ইয়েমেনের কঠোর আইনে, রাষ্ট্রদ্রোহ, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করা বা হত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। সেই আইনের ধারায় ফেঁসে গেছেন কেরালার নার্স নিমিষা প্রিয়া। স্থানীয় এক ইয়েমেনি নাগরিকের মৃত্যুকে ঘিরে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে গুরুতর অভিযোগ। আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় তিনি। রক্তপণ দিয়ে জীবনরক্ষা ছিল সম্ভাব্য রাস্তা, তবে অর্থসংকট, আইনি জটিলতা ও সময়সীমার চাপে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠেছে। আগামী ১৬ জুলাই তাঁর শাস্তি কার্যকর হতে পারে—এই প্রেক্ষাপটে চূড়ান্ত সময়ের কাঁটা ছুঁয়ে গেল এক মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে।
📌 STORY HIGHLIGHTS
কেরালার নার্স নিমিষা প্রিয়া ২০০৮ সালে পাড়ি দেন ইয়েমেনে
ব্যবসা খুলতে স্থানীয় নাগরিকের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়েন
অংশীদারের সঙ্গে বিবাদের পর তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে পাসপোর্ট ফেরত নেওয়ার চেষ্টা
ওভারডোজে মৃত্যু ঘটায় ইয়েমেনি নাগরিকের
২০১৮ সালে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ২০২৩ সালে রায় বহাল রাখে
রক্তপণের মাধ্যমে দণ্ড রদ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আলোচনা ভেঙে পড়ে
মায়ের শেষ আর্তি—”মেয়েকে বাঁচান, সময় শেষ হয়ে আসছে”
ইয়েমেনে ভারতীয় নার্স নিমিষা প্রিয়া-কে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কেরালার এই নার্সকে ২০১৮ সালে এক ইয়েমেনি নাগরিককে হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বছর ঘুরতেই ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট তাঁর মৃত্যুদণ্ডে অনুমোদন দেন। আগামী ১৬ জুলাই তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি ঘিরে এখন একদিকে আইন ও কূটনীতি, অন্যদিকে একজন মায়ের অসহায় আর্তি—এই দুইয়ের সংঘাত চলছে।
কেন ইয়েমেনে পাড়ি দিয়েছিলেন নিমিষা?
২০০৮ সাল। কেরালার এক সাধারণ পরিবার। মেয়ে নিমিষা প্রিয়া নার্স হিসেবে নিজের পেশাগত জীবনের উন্নতির আশায় পাড়ি দেন ইয়েমেন। উদ্দেশ্য ছিল পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা। প্রথম দিকে বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরি করলেও ধীরে ধীরে তিনি নিজেই একটি ক্লিনিক খোলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিদেশি হিসেবে ইয়েমেনে ব্যবসা করতে হলে স্থানীয় নাগরিকের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাধ্যতামূলক। সেই সূত্রেই ২০১৪ সালে পরিচয় হয় তলাল আব্দু মাহদির সঙ্গে।
প্রাথমিকভাবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, ২০১৬ সালে নিমিষা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। যদিও গ্রেফতার হওয়ার পর তলাল জামিনে ছাড়া পেয়ে যান এবং অভিযোগ অনুযায়ী আবারও হুমকি দিতে শুরু করেন।
অভিযোগ, হত্যা নয়, ছিল নিজের পাসপোর্ট ফেরত নেওয়ার চেষ্টা
নিমিষা প্রিয়ার পরিবারের দাবি, পরিস্থিতির চাপে পড়ে প্রিয়া একটি চরম সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর পাসপোর্ট আটকে রাখায় তলালকে ঘুমের ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে অচেতন করে তা উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ওই ইনজেকশনের ওভারডোজ হয়ে মৃত্যু ঘটে তলালের। এরপর প্রিয়া দেশ ছাড়ার চেষ্টা করলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
২০১৮ সালে একটি ইয়েমেনি আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। এর বিরুদ্ধে একাধিকবার আইনি লড়াই চালিয়ে গেলেও ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইয়েমেনের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সেই রায় বহাল রাখে। এরপর ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট সেই রায় অনুমোদন করেন।
রক্তপণের মাধ্যমে বাঁচার সুযোগ, তবে জটিলতা অনিবার্য
ইয়েমেনের আইন অনুযায়ী, কোনো হত্যার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে নিহতের পরিবারের সঙ্গে রক্তপণ বা ‘ব্লাড মানি’র বিনিময়ে সমঝোতা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রিয়ার পরিবারও সেই পথ অনুসরণ করতে চেয়েছিল। প্রিয়ার মা, যিনি কোচিতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন, মামলার খরচ চালাতে নিজের বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দেন।
প্রথমে ভারতীয় দূতাবাসের তরফে নিয়োগ করা আইনজীবী আবদুল্লাহ আমির রক্তপণ আলোচনায় এগোতে সম্মত হন। কিন্তু কিছুদিন পর আলোচনার আগে তিনি ২০,০০০ ডলারের (প্রায় ১৬.৬ লক্ষ টাকা) পারিশ্রমিক দাবি করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক তাঁর জন্য ১৯,৮৭১ ডলার পরিশোধ করলেও তিনি আরও ২০,০০০ ডলারের দাবি জানান।
এই আর্থিক টানাপোড়েনে আলোচনা স্তব্ধ হয়ে যায়। পরে ‘সেভ নিমিষা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল’ নামে একটি সংগঠন প্রথম কিস্তির টাকা তহবিল থেকে সংগ্রহ করলেও, পরবর্তীতে সেই অর্থ ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, এবং প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ে।
ভারত সরকারের অবস্থান ও মায়ের কাতর আহ্বান
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, তারা এই মামলাটি শুরু থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। ইয়েমেনি কর্তৃপক্ষ ও প্রিয়ার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়েছে, এবং সম্ভাব্য সবরকম সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
তবে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার নির্ধারিত দিন ১৬ জুলাই। এই অবস্থায় নিমিষার মা শেষবারের মতো সরকারের কাছে কাতর আবেদন জানিয়েছেন।
“আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে যা কিছু করা হয়েছে, তার জন্য ভারত ও কেরালা সরকারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এটা আমার শেষ আরজি – দয়া করে মেয়েকে বাঁচান, সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে,” – বললেন তিনি।
এই মামলাটি শুধু একজন নার্সের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন নয়, বরং এক জটিল আন্তর্জাতিক আইনি ও মানবিক সঙ্কটের প্রতিচ্ছবি। সময়ের ঘড়ি টিকটিক করছে, এবং এখন দেখার বিষয়—এই সময়সীমার মধ্যেই কি একটি জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে?
কেরালার নার্স নিমিষা প্রিয়ার বিরুদ্ধে ইয়েমেনে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড শুধুমাত্র এক ব্যক্তির নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে একটি দেশের নাগরিকের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক। কঠোর আইনের গেরোয় আটকে থাকা নিমিষার জীবন এখন নির্ভর করছে রক্তপণের মতো জটিল সামাজিক এবং আইনি ব্যবস্থার উপর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, আর সেই সঙ্গে ক্ষীণ হয়ে আসছে জীবনরক্ষার সম্ভাবনাও। একদিকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, অন্যদিকে এক মায়ের আর্তি—সব মিলিয়ে এখন গোটা দেশের নজর কেন্দ্রীভূত সেই এক ফাঁসির দড়ির দিকে, যেখানে প্রশ্ন একটাই—জীবন কি আদৌ রক্ষা পাবে?
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো