“অভ্যস্ততা” – সমস্যা যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো এতটাই দীর্ঘদিন ধরে ভেঙে পড়ছে যে, একে ঘিরে যে অসন্তোষ জন্ম নেওয়ার কথা ছিল, তা কার্যত লোপ পেয়েছে। এক ধরনের সামাজিক ‘সহনশীলতা’ তৈরি হয়েছে, যাকে বলা যায় ‘অভ্যস্ততার সংস্কৃতি’। এই অংশে আমরা খুঁজে দেখব, কীভাবে এই অভ্যস্ততা কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ক্রমশ নিস্তব্ধ করে তুলেছে।
🟩 বারবারের অভিজ্ঞতায় তৈরি হয়েছে মানসিক প্রতিরোধক্ষমতা
বছর পর বছর কলকাতার রাস্তা ভাঙা, জল জমার সমস্যা দেখা গেছে—তবে সমস্যা নিরসনে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আসেনি।
ফলে কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিকরা মনে মনে ভাবতে শুরু করেছেন, “এটাই স্বাভাবিক”।
এটি এক ধরনের শহুরে মানসিকতা তৈরি করেছে, যেখানে অচল পরিকাঠামোই হয়ে উঠেছে ‘নতুন নিয়ম’।
🟩 মিডিয়া ক্লান্তি ও সমস্যার প্রতি অসাড়তা
নাগরিক সমস্যা কলকাতা শহরে সংবাদমাধ্যমে যতবার এসেছে, ততবারই তা আর্থ-রাজনৈতিক নাটকের নিচে চাপা পড়েছে।
ফলে বারবার দেখা গেছে—একদিন কাদামাখা রাস্তাঘাট মিডিয়ায় হেডলাইন হলেও, পরদিনই তা বিস্মৃতির অতলে।
এই মিডিয়া ‘ডিসকাউন্টিং’ কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংসের চিত্রকে অস্পষ্ট করে তোলে।
🟩 কার্যকর গণচাপের অনুপস্থিতি
কলকাতা পুরসভা ও অন্যান্য প্রশাসনিক দপ্তরের উপর কোনো সুসংগঠিত গণচাপ নেই।
মানুষ জানে অভিযোগ করলে তাতেও কিছুই হবে না।
ফলে কলকাতার নাগরিক সমস্যা এখন একপ্রকার ‘অদৃশ্য শত্রু’ — যার বিরুদ্ধে লড়াই না করাই শ্রেয় মনে করেন বহু কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক।
🟩 প্রজন্মের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে সংকোচ
বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এক ধরনের সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা।
পূর্ববর্তী প্রজন্ম যেমন নিজেদের পরিবার, কাজ ও জীবিকার বাইরে সমস্যাকে দেখেও দেখেননি, তেমনই এই অভ্যস্ততা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে।
এর ফলাফল—কলকাতার পরিকাঠামোগত অবনতি আর কাউকে বিশেষভাবে নাড়া দেয় না।
🟩 ভাষার অভাব ও সচেতনতার ঘাটতি
অনেকেই নাগরিক পরিষেবা সংকট নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেও, কোথায়, কিভাবে, এবং কার কাছে অভিযোগ জানাতে হবে—তা জানেন না।
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো নিয়ে প্রতিবাদ, স্মারকলিপি বা আইনি পদক্ষেপের প্রচলন নেই বললেই চলে।
এই অনভ্যস্ততা বা “নাগরিক চর্চার” অভাবই কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আরও নীরব করে তুলেছে।
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো নিয়ে প্রতিনিয়ত অভিযোগ উঠলেও, তা নিয়ে সংগঠিত প্রতিবাদ কিংবা বাস্তব চাপে রূপান্তর হচ্ছে না। কারণ, এই অভ্যস্ততা আমাদের নিত্যদিনের চেতনায় এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে এখন কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণি সব জেনেও ‘কিছু হবে না’ বলেই ধরে নিচ্ছেন। এই মনোভাবই এখন শহরের সবচেয়ে বড় বিপদ।
মধ্যবিত্তের নিরাপত্তা ভাবনা – ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো
কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক বৃহৎ অংশের মধ্যে বর্তমানে যে মানসিকতা গভীরভাবে কাজ করছে, তা হল: “নিজের কাজ করো, ঝামেলায় জড়িও না”। এই মনোভাব শুধু ব্যক্তিগত বাঁচার কৌশল নয়, বরং একটি সামাজিক নীরবতা তৈরির অন্যতম কারণ—যার ফলে কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো দিন দিন ভেঙে পড়লেও প্রতিবাদ নেই।
🟩 ঝামেলা এড়ানোর মানসিকতা – একপ্রকার সামাজিক আত্মরক্ষা পদ্ধতি
বহু কলকাতার মধ্যবিত্ত মানুষ মনে করেন, প্রতিবাদ করলে হয়রানি বাড়বে।
রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক স্তরে বারবার দেখা গেছে, অভিযোগকারী নাগরিককে “বিপদজনক” বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়।
ফলে মানুষ চুপ থাকাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেন।
এই প্রবণতা স্পষ্টভাবে কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস ও সামাজিক নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেছে।
🟩 প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আশঙ্কা
কলকাতা পুরসভা কিংবা অন্যান্য দপ্তরে অভিযোগ জানালে হয়রানি, ফোনে তদবির, এমনকি রাজনৈতিক চাপের মুখোমুখি হতে হতে পারে—এই আশঙ্কা এক বাস্তব চিত্র।
অনেকেই বলছেন, “সরকারি কাজ মানেই ঝামেলা”, আর সেই ঝামেলায় না পড়ার জন্যই অনেকে সমস্যা জেনেও কিছু বলেন না।
এই মনোভাব নাগরিক গণতন্ত্রের ক্ষয় ও কলকাতার নাগরিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার অবসান ঘটাচ্ছে।
🟩 সামাজিক মর্যাদার চিন্তা – ‘ছবি নষ্ট’ হোক না
কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজে এখনও একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে—সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে বা প্রতিবাদে সামিল হলে তা সামাজিকভাবে ‘অশোভন’।
“পরিবারের সম্মান”, “পাড়ার মুখ”, “চাকরির নিরাপত্তা”—এসব কিছু বজায় রাখতেই অনেকেই সমস্যার মুখে মুখ বন্ধ রাখেন।
এই সামাজিক সংবরণ ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে নীরবতা এবং অসচেতনতার সংস্কৃতিতে।
🟩 তথ্যপ্রযুক্তি যুগে ‘ডিজিটাল প্রতিবাদ’ই যথেষ্ট মনে করা
আজকের কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে সমস্যার ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে দায়িত্ব শেষ করেন।
মাঠে নামা, স্মারকলিপি দেওয়া বা আইনি পথ অবলম্বন করার ঝুঁকি কেউই নিতে চান না।
ফলে এই ডিজিটাল অসন্তোষ বাস্তবের মাটিতে প্রতিফলিত হয় না, কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো তাতে বদলায় না।
🟩 রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার ভ্রান্ত ধারণা
‘রাজনীতি থেকে দূরে থাকা’কে এখন অনেকেই গৌরবের বিষয় মনে করেন।
অথচ বাস্তবে এই নিরপেক্ষতা আসলে নাগরিক দায়িত্ব থেকে পলায়ন।
কলকাতার নাগরিক সমস্যা রাজনীতির বাইরে নয়, বরং এর মূল উৎস প্রশাসনিক গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা।
কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অনেক কলকাতার মধ্যবিত্ত এখন প্রশ্ন করতেই ভয় পান।
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে চলেছে শুধু প্রশাসনের গাফিলতিতে নয়, বরং কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির ‘নীরব নিরাপত্তা চর্চা’ এই পতনকে মসৃণ করেছে। প্রতিবাদ নয়, পরোক্ষে সমঝোতা চলছে। তাই প্রশ্ন উঠছে—নাগরিক দায়িত্ব পালন না করে শুধু ‘সেফ জোনে’ থাকলে শহরকে সত্যিই বাঁচানো যায় কি?
