পায়েস, তালের বড়া—মুর্শিদাবাদের মিষ্টির দোকানে অবশ্যই ট্রাই করতে হবে।
৩ দিনের প্রস্তাবিত ভ্রমণসূচি
দিন ১:
সকাল: কলকাতা → বহরমপুর পৌঁছানো
দুপুর: হাজারদুয়ারি, ইমামবাড়া, ওয়াসিফ মঞ্জিল
সন্ধ্যা: গঙ্গার ধারে সূর্যাস্ত
রাত: স্থানীয় রেস্তোরাঁয় নবাবি ডিনার
দিন ২:
সকাল: কাঠগোলা বাগানবাড়ি, জাহানকোষ কামান
দুপুর: কাশিমবাজার রাজবাড়ি
বিকেল: কুটিবাড়ি ও স্থানীয় হস্তশিল্প বাজার
রাত: মিষ্টির দোকানে শেষ স্টপেজ
দিন ৩:
- দুপুর: স্থানীয় খাবারের স্বাদ
বিকেল: ফেরার পথে কৃষ্ণনগরে কেনাকাটা
বাজেটের হিসাব (প্রতি ব্যক্তি, ৩ দিন)
খরচের খাত | পরিমাণ |
---|---|
যাতায়াত | ₹500–₹1,000 |
থাকা | ₹2,400–₹6,000 |
খাওয়া | ₹1,200–₹2,000 |
প্রবেশ ফি ও লোকাল ট্রান্সপোর্ট | ₹700–₹1,000 |
মোট | ₹4,800–₹10,000 |
যদি রাজা হওয়ার স্বপ্ন থাকে, তবে এখানে এসে একদিনের জন্য হলেও সেই স্বপ্নে ডুবে যান। হয়তো গঙ্গার হাওয়ায় উড়ে আসা কোনো পুরনো গান আপনাকে বলবে—
“আমাদের গল্প শেষ হয়নি, আমরা এখনো বেঁচে আছি, তোমার ক্যামেরায়, তোমার চোখে, আর তোমার হৃদয়ে।”
মুর্শিদাবাদে ভ্রমণ মানে শুধু কয়েকটি পর্যটনস্থল ঘুরে দেখা নয়, বরং বাংলার ইতিহাসের গভীরে ডুব দেওয়া। নবাবি আভিজাত্য, নদীর শান্ত স্রোত, প্রাচীন স্থাপত্যের সৌন্দর্য এবং রসনাতৃপ্তির স্বাদ—সব মিলিয়ে মুর্শিদাবাদ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এখানে আসলে সময় যেন থমকে দাঁড়ায়, আর অতীতের গল্পগুলো আপনার চারপাশে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাই ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে, ইতিহাস ও সংস্কৃতির এই অনন্য মেলবন্ধন অনুভব করতে, মুর্শিদাবাদে একবার অবশ্যই ঘুরে আসা উচিত।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো