বলিউড চলচ্চিত্র ‘Kesari Chapter 2’ নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছে, এই ছবিতে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের গর্বিত ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। বিশেষত বিপ্লবী খুদিরাম বসু ও বারীন্দ্র কুমার ঘোষের পরিচয় ভুলভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ উঠেছে। ছবির প্রযোজকদের বিরুদ্ধে FIR দায়ের হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে সেন্সর বোর্ডের ভূমিকা নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রী কটাক্ষ করেছেন ঐতিহাসিক সত্যের অপমানের ইঙ্গিতে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহলে উত্তেজনার পারদ চড়ছে, দর্শকমহলেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে—এক ছবি ঘিরে ইতিহাস যেন রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে।
STORY HIGHLIGHTS:
খুদিরাম বসুকে “খুদিরাম সিংহ”, বারীন্দ্র কুমার ঘোষকে “বীরেন্দ্র কুমার” নামে দেখানো নিয়ে বিতর্ক
তৃণমূল কংগ্রেস ৭ প্রযোজকের বিরুদ্ধে FIR দায়ের করেছে
হেমচন্দ্র কানুনগোর পরিবর্তে কাল্পনিক চরিত্র “কৃপাল সিং” দেখানো হয়েছে
সিনেমাটির পরিচালনায় করণ সিং ত্যাগী, ভিত্তি রঘু ও পুষ্পা পলাটের বই
সেন্সর বোর্ডের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠিয়েছে তৃণমূল
কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারকে দায়ী করেছে রাজ্য সরকার
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা বহু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে। যুগে যুগে, বাঙালি বিপ্লবীরা তাঁদের অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে নিজেদের নাম অমর করে গেছেন। কিন্তু সেই ইতিহাসই যদি আজকের দিনে বিকৃতভাবে পর্দায় উঠে আসে, তাহলে তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে— ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা কি আদৌ রক্ষিত হচ্ছে?
এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই বুধবার রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে বলিউডের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘কেশরী চ্যাপ্টার ২’। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ছবির নির্মাতাদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে অভিযোগ তোলে যে, এই সিনেমায় বাংলার বিপ্লবীদের নাম ও পরিচয় বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা শুধু বেদনাদায়ক নয়, অপমানজনকও বটে।
তৃণমূল মুখপাত্র কুনাল ঘোষ ও নেতা অরূপ চক্রবর্তী এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, “এই ছবি শুধুমাত্র তথ্যগত ভুল করছে না, বরং পরিকল্পিতভাবে বাংলার বিপ্লবীদের পরিচয় বিকৃত করছে।”
“বাঙালি বিপ্লবীদের নাম বিকৃত করা হয়েছে। এটা শুধু ভুল নয় — বাংলার ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র।” — বলেন কুনাল ঘোষ।
তাঁর অভিযোগ, ছবিতে খুদিরাম বসুর নাম দেওয়া হয়েছে “খুদিরাম সিংহ”, আর বারীন্দ্র কুমার ঘোষকে “বীরেন্দ্র কুমার” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁকে আবার দেখানো হয়েছে অমৃতসরের বাসিন্দা হিসেবে। তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য, এই ধরণের বদল কোনওভাবেই অনভিপ্রেত নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুধু তাই নয়, হেমচন্দ্র কানুনগোর চরিত্রকেও পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে এক কাল্পনিক চরিত্র “কৃপাল সিং”-কে তাঁর জায়গায় বসানো হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই বিধাননগর দক্ষিণ থানায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর একাধিক ধারায় সাতজন প্রযোজকের বিরুদ্ধে FIR দায়ের হয়েছে। ছবির পরিচালক করণ সিং ত্যাগী, এবং এটি নির্মিত হয়েছে রঘু পলাট ও পুষ্পা পলাটের লেখা ‘The Case That Shook the Empire’ বইয়ের উপর ভিত্তি করে। অভিনেতা অক্ষয় কুমার, আর মাধবন এবং অনন্যা পাণ্ডে ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছবির নাম না করেই এক কঠিন বার্তা দেন।
“বাংলার বিপ্লবীদের ভূমিকা খাটো করার চেষ্টা চলছে। বিজেপি বাংলার সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে আঘাত করছে,” — মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী।
তৃণমূলের পক্ষ থেকে আরও দাবি করা হয়, কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ঐতিহাসিক গর্বকে হেয় করার চেষ্টা করে এসেছে।
“এটা নতুন নয়। আগেও কেন্দ্র বাংলার মর্যাদা নিয়ে খেলেছে। কিন্তু এবার সব সীমা অতিক্রম করা হয়েছে।” — মন্তব্য করেন কুনাল ঘোষ।
তৃণমূলের অভিযোগ, এই সিনেমার মাধ্যমে সচেতনভাবে বাংলার বিপ্লবীদের অবদানকে আড়াল করে এমন এক বর্ণনা তৈরি করা হয়েছে, যা বাঙালির ইতিহাসকে বিকৃত করে। আর এই পরিস্থিতিতে তাঁদের প্রশ্ন, সেন্সর বোর্ড কীভাবে এই ছবি ছাড়পত্র দিল?
“সেন্সর বোর্ড কেন এই ইতিহাস বিকৃতি ধরতে পারল না? কে দায় নেবে এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য?” — এমনই প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেতারা।
অন্যদিকে, বিজেপি এই অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁদের দাবি, তৃণমূল এক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক তুলে রাজনীতি করছে।
“ফিচার ফিল্মে অনেক সময় চরিত্রের নাম পাল্টে যায়। এর সঙ্গে বিজেপির কী সম্পর্ক? তৃণমূল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি কতটা সম্মান দেখিয়েছে, তা সকলেই জানে।” — বলেন বিজেপি সাংসদ সামিক ভট্টাচার্য।
এই বিতর্কে মুখ খুলেছেন জনপ্রিয় বাঙালি অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তীও। তাঁর মতে, ইতিহাস-ভিত্তিক ছবি নির্মাণের সময় যত্ন ও গবেষণার অভাব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
“এটা খারাপ গবেষণা নাকি বাজে চিত্রনাট্য বলা উচিত বুঝতে পারছি না। স্পষ্ট যে, বাঙালি বিপ্লবীদের ভূমিকা খাটো করার চেষ্টা হয়েছে।” — জানান ঋত্বিক।
এদিকে, ছবির একাংশ দেখে অনেক বাঙালি দর্শক সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। কেউ কেউ সরাসরি লেখেন, “এই বিকৃতি ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা।” অনেকে আবার দাবি করেছেন, নির্মাতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
‘Kesari Chapter 2’ ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক এখন শুধু সিনেমার গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রে পৌঁছেছে। ইতিহাসের বিকৃতি, বাঙালি বিপ্লবীদের অপমান এবং তথ্যগত অসঙ্গতি নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা নিছক এক ছবির ভুল নয়— বরং এক বৃহত্তর সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সুরক্ষার দাবি। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসনিক স্তরে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং এই বিতর্ক ভবিষ্যতের চলচ্চিত্র নির্মাণে আরও সতর্কতা আনে কি না। ইতিহাস নিয়ে আবেগ থাকলেও, দায়িত্ব থেকে filmmakers রেহাই পান না।