ভারতীয় অর্থনীতি বর্তমানে এক উল্লেখযোগ্য পর্ব অতিক্রম করছে, যেখানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। ২০২৮-এর মধ্যে তৃতীয় স্থান অর্জনের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। তবে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে উৎসাহের পাশাপাশি প্রশ্নও উঠছে—বেকারত্বের হার, কর্নি পুঁজিবাদ এবং সামাজিক বৈষম্য কি এই অগ্রগতিকে স্থায়ী করবে? এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কীভাবে ভারতের অর্থনীতি এগোচ্ছে, কী চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে এবং কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে দেশকে এগোতে হবে।
ভারতীয় অর্থনীতি এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিকে আছে গর্ব করার মতো উন্নতি, অন্যদিকে আছে উদ্বেগের মতো প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত ২০২৫ সালের মধ্যেই জাপানকে টপকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলেছে। শুধু তাই নয়, ২০২৮ সালের মধ্যে ভারত জার্মানিকে পিছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির আসনও দখল করতে পারে।
সূচিপত্র
Toggleভারতের অর্থনীতির অবস্থা – স্বর্ণযুগ না কাঁচা স্বপ্ন?
ভারতীয় অর্থনীতি আজ এমন এক বাঁকে দাঁড়িয়ে যেখানে সাফল্যের সূচক ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে দোলাচল রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা IMF-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের অর্থনীতির অবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী, এবং দেশ ২০২৫ সালের মধ্যে জাপানকে অতিক্রম করে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। আবার ২০২৮ সালের মধ্যে তৃতীয় স্থানে পৌঁছানোর পূর্বাভাসও রয়েছে। এই তথ্য নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক, কিন্তু কিছু গভীর প্রশ্ন থেকেই যায়—এই অগ্রগতি কি সকলের জন্য, না কি শুধু শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিদের জন্য?
আর্থিক অগ্রগতি: বাস্তব কি উল্লাস?
ভারতের জিডিপি বর্তমানে ৩.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
IMF-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী এই হার দ্রুত বাড়বে এবং ২০২৮ সালের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি জার্মানিকে ছাড়িয়ে যাবে।
তবে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এই উন্নয়ন তুলনামূলকভাবে অসম।
👉 প্রশ্ন: জিডিপি বাড়লেও, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কী তার প্রভাব পড়ছে?
জিডিপি-ভিত্তিক উন্নয়ন মানেই সামগ্রিক অগ্রগতি নয়
IMF অনুযায়ী, ভারতীয় অর্থনীতি ২০২৫ সালে জাপানকে টপকে চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হবে এবং ২০২৮ সালে জার্মানিকে ছাড়িয়ে তৃতীয় স্থানে পৌঁছবে।
এই পূর্বাভাস মূলত GDP বৃদ্ধির হার, রফতানির পরিমাণ এবং পরিষেবা খাতে বিনিয়োগের ভিত্তিতে তৈরি।
কিন্তু এই “গ্লোবাল র্যাংকিং”-এ উন্নতি মানেই ভারতের অর্থনীতির অবস্থা ভালো—এমনটা বলা ভুল হবে।
✅ GDP বাড়লেও:
বেকারত্বের হার অনেকটাই স্থির বা ঊর্ধ্বমুখী।
কর্মসংস্থানের প্রকৃত হার কমছে।
যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০%-এর বেশি, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে।
👉 তাই IMF-এর ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবায়িত হলেও, তাতে ভারতীয় অর্থনীতি কতটা গণমুখী হবে, সেটাই আসল প্রশ্ন।
বিনিয়োগ ও মানব উন্নয়ন সূচক (HDI)
IMF-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) ভারতের প্রতি আস্থা দেখাচ্ছে।
প্রযুক্তি, পরিষেবা, এবং ডিজিটাল ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে।
তবে, মানব উন্নয়ন সূচক এখনও দুর্বল:
শিক্ষার মানে বৈষম্য
স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতুল ব্যয়
নারীদের কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ কম
👉 শুধুমাত্র কর্পোরেট ফ্লোরে উন্নতি হলেই ভারতীয় অর্থনীতি প্রকৃত অর্থে এগোচ্ছে না—HDI-ও দেখতে হবে।
কর্নি পুঁজিবাদ – উন্নতির ইঞ্জিন, না বৈষম্যের সূত্র?
