ভারতের সেবাক্ষেত্র গত মে মাসে রেকর্ড গতিতে উন্নতি অর্জন করেছে, যা দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানে অভূতপূর্ব বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ঘরোয়া চাহিদা ও আন্তর্জাতিক অর্ডারের তীব্র বৃদ্ধি। এই স্থিতিশীলতা ভারতের বিশ্বঅর্থনীতিতে উত্থানের পথে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে, যেখানে দেশের সেবাক্ষেত্র তার গতিপথ অব্যাহত রেখেছে, উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
ভারতের সেবাক্ষেত্রে মেজাজের উত্থান, অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় নতুন অধ্যায়
ভারতের সেবাক্ষেত্র মে মাসে ব্যাপক উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে, যা দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে তার শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। এই খাতে কর্মসংস্থানও রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি বড় সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই তথ্য জানিয়েছে এইচএসবিসি ইন্ডিয়া সার্ভিসেস পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) রিপোর্ট, যেখানে দেখা গেছে মে মাসে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সূচক ৫৮.৮-এ পৌঁছেছে, যা এপ্রিল মাসের ৫৮.৭ থেকে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই বৃদ্ধি প্রায় তিন বছরের নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণের ধারাকে নির্দেশ করছে।
সেবা খাতে এই স্থায়ী উন্নয়নের পেছনে রয়েছে দেশীয় চাহিদার দৃঢ়তা এবং আন্তর্জাতিক অর্ডারের তীব্র বৃদ্ধি, যা ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও গতিশীল করেছে। পিএমআই জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার এই সময়ে ধরা পড়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক সূচনা।
এই ধারাবাহিক সেবাক্ষেত্রের উন্নতি ভারতের অর্থনৈতিক সূচকে একটি শক্ত ভিত্তি প্রদান করেছে এবং এটি ভারতকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মানচিত্রে একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছে। একে একে প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচক, যা নির্দেশ করে যে ভারত আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও উচ্চ স্থান অধিকার করবে। সেবাক্ষেত্রের এই উন্নতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এই ধারাবাহিক উন্নতির সঙ্গে সাথে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হারও ২০০৫ সালে এই জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। এই ব্যাপক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে দেশের ভেতরের শক্তিশালী চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক অর্ডারের ব্যাপক বৃদ্ধি, যা সেবা খাতকে গতিশীল ও প্রগতিশীল করে তুলেছে। দেশীয় বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বৈশ্বিক স্তরে ব্যবসার সম্প্রসারণের ফলে সেবাক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বেড়েছে বহুগুণে, যা যুবসমাজের জন্য আশার সঞ্চার করেছে।
এই ধারাবাহিক সেবাক্ষেত্রের প্রবৃদ্ধি শুধু একটি ক্ষেত্রের উন্নতিই নয়, বরং এটি ভারতের অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থার একাধিক সূচকের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশটিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মানচিত্রে একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবৃদ্ধি ভারতের বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে বড় ধরনের উন্নতির পথ প্রশস্ত করছে, যা দেশের অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতার পরিচায়ক। ফলে, এই সব ইতিবাচক সূচক মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে ভারত বিশ্ব অর্থনীতির অগ্রগামী দেশ হিসেবে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ভারত এখন জাপানকে ছাপিয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নামমাত্র জিডিপি হিসেবে, এবং ২০২৭ সালের মধ্যে জার্মানিকে পিছনে ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনাও জোরদার হচ্ছে। এই অগ্রগতি দেশের বাজারে বাড়তে থাকা বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং স্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির প্রতিফলন। মে মাসের সেবা খাতের পারফরম্যান্স বেশ কয়েকটি গ্রাহক-কেন্দ্রিক খাত যেমন—আর্থিক সেবা, ব্যবসায়িক সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং রিয়েল এস্টেটে শক্তিশালী বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে, নতুন রপ্তানি অর্ডারের সংখ্যা প্রায় ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারতের বৈশ্বিক সেবা অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংযুক্তির একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
দেশের বিভিন্ন কোম্পানি বলছে যে, চাহিদার পরিবেশ আরও উন্নত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে তারা আশাবাদী, যার ফলে কোম্পানিগুলো দ্রুত কর্মী নিয়োগের দিকে এগিয়ে চলেছে। সবমিলিয়ে, ভারতীয় সেবা খাতের কার্যক্রম স্থিতিশীল থেকে আরও শক্তিশালী হচ্ছে এবং নতুন ব্যবসায় ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটছে।
