কলকাতা ক্যাম্পাস ধর্ষণকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্রর এক দশকের অপরাধপথ ফাঁস

কলকাতার নামী আইন কলেজে ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্রর সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার এক চাঞ্চল্যকর মোড় নিয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, ২০০৭ সাল থেকে কলেজ-চত্বরেই অপরাধের ছক কষতেন তিনি। ছুরিকাঘাত, শ্লীলতাহানি, মারধর, হুমকি থেকে শুরু করে পুলিশ ভ্যান ভাঙচুর—সবই আছে তার নামে একাধিক থানায়। চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে কলেজে ফেরার পরও রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। রাজনৈতিক ছায়া, প্রশাসনিক নীরবতা ও দীর্ঘদিনের অভিযোগ-উপেক্ষাই কি তাকে ‘অপার্থিব’ করেছে? এখন নজর—এই অপরাধচক্রের শেষ কোথায়।

🟥 STORY HIGHLIGHTS

▪ দীর্ঘদিন ধরেই একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্র
▪ কলেজ ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অভিযোগ
▪ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক
▪ ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকমহল
▪ ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগের পেছনে একের পর এক ঘটনা প্রকাশ্যে

কলকাতার আইন কলেজ চত্বরে সংঘটিত নারকীয় ধর্ষণকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত মনোজিত মিশ্রের সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারি যেন উন্মোচন করল এক গোপনচর্চিত অধ্যায়—যেখানে ব্যক্তিগত দম্ভ, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া আর প্রশাসনিক উদাসীনতা মিলে এক অপ্রীতিকর বাস্তবকে জন্ম দিয়েছে। একাধিক মামলার পাহাড় থাকা সত্ত্বেও, কলেজের অলিন্দে নির্বিঘ্নে বিচরণকারী এই ব্যক্তি কীভাবে এত বছর ধরেই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, তা নিয়ে উঠেছে একের পর এক প্রশ্ন।

২০০৭ সালে কলেজে প্রথম পা রাখেন মিশ্র। তখন থেকেই আচরণে ছিলেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কর্তৃপক্ষের চোখে পড়লেও, কোনও বড় শাস্তির মুখোমুখি হননি। সময় গড়াতেই যেন আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ২০১৩ সালে এক ক্যাটারিং কর্মীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা গড়ায় ছুরিকাঘাতে—যার জেরে কালিঘাট থানায় তার বিরুদ্ধে হত্যা প্রচেষ্টার মামলা রুজু হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় তার নামে মামলার মিছিল।

২০১৭ সালে, নতুন নামে পুরনো ছায়া নিয়ে ফের হাজির মিশ্র। ওই বছর নভেম্বরে কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল, প্রয়াত দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় কলেজ সম্পত্তি ভাঙচুরের অভিযোগে লিখিতভাবে জানিয়ে ছিলেন, “কলেজ ফি বৃদ্ধি নিয়ে চলা আন্দোলনের আড়ালে ছিল ইচ্ছাকৃত ধ্বংস ও উস্কানি।”

এক প্রাক্তন ছাত্রী বলেন,
“সে নিজেকে ‘পেশাদার অপরাধী’ বলে গর্ব করে দাবি করত। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুটি মামলা করেছিলাম, কিন্তু কোনওটিতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।”
তিনি আরও জানান, বহুবার পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও কার্যকর পদক্ষেপ পাননি।

অন্যদিকে, পুলিশ প্রশাসনের তরফে এক সিনিয়র কর্মকর্তা মন্তব্য করেন,
“অনেক অভিযোগ তদন্তে ‘অসার’ বা ‘অ-গম্ভীর’ বলে প্রতিভাত হয়েছে। কিছু ঘটনা কলেজের ছাত্র রাজনীতির অংশ বলেই প্রতীয়মান হয়।”
তবে তার এই ব্যাখ্যা যথেষ্ট বলে মানতে রাজি নন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহল।