🔍 কর্নি পুঁজিবাদ: ধারণা ও প্রেক্ষাপট
কর্নি পুঁজিবাদ (Crony Capitalism) বলতে এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে সরকারি নীতির সুবিধা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কিছু কর্পোরেট গোষ্ঠী পায়—তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ বা প্রভাবের কারণে। এই পুঁজিবাদে প্রকৃত প্রতিযোগিতা ও বাজারের স্বচ্ছতা ব্যাহত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যাপী এই শব্দটি আলোচিত হলেও ভারতের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে “কর্নি পুঁজিবাদ” একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এখানে সরকারি ও বেসরকারি সম্পর্ক প্রায়শই অস্বচ্ছ এবং পক্ষপাতদুষ্ট।
📌 বর্তমান ভারতের প্রেক্ষিতে কর্নি পুঁজিবাদের প্রভাব
২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে দেখা গেছে, মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী সরকারি প্রকল্প ও ব্যাংক ঋণের সিংহভাগ পেয়েছে।
Adani Group ও Ambani Group-এর মতো শিল্পসংস্থাগুলি একাধিক ক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত সহায়তা পেয়েছে বলে বিরোধীরা বারবার অভিযোগ তুলেছে।
IMF-এর রিপোর্টে ভারতের প্রবৃদ্ধির প্রশংসা থাকলেও এই ধরণের কর্নি পুঁজিবাদ কতটা স্বাস্থ্যকর সে নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই।
👉 তাহলে প্রশ্ন হলো, এই ধরনের আর্থিক কৃতিত্ব কাদের জন্য—সাধারণ মানুষের, না শীর্ষ ১% ধনকুবেরদের?
📉 প্রতিযোগিতার অভাব ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংকট
কর্নি পুঁজিবাদের ফলে বাজারে প্রকৃত প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়। বড় ব্যবসাগুলি প্রভাব খাটিয়ে ছোট ব্যবসাগুলিকে কোণঠাসা করে দেয়।
MSME (Micro, Small and Medium Enterprises) গুলোর সামনে ভর্তুকি, ঋণ ও কর কাঠামোর ক্ষেত্রে তেমন সুযোগ না থাকায় তারা টিকে থাকতে পারছে না।
এর ফলে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা কাগজে শক্তিশালী হলেও, বাস্তবে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসা ধুঁকছে।
👉 এই বৈষম্য শুধু আর্থিক নয়, তা সামাজিক সুরক্ষাকেও বিঘ্নিত করছে।
📊 কর্নি পুঁজিবাদ এবং কর্মসংস্থানের সংকট
কর্নি পুঁজিবাদ যেখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বর্ধন করে, সেখানে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় না সমান হারে। বড় কর্পোরেট গোষ্ঠী অটোমেশন ও প্রযুক্তি নির্ভরতায় কাজের সংখ্যা কমিয়ে দেয়।
এই পরিস্থিতিতে বেকারত্বের হার বাড়ছে, বিশেষত তরুণদের মধ্যে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুব বেকারত্বের হার ২০%-এর কাছাকাছি পৌঁছেছে।
ফলে প্রশ্ন জাগে—ভারতীয় অর্থনীতি যদি উন্নতির পথে থাকে, তবে কর্মসংস্থান কেন সংকটময়?
👉 কর্নি পুঁজিবাদ আসলে উন্নয়নকে কেন্দ্রীভূত করছে গুটি কয়েক হাতে, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে নয়।
⚖️ সামাজিক বৈষম্য ও আস্থা সংকট
এই আর্থিক বৈষম্য কেবল আয় বা সম্পদের মধ্যে নয়, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি-ব্যবহারের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়।
ভারতের অর্থনীতির অবস্থা যতই আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হোক না কেন, দেশের মধ্যে সাধারণ নাগরিকের মধ্যে এক ধরনের ‘আস্থা সংকট’ তৈরি হচ্ছে।
কর্নি পুঁজিবাদ বাজারের উপর আস্থা নষ্ট করে, যার ফলে বিনিয়োগকারীরাও ধীরে ধীরে সাবধানী হয়ে ওঠেন।
👉 দীর্ঘমেয়াদে এটা ভারতীয় অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিতে পারে।
📌 IMF-এর প্রতিবেদন ও কর্নি বাস্তবতা – এক দ্বন্দ্ব
IMF যে রিপোর্টে ভারতকে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের চতুর্থ এবং ২০২৮ সালে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে উল্লেখ করেছে, তাতে প্রবৃদ্ধির হার, রপ্তানি, সরকারি লগ্নি—এই সমস্ত কিছুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কর্নি পুঁজিবাদের মতো অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে সেই রিপোর্ট এড়িয়ে গেছে।
👉 অর্থাৎ, একদিকে আছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, আর অন্যদিকে আছে অন্তর্নিহিত অসাম্য।
কোন পথে উন্নয়ন?