নাগরিক উদ্যোগের অভাব: নীরবতার নকশা, অবহেলার অনুমতি
🟩 স্থানীয় সংগঠনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া
এক সময়ে বিভিন্ন ওয়ার্ড বা পাড়াভিত্তিক নাগরিক সংগঠন অত্যন্ত সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে তারা প্রায় অকার্যকর।
পাড়ার ক্লাবগুলি এখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বাইরে সচেতনতামূলক বা পরিকাঠামোগত আন্দোলনে অংশ নেয় না।
এই শূন্যতায় কলকাতার নাগরিক সমস্যা দিনের পর দিন জমা হচ্ছে, কিন্তু কোনও সমন্বিত ‘লোকাল প্রেসার গ্রুপ’ তৈরি হচ্ছে না।
🔍 তথ্য: ২০১৮-২৪ সালের মধ্যে পুরসভায় রেকর্ডকৃত ৬৫% নাগরিক অভিযোগ ব্যক্তিগতভাবে, কোনও সংগঠনের মাধ্যমে নয়, জমা পড়েছে—যার অধিকাংশই নিষ্পত্তিহীন।
🟩 নাগরিক শিক্ষার অভাব – অধিকার না জানা, দায়িত্ব না নেওয়া
অনেক কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিকই জানেন না তাঁরা কোন সমস্যার জন্য কোথায় অভিযোগ করবেন বা আইন কী বলে।
“এটা তো পুরসভার কাজ”—এই বাক্য দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করলেও, এটাই কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস হওয়ার মূল চালিকা শক্তিগুলোর একটি।
নাগরিক সচেতনতা কর্মসূচি প্রায় নেই বললেই চলে, যার ফলে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার চেতনা গড়ে ওঠে না।
📌 প্রাসঙ্গিক তথ্য: কলকাতা পুরনিগমের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৪টি অভিযোগ জমা পড়ে, যেখানে প্রতি ওয়ার্ডে গড়ে ৩০০টির বেশি সমস্যা চিহ্নিত হয়।
🟩 আত্মনির্ভরতার ভ্রান্ত ধারনা – নিজে সামলে নেওয়াই যেন শ্রেষ্ঠত্ব
অনেক কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবার রাস্তা ভাঙলে নিজের গাড়ির চাকা সামলে নেয়, গর্তে ইট ফেলে দিয়ে চলে যায়—কিন্তু কারও জানায় না।
বাড়ির সামনে নর্দমা বন্ধ থাকলে নিজেই পরিষ্কার করে ফেলে, কিন্তু বৃহত্তর পরিকাঠামোগত সংস্কারের দাবি তোলে না।
এভাবে কলকাতার নাগরিক সমস্যা ছোট ছোট “ব্যক্তিগত সমাধানে” ঢাকা পড়ে, সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যর্থ হয়।
🧠 বিশ্লেষণ: এই ‘নিজেরটা বাঁচালেই চলবে’ মনোভাবই নাগরিক উদ্যোগের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ।
🟩 ‘কারও না কারও ঠিক করে দেবে’ – দায়িত্ব হস্তান্তরের সংস্কৃতি
একটি চমকপ্রদ মনোভাব লক্ষ্য করা যায়—“আমরা করলাম না তো কী, কেউ না কেউ তো করবে।”
এই নির্ভরতা একদিকে যেমন প্রশাসনের দায় চাপায়, অন্যদিকে নাগরিক উদ্যোগকে নিষ্ক্রিয় করে তোলে।