এই প্রসঙ্গে এইচএসবিসির অর্থনীতিবিদ মৈত্রেয়ী দাস পিএমআই রিপোর্টে বলেছেন, “ভারতের সেবা খাতে কার্যক্রমে দৃঢ়তা বজায় রয়েছে, নতুন ব্যবসা দ্রুত গতিতে বাড়ছে এবং কোম্পানিগুলো ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে কর্মী নিয়োগ করছে।” এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ভারতের সেবা খাত শুধু দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে না, বরং বিশ্ববাজারে দেশের অবস্থানও ক্রমশ শক্তিশালী করছে।
ভারতের বৃহত্তর মাইক্রোইকোনমিক পরিবেশও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মরগ্যান স্ট্যানলির বিশ্ব প্রধান অর্থনীতিবিদ সেথ কার্পেন্টার সম্প্রতি বলেছেন, ভারতের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি “দৃঢ়” অবস্থায় রয়েছে। এটি মূলত স্থায়ী পুঁজি বিনিয়োগ, সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক ব্যয় এবং রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার নীতিগত অবস্থানের কারণে নিম্নমুদ্রাস্ফীতির একটি কাঠামোগত পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। ব্যবসায়িক সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানিয়েছে, এই প্রবৃদ্ধির গতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা শিথিল করেছে, যার মাধ্যমে দেশীয় পর্যায়ে সেমিকন্ডাক্টর এবং ইলেকট্রনিক্স উপাদান উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই খাতগুলো প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
সরকারের এই নীতিগত উদ্যোগের ফলে মাটির স্তরে স্পষ্ট ও দৃশ্যমান ফলাফল এসেছে। গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে শুরু করে বড় শিল্প ক্ষেত্র পর্যন্ত এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা দেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলছে। এই ধরনের প্রণোদনা ও নীতিগত সমর্থন ভারতের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে আরও জোরদার করছে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশকে একটি আধুনিক, স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ জাতিতে রূপান্তরিত করার পথে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে, সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশ ও সরকারের নীতিগত পদক্ষেপগুলি ভারতের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
ভারত অর্থনৈতিক বছরে ২০২৪-এ মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগ (এমএসই) থেকে সরকারি ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, যা সরকারের ২৫ শতাংশ ক্রয় এই সেক্টর থেকে করার ম্যান্ডেট পূরণের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে—এ কথা জানিয়েছে ইকোনমিক টাইমস। এই অর্জন অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির পথে ভারতের অগ্রগতিকে বিশেষভাবে প্রতিফলিত করে, কারণ এমএসইগুলি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও উদ্ভাবনের উৎস।
একই সময়ে, বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI)ও ব্যাপক শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে, যেখানে গত দশকে ভারত ৬০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ভারতের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক নীতির প্রতি দীর্ঘমেয়াদী আস্থা প্রদর্শন করে। এসব সূচক মিলে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধির শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে কাজ করছে।
মূলধনী বাজারগুলোতেও ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি উচ্ছ্বাস স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস জানিয়েছে, অর্থনৈতিক বছর ২০২৫-এর জন্য প্রায় ১.৪ লাখ কোটি টাকার আইপিও (প্রাথমিক জনসাধারণের অংশগ্রহণ) লাইনআপে রয়েছে, যা অবকাঠামো থেকে শুরু করে কনজিউমার প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন খাতকে কভার করবে। এই তথ্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, বিনিয়োগকারীদের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কর্পোরেট সেক্টরের আস্থা আরও দৃঢ় হচ্ছে।
সেবাক্ষেত্র যেখানে সকল দিক থেকে শক্তিশালীভাবে কাজ করছে, সেখানে সরকারের সহায়ক নীতিমালা গঠন হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীদের মনোবল অটুট রয়েছে, সেই পরিবেশে ভারত শুধু বর্তমান প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতেই সক্ষম নয়, বরং তা অতিক্রম করার সম্ভাবনাও রয়েছে। অর্থনীতি যখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে, তখন এর সাফল্যের গল্পের মূল ভিত্তি হবে সেই সেবা খাত, যা ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে, নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করছে এবং রেকর্ড পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবিচল রয়েছে।
এই দৃঢ় ভিত্তি ভারতের পরবর্তী বৈশ্বিক অগ্রগতির জন্য মজবুত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে, যা শুধু দেশের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করবে না, বরং আন্তর্জাতিক পরিসরেও ভারতের অবস্থানকে অনেকগুণ সুদৃঢ় করবে। ফলে, ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত উজ্জ্বল এবং বিশ্ববাজারে এর প্রভাব ক্রমেই বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।