কর্নি পুঁজিবাদ হয়তো অস্থায়ী প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা ভারতের অর্থনীতির অবস্থাকে দুর্বল করতে পারে। ভারতীয় অর্থনীতি যদি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের দিকে এগোতে চায়, তবে প্রয়োজন আরও স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও সুযোগ-সমতার ভিত্তিতে গঠিত একটি অর্থনৈতিক পরিবেশ। বেকারত্বের হার কমানো, MSME-কে সাহায্য করা, এবং কর্পোরেট সংস্থার উপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করাই হতে পারে সঠিক পথ।
বেকারত্বের হার – অগ্রগতির ছায়ায় অন্ধকার
ভারতের বেকারত্বের হার: চিত্রটি যতটা মিষ্টি নয়
ভারতীয় অর্থনীতি একটি উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও, বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে। দেশে কার্যকরী কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনও অপ্রতুল।
CMIE (Center for Monitoring Indian Economy) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে যুবকদের বেকারত্বের হার ২০%-এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। এটি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি মারাত্মক সংকেত, যেখানে উন্নতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোটি কোটি তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য হাহাকার করছে।
কর্পোরেট লাভ ও কর্মসংস্থানের অমিল
কর্নি পুঁজিবাদের প্রভাব, যেখানে বড় কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলির প্রাধান্য দেখা যায়, তা ছোট ব্যবসা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের টিকে থাকতে বাঁধাগ্রস্ত করে।
সঠিক পরিকাঠামোর অভাবে ভারতীয় অর্থনীতি যেন এক দ্বিমুখী পথে চলে যাচ্ছে—একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং বিদেশী লগ্নির মাধ্যমে গতি অর্জন, অন্যদিকে অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান।
অটোমেশন ও প্রযুক্তির প্রভাব: কর্মসংস্থানের সংকোচন
প্রযুক্তি নির্ভরতার ফলে বহু কর্মসংস্থান হারিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতি ও শিল্পক্ষেত্রে অটোমেশন ব্যবহারের ফলে প্রচুর লোকের কাজ চলে যাচ্ছে। ব্যাংকিং, রিটেল, উৎপাদনসহ অন্যান্য খাতে স্বয়ংক্রিয়ীকরণ কর্মসংস্থান সংকুচিত করছে।
এতে বেকারত্বের হার আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ যেসব কর্মচারী আগে যন্ত্রপাতি পরিচালনা করতেন, তাদের জায়গা নিচ্ছে মেশিন।
কৃষিখাতের অবহেলা এবং নীতি সংক্রান্ত সমস্যা
ভারতের অন্যতম বৃহত্তম খাত কৃষি। তবে, এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে কারণ কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি ও মেকানাইজেশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারছে না।
সরকারের নীতিতে কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার কম, ফলে কৃষি শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না।
প্রাতিষ্ঠানিক বেকারত্ব এবং শিক্ষা ব্যবস্থার ভূমিকা
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও সঠিক দক্ষতা উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া হয়নি। বেকারত্বের হার নির্ধারণে শিক্ষার মান, দক্ষতার অভাব এবং শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দানের অভাব একটি বড় বাধা।
তরুণদের মাঝে সঠিক দক্ষতার অভাবের কারণে, তারা কার্যকরভাবে ভারতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারছে না।
কর্মসংস্থানের উৎস: সরকারের উদ্যোগ বা কর্পোরেট শোষণ?