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস রোধ করতে নাগরিক সজাগ থাকা আবশ্যক, অথচ ‘দেখে নেব’ বা ‘সময় কোথায়’—এই যুক্তিতে সবকিছু পিছিয়ে পড়ছে।
📎 উদাহরণ: দক্ষিণ কলকাতার একটি অভিজাত এলাকায় দীর্ঘদিন পানীয় জল সমস্যার পরেও মাত্র ৩২টি স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি জমা পড়ে, যেখানে বসবাসকারীর সংখ্যা ২০০০-র বেশি।
🟩 মধ্যবিত্তের ‘সহনক্ষমতা’র সীমাহীনতা – ক্লান্তি না প্রতিবাদ
কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণি দীর্ঘসময় ধরে নানা অসুবিধা সহ্য করতে অভ্যস্ত।
বাসে ঠাসাঠাসি, জল জমে থাকা রাস্তায় হাঁটা, বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট—সব কিছুকেই “যা হয় হচ্ছে” বলে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
এর ফলস্বরূপ, কলকাতার নাগরিক সমস্যা শুধু বেড়েই চলেছে, তার সঙ্গে বেড়েছে গা-সহা মনোভাব।
💡 তথ্যসূত্র: ২০২3 সালে কর্পোরেশন এলাকায় বৃষ্টিজনিত জল জমার কারণে ৮৩% মানুষ কাজ বা স্কুল মিস করলেও মাত্র ৯% নাগরিক অভিযোগ করেছেন।
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, নাগরিক উদ্যোগের অভাবও এই পতনের এক প্রকার ইন্ধন। আর এই উদাসীনতার কেন্দ্রে রয়েছে কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির ‘চুপ করে থাকার সংস্কৃতি’, ‘নিজেরটা দেখো’ মনোভাব, ও সচেতনতার অভাব। প্রশ্ন উঠছে—এই নীরবতাই কি আগামী দিনের শহর বিপর্যয়ের ভিত্তিপ্রস্তর?
ডিজিটাল প্রতিক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ ক্ষোভ: ‘রাগ আছে, কিন্তু রাস্তায় নামার ইচ্ছে নেই’
🟩 সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ—শব্দ আছে, পদক্ষেপ নেই
অনেক কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক ফেসবুক, টুইটার বা হোয়াটসঅ্যাপে কলকাতার নাগরিক সমস্যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
পোস্ট, স্ট্যাটাস, রিলস—এইসব ডিজিটাল মাধ্যম হয়ে উঠেছে অভিযোগ জানানোর আধুনিক মঞ্চ।
🎯 তথ্য: ২০২৪ সালে #DrainageIssueKolkata হ্যাশট্যাগে ৪৭,০০০ পোস্ট হয়েছে, অথচ পুরসভায় জমা পড়েছে মাত্র ৬৫০টি লিখিত অভিযোগ।
❝একটি সেলফি সহ বৃষ্টির জলে ভেজা পা যেন প্রতিবাদের সমাপ্তি বিন্দু❞ — এটিই হয়ে উঠেছে শহরের নতুন বাস্তবতা।
🟩 ডিজিটাল ক্লান্তি – সক্রিয়তা বনাম স্ক্রোলিং
দৈনিক অনলাইন ক্ষোভ প্রকাশের ফলে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমে যাচ্ছে।
নাগরিকদের মধ্যে একটা আত্মপ্রসাদ কাজ করে: “আমি তো বলেছি, বাকিরা কিছু করুক।”
ফলে, কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস থামানোর জন্য যে বাস্তব উদ্যোগ দরকার, তা ডিজিটাল দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালে হারিয়ে যায়।
