কলেজ চত্বর সাধারণত যেখানে শিক্ষার আলো ছড়ানোর কথা, সেখানে মাঝেমধ্যেই অন্ধকার কিছু গল্প উঠে আসে খবরের শিরোনামে। এমনই এক ঘটনা এবার সামনে এসেছে দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজ থেকে। অভিযোগ, কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই এক ছাত্রীর উপর ধর্ষণ করে কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও চুক্তিভিত্তিক কর্মী মনোজিৎ মিশ্র। এ ঘটনায় নাম জড়িয়েছে আরও দুই ছাত্রের—প্রমিত মুখার্জি ও জইব আহমেদের।
তদন্তকারী সংস্থার তরফে জানা গিয়েছে, ২৫ জুন ঘটনার পর মনোজিৎ কোনওরকম আতঙ্কে পালিয়ে বেড়ায়নি। বরং একের পর এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে নির্দ্বিধায় খাওয়াদাওয়া করেছে। এমন নির্ভরতা দেখে পুলিশ মনে করছে, অভিযুক্তের আত্মবিশ্বাস ছিল—ভুক্তভোগী পুলিশে যাবেন না।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে অভিযুক্তদের কল ডেটা রেকর্ড (CDR) সংগ্রহ করেছে। ৪ জুলাই কলেজ চত্বরে ঘটনার পুনর্গঠনও হয়েছে। সেই সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার সময় তিনজনেই কলেজের গার্ডরুমে ছিলেন। অভিযোগকারিণী জানিয়েছেন, গার্ডরুমের ভিতরে মনোজিৎ তাঁকে ধর্ষণ করে, আর বাকি দুই অভিযুক্ত বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।

এতকিছু ঘটে যাওয়ার পর অভিযুক্তরা নিজেদের গা ঢাকা দিতে যায়নি, বরং শহরের মধ্যেই থাকতেই পছন্দ করেছে। তদন্তকারীদের মতে, এটা ছিল এক প্রকার ‘প্রভাবশালী আত্মবিশ্বাস’, যার পেছনে থাকতে পারে রাজনৈতিক সংযোগ ও দীর্ঘদিনের দাদাগিরির সংস্কৃতি।
তদন্তের সূত্রে পুলিশ জানতে পেরেছে, ‘ম্যাঙ্গো’ নামে পরিচিত মনোজিৎ মিশ্র কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল। শুধু কলেজের ছাত্র রাজনীতি নয়, অভিযোগকারিণীর দাবি, কলেজের বহু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেও তার অঘোষিত হস্তক্ষেপ ছিল।
এই ঘটনার পরপরই মিশ্রের তৃণমূলের একাধিক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তোলা ছবি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যদিও TMCP সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে স্পষ্ট জানিয়েছেন, মিশ্র ছিলেন দলের দক্ষিণ কলকাতা ইউনিটের এক সাধারণ সংগঠনিক সম্পাদক, আর সেই সম্পর্কও ২০২২ সালে শেষ হয়ে গিয়েছে।
তবে শুধু বর্তমান ঘটনাই নয়, পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মনোজিৎ মিশ্রের নামে আগেও একাধিক অপরাধমূলক অভিযোগ ছিল। তদন্তে উঠে এসেছে অন্তত ১১টি পুরনো মামলা—যার মধ্যে আছে ভাঙচুর, মারধর, হুমকি, এমনকি কলেজ চত্বরে সহপাঠীদের উপর শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগও।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কলেজের অন্দরমহল থেকেও একের পর এক অস্বস্তিকর তথ্য উঠে আসছে। একাধিক অধ্যাপক বলেছেন, মিশ্র ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে কথা বললে তারা প্রতিশোধের আশঙ্কায় থাকতেন।
বিশেষ করে, বহু মহিলা ছাত্রী অভিযোগ করেছেন, কলেজের পরিবেশ দীর্ঘদিন ধরেই তাদের জন্য অনিরাপদ ছিল। এক তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী বলেন, “ক্লাস করতে আসতেও ভয় লাগত। যেকোনো কিছুতে বিরোধ করলেই মিশ্রের লোকজন হুমকি দিত—‘কলেজে থাকতে পারবি তো?’”
ছাত্রী আরও জানান, গত বছর গণেশ পুজোর সময় এক ছাত্র প্রতিবাদ করায় তাকে এমনভাবে মারধর করা হয় যে সে গুরুতরভাবে আহত হয়। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মিশ্রের উপস্থিতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেও শাস্তি পেতে হতো।

ছাত্ররাজনীতির অভাব এবার এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বহু কলেজেই দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না। এই শূন্যতায় সুযোগ নিচ্ছেন কিছু প্রভাবশালী ছাত্র, যাদের দমনমূলক আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীরা নিরুত্তর হয়ে পড়ছে।
কলেজের দেয়ালে এখনও লেখা—“মনোজিৎ দাদা আমাদের হৃদয়ে।” এই গ্রাফিতি যেন নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, কতটা গভীরে ছিল এই দাদাগিরির শেকড়।
অন্যদিকে, ৭ জুলাই কলকাতা পুলিশ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে সতর্ক করে দেয়—ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। ৪ জুলাই হাই কোর্টের নির্দেশও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে—ভুলভাবে কাউকে ভিকটিম হিসেবে দেখানো হলে জনমত বিভ্রান্ত হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মর্যাদাহানি হয়।
কলকাতা পুলিশের কমিশনার মনোজ কুমার বর্মা স্পষ্ট জানিয়েছেন, তদন্ত প্রক্রিয়া যতদিন না শেষ হচ্ছে, ততদিন পুলিশ তার সীমার মধ্যেই কথা বলবে। কোনও রকম অনুমানভিত্তিক বা যাচাই না-করা সংবাদ তদন্তকে বাধা দিতে পারে বলেও জানান তিনি।
বর্তমানে তিন অভিযুক্তই পুলিশি হেফাজতে আছে এবং আদালত তাদের ৮ জুলাই পর্যন্ত হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
যদিও আইন বলে যে প্রত্যেক অভিযুক্ত নিরপেক্ষ তদন্তের অধিকারী, তবে কলেজের অভ্যন্তরীণ এই দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার রাজনীতি ও নীরব সন্ত্রাস নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে—একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতটা নিরাপদ ছাত্রছাত্রীদের জন্য, যখন দাদাগিরির মুখোশে ঢাকা পড়ে ন্যায়বিচারের মুখ।