সরকারী উদ্যোগে বড় পদক্ষেপ নেই, বিশেষ করে MSME (Micro, Small, and Medium Enterprises) খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার দিকে। এই খাতে সহায়তা প্রাপ্তি সীমিত, ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সংকীর্ণ।
সরকারি প্রকল্পগুলির প্রয়োগের অভাব ও দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ভবিষ্যতের করণীয়: অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও বেকারত্ব কমানোর প্রকল্প
ভারতীয় অর্থনীতি যদি প্রাথমিক উন্নতির পরিমাণকে ধরে রাখতে চায়, তবে কার্যকরী কর্মসংস্থান তৈরি করার জন্য শক্তিশালী নীতির প্রয়োগ জরুরি।
আঞ্চলিক উন্নয়ন, MSME সেক্টরের উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা গেলে বেকারত্বের হার কমানো সম্ভব।
ভারতের উন্নতি বা অন্ধকার?
ভারতীয় অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধির মুখে, কিন্তু বেকারত্বের হার বাড়লে এই উন্নতি স্থায়ী হবে না। কাজেই, উন্নতির পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়ন অতীব জরুরি।
একদিকে যেখানে ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠছে, অন্যদিকে এটি একটি বড় বেকারত্বের হার এর সমস্যার মুখোমুখি।
এই বিশ্লেষণটি স্পষ্ট করে, ভারতীয় অর্থনীতিের অগ্রগতি সম্ভব, তবে সে পথে বেকারত্বের হার একটি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
স্থানীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান: সম্ভাবনা বনাম বাস্তবতা
“মেক ইন ইন্ডিয়া” ও “আত্মনির্ভর ভারত” এর লক্ষ্য – কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা
ভারতীয় অর্থনীতি‘র বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, কেন্দ্রীয় সরকারের “মেক ইন ইন্ডিয়া” এবং “আত্মনির্ভর ভারত” কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত একটি স্বনির্ভর এবং শক্তিশালী উৎপাদনশীল দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে চায়।
এই পরিকল্পনা কর্মসংস্থান তৈরি, উন্নত প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, তবে বাস্তবতার মঞ্চে, সেসব উদ্যোগের বাস্তবিক ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত ফলস্বরূপ দেখা যায়নি।
ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কর্মসংস্থানের অসুবিধা
যদিও ভারতীয় অর্থনীতি ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিক থেকে সাফল্য ততটা আশাপ্রদ নয়।
প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ, বিশেষ করে অটোমেশন এবং রোবটিক্সের বৃদ্ধি, উৎপাদন খাতে লোকবলকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলছে, যা কর্মসংস্থানের হারকে প্রভাবিত করছে।
উদাহরণস্বরূপ, মেকানিকাল উৎপাদন প্রযুক্তির কারণে ছোট ও মাঝারি শিল্পে লোকবল কমিয়ে আনা হচ্ছে, ফলে স্থানীয় কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ছে।
প্রযুক্তির আধিপত্য: অটোমেশন এবং AI
ভারতীয় অর্থনীতি’র দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) আগমন অনিবার্য। তবে এর অতি দ্রুত গ্রহণ স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
বিশেষ করে, অটোমেশন কার্যক্রমে দক্ষতার প্রয়োজন বাড়ানো, যার ফলে শ্রমিকদের দক্ষতা না থাকলে তাদের জন্য চাকরি পাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে, এবং এটি বেকারত্বের হার বাড়ানোর প্রধান কারণ হতে পারে।
উৎপাদন খাতে দেশীয় প্রতিবন্ধকতা
ভারতীয় অর্থনীতি‘র উৎপাদন খাতে প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ বাধাগুলির মধ্যে রয়েছে ঋণের অপ্রতুলতা, অবকাঠামোগত সমস্যাগুলি এবং উৎপাদনশীলতার অভাব।
একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য দেশীয় পণ্যের উন্নত মান অপরিহার্য, অন্যদিকে, স্থানীয় উৎপাদন খাতে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সব কিছু মিলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পথকে অতিক্রম করতে বেশ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অর্থনৈতিক উন্নতি বা কর্মসংস্থান: আসল প্রশ্ন
ভারতীয় অর্থনীতি’র উন্নতি যদি শুধুমাত্র GDP বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে না, যা সামাজিক স্তরের স্থিতি বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, প্রকৃত উন্নতি তখনই সম্ভব যখন এই উৎপাদনশীলতা মানুষের জন্য বাস্তবিক কর্মসংস্থান তৈরি করবে।
স্থানীয় উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান: নতুন সম্ভাবনা
ভারতীয় অর্থনীতি’র ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, স্থানীয় উৎপাদন এবং ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো একটি সম্ভাবনার দরজা খুলছে।
“Start-Up India” এবং “Skill India” এর মতো প্রকল্পগুলি স্থানীয় উৎপাদনকে সমর্থন দিচ্ছে এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরি করছে, তবে এর সফলতা শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন সরকার সঠিকভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করবে এবং সেগুলিকে বাস্তবায়ন করবে।
ভারতীয় অর্থনীতি‘র স্থিতিশীলতা কেবলমাত্র স্থানীয় উৎপাদন এবং কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সম্ভব। তবে, এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ, শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং সরকারের যথাযথ সহায়তার মাধ্যমে।ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে সঠিক মনোভাব এবং প্রযুক্তির উন্নতির সহায়ক রূপে, কেবল তখনই দেশ উন্নতি করতে পারবে এবং এর কর্মসংস্থান গঠন প্রকল্পগুলো সফল হতে পারে।
কীভাবে এগোবে ভারত?
অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করা
ভারতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। ভারতের মূখ্য লক্ষ্য হবে স্থিতিশীল আর্থিক কাঠামো তৈরি করা, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট বা মহামারী-পরবর্তী সময়ে কার্যকরীভাবে দেশকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
বিশাল পরিমাণে সরকারি বিনিয়োগ এবং স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে বেকারত্বের হার কমানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং প্রযুক্তির ব্যবহার
ভারতীয় অর্থনীতি’র স্থিতিশীলতা এবং উন্নতির জন্য প্রযুক্তির যুগোপযোগী ব্যবহার অপরিহার্য। দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর, খনিজ উৎপাদন এবং কৃষির আধুনিকীকরণে প্রযুক্তির ব্যবহার বড় ভূমিকা পালন করবে।
অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং রোবটিক্সের সঙ্গে একত্রীকরণ স্থানীয় উৎপাদন খাতকে আরও লাভজনক করবে, কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
কৌশলগত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবৃদ্ধি
ভারতীয় অর্থনীতি‘র বৃদ্ধি বিশ্বের বাজারে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। বিশেষত, বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব এবং কৌশলগত সম্পর্কের মাধ্যমে ভারতের বাজারে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে।
ভারতের সস্তা শ্রম এবং বৃহৎ বাজার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলবে, যা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করবে।
শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি এবং নিয়মাবলী
সরকারি নীতি, বিশেষ করে করনীতি এবং ব্যাংকিং সংস্কারের মাধ্যমে ভারতীয় অর্থনীতি‘র ভিতরকার জটিলতা এবং অস্থিরতা মোকাবেলা করা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, “ট্রান্সফর্মেশন” ও “বিকল্প অর্থনৈতিক সুযোগ” তৈরির জন্য শক্তিশালী শিল্পের নীতি এবং কৃষি সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে সাফল্য
“আত্মনির্ভর ভারত” কর্মসূচির মাধ্যমে ভারতীয় অর্থনীতি আত্মনির্ভর হতে পারে। এতে মূলত ভারতের নিজস্ব শিল্পের বিকাশ এবং বিদেশী পণ্যের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো লক্ষ্য।
উৎপাদন, কৃষি এবং পরিষেবা খাতে উন্নতি সাধন করতে হবে যাতে আঞ্চলিক উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে বেকারত্বের হার কমানোরও সুযোগ তৈরি হবে।
শিক্ষা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন
মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে দক্ষতা উন্নয়নে। “স্কিল ইন্ডিয়া” এবং “স্টার্টআপ ইন্ডিয়া” কর্মসূচি ভারতের ভবিষ্যৎ কর্মশক্তি প্রস্তুত করতে সহায়ক হবে।
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষ কর্মীদের জন্য কার্যকরী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে যাতে ভারতীয় অর্থনীতি উন্নতি ঘটাতে পারে।
ভারত যখন এগোবে, তখন অবশ্যই তার অর্থনৈতিক কাঠামো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, উৎপাদন খাত এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তা ছাড়া, স্বনির্ভরতা এবং প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে যাত্রা সম্ভব হবে। ভারতীয় অর্থনীতি‘র ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এই দীর্ঘমেয়াদি নীতির কার্যকর বাস্তবায়নের উপর।