📱 মনস্তাত্ত্বিক দিক: একে বলে “slacktivism”—কীবোর্ডে চাপ প্রয়োগ করে দায় মুক্তির সুখ অনুভব।
🟩 ডিজিটাল মঞ্চে প্রতিবাদ – বাস্তব জবাবদিহির অভাব
অনেকসময় ডিজিটাল প্রতিবাদ মূল সমস্যার ধারেকাছেও পৌঁছায় না।
কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশই প্রশাসনের অফিসিয়াল চ্যানেলে ফিডব্যাক না দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রোফাইলেই ক্ষোভ জমায়।
এতে সিস্টেম না সচেতন হয়, না চাপে পড়ে।
🧩 তথ্যসূত্র: KMC-র অভিযোগ গ্রহণ পোর্টালে ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে ৭৫% আসছে বয়স্ক নাগরিকদের থেকে।
🟩 অনলাইন পিটিশন কালচার—‘পরিবর্তনের অভিনয়’
Change.org বা অন্যান্য পিটিশন প্ল্যাটফর্মে কলকাতার নাগরিক সমস্যা নিয়ে প্রচুর ক্যাম্পেইন শুরু হয়।
কিন্তু স্বাক্ষর সংগ্রহে সীমাবদ্ধ থেকে যায় কার্যকরী চাপ প্রয়োগ।
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস রোধে যে ধরনের সংঘবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন, সেখানে এই পিটিশন কালচার কার্যত ভোঁতা অস্ত্র।
📌 উদাহরণ: দক্ষিণ কলকাতায় একটি পার্ক রক্ষণাবেক্ষণের দাবিতে চালু হওয়া পিটিশনে ৩,০০০ স্বাক্ষর মিললেও, মাঠ এখনও তালাবন্ধ।
🟩 ডিজিটাল মাধ্যমে রাগ শেয়ার—কিন্তু সমাধানের রূপরেখা নেই
ক্ষোভ প্রকাশের চেয়ে সমাধানের পরামর্শ দেওয়া আরও জরুরি।
কলকাতার মধ্যবিত্ত ক্ষোভ জানালেও কার্যকর পরামর্শ বা সমস্যার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা খুব কমই দেন।
তাই ডিজিটাল অসন্তোষ ‘শব্দবোমা’ হয়ে উঠলেও, তা কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস রোধে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
🎙️ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ: নাগরিক সাংবাদিকতা বা তথ্যভিত্তিক ব্লগিং, যা সমস্যার গভীর বিশ্লেষণ দেয়, তার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত।
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস নিয়ে কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিবাদ আজকাল ‘ডিজিটাল প্যাড’ এ সীমাবদ্ধ। বাস্তব রাস্তা আর অফিসে অভিযোগ জমা দেওয়া নয়, বরং স্ক্রিনে টাইপ করেই দায় সারা যেন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মনোভাবের ফলে প্রকৃত প্রশাসনিক জবাবদিহি তৈরি হচ্ছে না, ফলে সমস্যাগুলো বছরের পর বছর অক্ষত থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—একটি শেয়ার কি একটি অভিযোগের সমান? নাকি সেটা শুধু ভার্চুয়াল বায়ুপ্রবাহ?
ভবিষ্যতের প্রতি অনাস্থা – ‘কিচ্ছু হবে না’ মানসিকতা
🟥 বারবার প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতা: বিশ্বাস হারানোর গোড়া
কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস বারবার আলোচনার কেন্দ্রে এলেও বাস্তব কোনো পরিবর্তন হয়নি।
রাস্তা খোঁড়া, ড্রেনেজ সমস্যা, গরমে বিদ্যুৎ বিভ্রাট—এই চক্র বছরের পর বছর চলছে।
📌 উদাহরণ: দক্ষিণ কলকাতার গলিফাটা এলাকায় ২০১৬ থেকে ২০২4—প্রতি বছর জল জমে, অথচ দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা হয়নি।
“শুধু আশ্বাস, কাজ নেই”—এই বারবার প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতা কলকাতার মধ্যবিত্ত-এর মনে স্থায়ী ক্ষোভের জন্ম দিলেও তারা ক্রমেই সেই ক্ষোভ চাপা রাখতে শিখেছে।
🟥 প্রাত্যহিক সমস্যায় আত্মবিশ্বাসে ভাঙন
চাকরি, স্বাস্থ্য, পারিবারিক খরচ—এইসব সমস্যা নিয়েই কলকাতার মধ্যবিত্ত এতটাই ব্যস্ত যে কলকাতার নাগরিক সমস্যা নিয়ে ভাবার মতো মানসিক অবকাশ নেই।
দিনে দিনে গড়ে ওঠা ‘ব্যক্তিগত বেঁচে থাকা’র যুদ্ধেই তারা ক্লান্ত।
📉 মনোসমীক্ষা তথ্য (2023): কলকাতার ৭৩% মধ্যবিত্ত নাগরিক মনে করেন নাগরিক অভিযোগ করলেও “তার ফল হবে না।”
এই আত্মবিশ্বাসহীনতা একধরনের অসহায় ‘চুপচাপ মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি’ তৈরি করেছে।
🟥 প্রশাসনিক জবাবদিহির অভাব—‘উপরতলা কিছুই শুনবে না’
বহু কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস সংক্রান্ত অভিযোগ প্রশাসনের দরজায় ধাক্কা মারে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া প্রায় শূন্য।
দীর্ঘসূত্রতা, ফাইল ঘোরা, কাগজপত্রের চক্করে পড়ে বহু আবেদন থেমে যায়।
🗂️ প্রকৃত চিত্র: ২০২৪-এ KMC-তে জমা পড়া ৯,৪৫০টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র ১২% নিষ্পত্তি পেয়েছে ৩ মাসের মধ্যে।
একে বলে ‘সিস্টেমিক কোল্ড শোল্ডার’—যেখানে অভিযোগ জানানো মানেই তা অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া।
🟥 নাগরিক নেতৃত্বের অভাব—‘কে এগিয়ে যাবে?’
কলকাতার মধ্যবিত্ত-এর মধ্যে সংগঠিত প্রতিবাদের প্রবণতা একদম কমে গেছে।
পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব থাকলেও, নাগরিক সমস্যায় নেতৃত্ব দিতে চায় না কেউ।
📌 অবজার্ভেশন: অধিকাংশ নাগরিক মনে করেন—“এগিয়ে গেলে পরে আমাকেই ভোগান্তি পোহাতে হবে”।
এতে জন্ম নেয় এক ভয়ংকর নিষ্ক্রিয়তা—‘নেতা নেই, দল নেই, প্রতিবাদ নেই’।
🟥 ইতিহাসই শিখিয়েছে—কিছুই পাল্টায় না
অতীতে বহু আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। পরিবর্তনের আশায় লোকজন রাস্তায় নামলেও ফল মেলেনি।
এই অতীত অভিজ্ঞতা আজ কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস-এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আগ্রহকে খর্ব করেছে।
📖 ইতিহাসপঞ্জী: টালা ব্রিজ সংস্কারের দাবিতে ২০০৯ সালে স্থানীয়দের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। শেষে সেনা মোতায়েন না হলে কাজই শুরু হত না।
এইসব ঘটনা কলকাতার মধ্যবিত্ত-এর মনে স্থায়ী অনাস্থার ছাপ ফেলে গেছে—“শেষে কিছুই হবে না।”
আজ কলকাতার নাগরিক পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে পড়েছে স্পষ্ট বাস্তবতা। কিন্তু কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানসিক গঠনে এমন এক স্তর জন্ম নিয়েছে, যেখানে ‘ভবিষ্যত বদলানো সম্ভব’—এই ধারণাটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তারা ভাবে—”কিচ্ছু হবে না, তাই প্রতিবাদ করে লাভ নেই।” এই নির্ভার নিস্তব্ধতা-ই প্রশাসনের স্বস্তি ও পরিকাঠামোর মৃত্যু নিশ্চিত করে।