২০২২ সালে কলেজ থেকে পাশ করার পরেও কীভাবে তিনি আবার ২০২৩ সালে কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত হন, তা নিয়েও উঠেছে তীব্র বিতর্ক। যদিও কলেজের উপ-প্রধান অধ্যাপক নায়না চ্যাটার্জি জানান,
“তার আচরণ নিয়ে কিছুটা জানা ছিল, কিন্তু বিস্তারিতভাবে নয়। নিয়োগের সিদ্ধান্ত ছিল পরিচালন সমিতির সম্মিলিত মতামতের ফসল।”

এই সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক অশোক দেব স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
“আমি কোনওভাবে মনোজিত মিশ্রের নিয়োগে সুপারিশ করিনি। বর্তমানে কলেজ তার আইনজীবীর লাইসেন্স বাতিলের জন্য বার কাউন্সিলে আবেদন জানাবে।”

তবে, শুধুই মৌখিক দায় ঝেড়ে ফেলার মতো নয় বর্তমান পরিস্থিতি। কারণ ২০২৩ সালে কাসবা থানায় এক ব্যক্তির অভিযোগ, মিশ্র তাকে স্টিলের ‘কড়া’ দিয়ে আঘাত করে ও মারধর করে। অভিযোগকারীর কথায়,
“আমি ও আমার সিনিয়র আক্রান্ত হই এবং সেই সময় আমাদের উদ্দেশ্যে কুরুচিকর ভাষা ব্যবহার ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়।”
এই মামলাতেও চার্জশিট দাখিল হলেও, অভিযুক্ত ছিল জামিনে মুক্ত।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে আবারও কাসবা থানার নজরে আসেন মিশ্র। পুলিশ ভ্যান ভাঙচুর ও আধিকারিকদের উপর হামলার অভিযোগে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সেপ্টেম্বর ২০২৪, টালিগঞ্জ থানায় FIR নং ১৩৯-এ আইন কলেজের ছাত্র আশিক ইকবাল অভিযোগ করেন,
“মিশ্র ও তার দল আমাকে ইট ও পাথর দিয়ে আক্রমণ করে, কপালে গভীর আঘাত লাগে। আমরা চাইছিলাম কলেজে এক্স-স্টুডেন্টদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ করা হোক।”

পূর্বের আরও একটি নজির—২০১৯ সালে গড়িয়াহাট থানায় মামলা দায়ের করা হয় এক ছাত্রীর তরফে, যাকে মিশ্র মারধর ও শ্লীলতাহানি করেন বলে অভিযোগ। একই বছর আনন্দপুর থানায় এক ব্যবসায়ীর অভিযোগ,
“আমার ছেলের সঙ্গে কলেজে বিবাদের জেরে মিশ্র আমাদের দোকানে এসে গালিগালাজ ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়।”

এই সবকিছুই স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, মিশ্র কেবলমাত্র একজন অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি নন, বরং কলেজ রাজনীতির ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা এক প্রতীকি চরিত্র, যিনি প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা আর রাজনৈতিক আশ্রয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদে ছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ (প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১০ অনুযায়ী, কলেজ পরিচালন সমিতির ১০ সদস্যের মধ্যে ৪ জন মনোনীত হন সরকার দ্বারা, যার প্রধান স্থানীয় বিধায়ক। আইন কলেজের পরিচালন পর্ষদের মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হয়ে গেলেও এখনো তা বর্ধিত অবস্থায় চলছে।

এই পরিস্থিতিতে, সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে ভয় ও সন্দেহের ছায়া পড়েছে—এবং তারা চাইছেন, এবার যেন আইনের কঠোরতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়, যাতে আর কোনও মনোজিত মিশ্র ভবিষ্যতে জন্ম না নেয়।

আইন কলেজ ধর্ষণ মামলার প্রেক্ষিতে মনোজিত মিশ্রর নামে থাকা একাধিক পুরনো অভিযোগ ও মামলা নতুন করে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বারবার আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা এই অভিযুক্ত কেবল একটি ব্যক্তিগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি নয়—বরং এটি এক বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানগত উদাসীনতার উদ্বেগজনক নিদর্শন। এখন প্রশ্ন একটাই—এই মামলা কি প্রশাসনিক শুদ্ধির সূচনা করবে, নাকি ফের হারিয়ে যাবে আরও এক শিরোনামে?

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply