কলকাতার আবাসন ব্যবস্থাকে ঘিরে ফের উঠছে প্রশ্ন। চন্দন মিশ্র খুনে অভিযুক্তদের গ্রেফতারির পর গেস্ট হাউস ও বৃহৎ আবাসনগুলির ভাড়াটে যাচাই প্রক্রিয়া উঠে এসেছে তদন্তের কেন্দ্রে। আনন্দপুরের একটি গেস্ট হাউসে নথি যাচাই ছাড়াই ঘর ভাড়া দেওয়া এবং নিউ টাউনের সুখোবৃষ্টি আবাসনে অপরাধীর গোপন আশ্রয়ের অভিযোগে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ প্রশাসন। গাফিলতি, সাবলেটিং এবং মালিক অনুপস্থিতির ফাঁকে অপরাধীরা আশ্রয় নিচ্ছে— এমন আশঙ্কাই বাড়ছে। এই পরিস্থিতি ভাড়াবাড়ি সংস্কৃতির ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, আর সেই আলোড়নেই আজ প্রশ্ন— আশ্রয় নাকি আশঙ্কা?
📌 স্টোরি হাইলাইটস
আনন্দপুর গেস্ট হাউস থেকে গ্রেফতার পাঁচ অভিযুক্ত
কাগজ যাচাই না হওয়ায় গেস্ট হাউসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ
ফের বিতর্কের কেন্দ্রে নিউ টাউনের সুখোবৃষ্টি আবাসন
২০২১ সালে একই প্রকল্পে গ্যাংস্টার এনকাউন্টার
সাবলেটিং ও মালিক অনুপস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা
৯৪ জন বাড়িওয়ালাকে শোকজ পাঠাল বিধাননগর পুলিশ
আনন্দপুর থেকে নিউ টাউন: ভাড়াটে ভেরিফিকেশন ফাঁকেই গ্যাংস্টার আশ্রয়? পুলিশের কড়া নজরে গেস্ট হাউস ও আবাসন সংলগ্ন নিরাপত্তা
পটনার কুখ্যাত গ্যাংস্টার চন্দন মিশ্র খুনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সুরক্ষাবলয় ঘিরে নতুন করে উঠেছে প্রশ্ন। ঘটনার মূল অভিযুক্তসহ পাঁচজনের গ্রেফতারি যে শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং ভাড়াবাড়ি ও গেস্ট হাউসগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা একাধিক ফাঁকফোকরের বহিঃপ্রকাশ— সে কথাই যেন আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
শনিবার রাতে আনন্দপুর থানার অদূরে মাডুরডাহার এক গেস্ট হাউসে হানা দেয় রাজ্য পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স। অভিযানের শেষে ধরা পড়ে পাঁচজন, যাদের নাম রয়েছে চন্দন মিশ্র হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটে। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে কড়া নজরদারিতে উঠে আসে গেস্ট হাউসের ভাড়াটে যাচাই পদ্ধতি ও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার গাফিলতি। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, “তিনজনের পরিচয়পত্র সঠিকভাবে যাচাই করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই গেস্ট হাউস কর্তৃপক্ষ সরকারি নির্দেশ অমান্য করেছে।” এই অভিযোগের ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৩৩(বি) ধারায় মামলা রুজু হয়।
অন্যদিকে, গেস্ট হাউসের মালিক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “সব অতিথিই বৈধ পরিচয়পত্র দেখিয়েই ঘর নিয়েছিলেন। পুলিশের তল্লাশির আগে পর্যন্ত কোনো অসঙ্গতি ছিল না।”
গেস্ট হাউসের গণ্ডি পেরিয়ে নজরে আসে নিউ টাউনের সুবিশাল আবাসন প্রকল্প ‘সুখোবৃষ্টি’। ১৫০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই আবাসনটি যেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর— যেখানে রয়েছে প্রায় ২০,০০০ ফ্ল্যাট, ৩৫০টিরও বেশি টাওয়ার এবং হাজারো মানুষের বসবাস।
চন্দন মিশ্র হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুলিশ ১৯ জুলাই সুখোবৃষ্টির দুইটি ভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেই সূত্রেই ফের প্রশ্ন ওঠে, নিরাপত্তা ও যাচাই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর?
এই প্রথম নয়। ২০২১ সালের ৯ জুন সুখোবৃষ্টির ১৫৩ নম্বর ব্লকের ২০১ নম্বর ফ্ল্যাটে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পাঞ্জাবের দুই কুখ্যাত গ্যাংস্টার— জয়পাল ভুল্লার ও জসপ্রীত ওরফে জাসসি খারার। সেই ঘটনার পর রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে চালু করা হয় “পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট” প্রথা, যেখানে কোনও ভাড়াটেকে ঘর দেওয়ার আগে থানার কাছ থেকে তার ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক।
তবুও বাস্তবচিত্র বলছে, প্রয়োগে রয়েছে বড় ঘাটতি। পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন,
“এটা সত্যি, এখানে অনেকেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন, যাঁদের মধ্যে অনেকে আবার বাইরের রাজ্য যেমন বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা। ভাড়াটের নামে চুক্তি থাকলেও, তার সঙ্গে থাকা বা মাঝেমধ্যে আসা বন্ধুবান্ধবদের অতীত খতিয়ে দেখা একেবারেই সম্ভব হয় না।”
এই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত তৌশীফ এবং তার সহযোগীদের আশ্রয় দিয়েছিল এহসান নামে এক ব্যক্তি— যার বিরুদ্ধে কোনও পূর্ব অপরাধমূলক রেকর্ড ছিল না। পুলিশ জানায়, পটনার সাহিল তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কলকাতায় তৌশীফদের গ্রহণ করতে বলে।
এসটিএফ-এর এক অফিসার বলেন,
“এটি একটি বড় আবাসন। এত মানুষের মধ্যে কে কোথা থেকে এল, সেটি খুঁজে বের করাও একটা চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া, অধিকাংশ ফ্ল্যাটের মালিকই নিজেরা থাকেন না, ফলে নজরদারির অভাব থেকেই যায়।”
একসময়ে একটি “ম্যাসিভ ড্রাইভ” চালিয়ে আবাসনের সমস্ত ভাড়াটের ভেরিফিকেশন করা হয়েছিল। কিন্তু এখনকার চিত্র অন্যরকম। বিধাননগর পুলিশের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন,
“শতভাগ যাচাই কখনোই সম্ভব নয়। এজন্য শুধু পুলিশের নয়, বাড়িওয়ালা ও আবাসিকদের সচেতন হওয়াটাও জরুরি।”
বিধাননগর পুলিশ সম্প্রতি ৯৪ জন বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ পাঠিয়েছে— অভিযোগ, তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই না করেই ভাড়া দিয়েছেন তাঁদের সম্পত্তি।
এই সমস্ত ঘটনা আরও একবার সামনে এনেছে একটি পুরোনো অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— শহরের আবাসন ও ভাড়াবাড়ি ব্যবস্থাপনায় নজরদারির ঘাটতি কি অপরাধীদের আশ্রয়ের পথ তৈরি করছে? এখন সময় এসেছে, যখন শুধু প্রশাসন নয়, নাগরিক সচেতনতাই হতে পারে এই ফাঁকফোকর বন্ধ করার প্রধান চাবিকাঠি।
চন্দন মিশ্র হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতারদের ঘিরে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা কলকাতার গেস্ট হাউস ও আবাসনগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীর ফাঁকফোকরকেই সামনে এনেছে। ভাড়াটে যাচাই প্রক্রিয়ার গাফিলতি, মালিকদের অনুপস্থিতি এবং সাবলেটিং-এর অপব্যবহার— সব মিলিয়ে শহরের ভাড়াবাড়ির কাঠামো যে অপরাধীদের গোপন আশ্রয়স্থলে পরিণত হতে পারে, তা ফের প্রমাণিত। শুধুমাত্র আইন বলবৎ করলেই এই সমস্যা সমাধান হবে না; প্রয়োজন বাড়িওয়ালা ও আবাসিকদের সচেতনতা ও যৌথ দায়িত্ববোধ। নইলে এমন ঘটনাগুলি থেকে শিক্ষা না নিয়ে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো