ভারত বনাম বাংলাদেশ: জমজমাট লড়াইয়ে টিকে রইল টিম ইন্ডিয়া!
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ। দুই দলের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বরাবরই উত্তেজনাপূর্ণ হয়, আর এই ম্যাচও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ম্যাচ শুরুর আগে দুই দলই আত্মবিশ্বাসী ছিল। বাংলাদেশ টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে ভারতীয় বোলারদের সামনে তাদের শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি।
শুরুর ধাক্কা সামলাতে পারেনি বাংলাদেশ
বাংলাদেশ দল টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, যা বেশ প্রত্যাশিত ছিল। দুবাইয়ের উইকেট সাধারণত প্রথম দিকে ব্যাটসম্যানদের জন্য ভালো থাকে, এবং সাকিব আল হাসান ও কোচ চান্ডিকা হাতুরুসিংহে চেয়েছিলেন বড় স্কোর গড়তে। কিন্তু ভারতের পেস বোলিং আক্রমণ যে এত বিধ্বংসী হবে, তা হয়তো বাংলাদেশ ভেবেই উঠতে পারেনি।
শুরুতেই বিপর্যয়
প্রথম ওভারেই বাংলাদেশ বুঝতে পারে, কাজটা সহজ হবে না। নতুন বলে শামি ও বুমরাহ প্রচুর সুইং পাচ্ছিলেন। উইকেট থেকে সামান্য বাড়তি বাউন্সও দেখা যাচ্ছিল, যা ওপেনারদের সমস্যায় ফেলছিল। তামিম ইকবাল ও লিটন দাস ভালো শুরুর আশায় ছিলেন, কিন্তু ভারতের বোলাররা তাদের কোনো সুযোগই দেয়নি।
খেলার তৃতীয় ওভারেই বড় ধাক্কাটা আসে। তামিম ইকবাল (৭ রান) আউট হন জাসপ্রিত বুমরাহর বলে। অফ স্টাম্পের বাইরে সুইং করা ডেলিভারি তামিম পয়েন্ট অঞ্চলে খেলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঠিকমতো টাইমিং করতে পারেননি। সরাসরি বল চলে যায় রবীন্দ্র জাদেজার হাতে।
এই উইকেটের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি বড় ধাক্কা আসে। ষষ্ঠ ওভারে, মোহাম্মদ শামির একটি নিখুঁত ইনসুইং ডেলিভারি লিটন দাসের স্টাম্প ভেঙে দেয়। লিটন চেষ্টা করেছিলেন ব্যাট ও প্যাডের মাঝে গ্যাপ বন্ধ করতে, কিন্তু শামির দুর্দান্ত বল তা হতে দেয়নি। মাত্র ১৯ রান করেই ফিরে যান লিটন।
বাংলাদেশ তখন ২৫ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে। দল চাপে পড়ে যায়।
সাকিব-মুশফিক জুটি: কিছুক্ষণ স্থিতিশীলতা, কিন্তু তারপর…
অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম তখন চেষ্টা করেন ইনিংস গুছিয়ে নিতে। দুজনই জানতেন, যদি উইকেট হারানো বন্ধ করা যায়, তাহলে পরে বড় রান তোলা সম্ভব হবে।
সাকিব প্রথম দিকে খুব সতর্ক ছিলেন। শামি ও বুমরাহর প্রথম স্পেল কাটিয়ে ওঠার পর তিনি কুলদীপ যাদব ও হার্দিক পান্ডিয়ার বিরুদ্ধে রান বের করার চেষ্টা করেন। অপরদিকে, মুশফিক ছিলেন ধৈর্যশীল। ছোট ছোট সিঙ্গেল নিয়ে খেলা চালিয়ে যান।
এই জুটি কিছুটা স্থিতিশীলতা নিয়ে এলেও, ১৭তম ওভারে আবার ধাক্কা আসে।
শামির বিধ্বংসী ওভার: ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিল
১৭তম ওভারে বল হাতে নেন মোহাম্মদ শামি। প্রথম বলেই বিশাল ধাক্কা! শর্ট অফ লেন্থ ডেলিভারি, যা মুশফিক কাট করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঠিকমতো টাইমিং করতে পারেননি। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্যকুমার যাদব দুর্দান্ত ক্যাচ নেন। মুশফিকের রান তখন ২৪।
পরের বলেই মাহমুদউল্লাহকে আউট করেন শামি! ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক যোগাযোগ হয়নি, এবং বল সরাসরি উইকেটকিপার লোকেশ রাহুলের হাতে চলে যায়। আম্পায়ার প্রথমে আউট দেননি, কিন্তু ভারত রিভিউ নেয়, এবং আল্ট্রা-এজে দেখা যায় ব্যাট ছুঁয়ে বল গিয়েছিল।
এক ওভারেই বাংলাদেশ ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে, এবং তখন তাদের স্কোর ছিল মাত্র ৭৮/৫!
তারপর এলো তৌহিদ হৃদয়ের লড়াই: একা বাঘের মতো লড়লেন তিনি!
বাংলাদেশ যখন বড় ধাক্কার মুখে পড়েছিল, তখন ২২ গজে একাই লড়াই শুরু করলেন তৌহিদ হৃদয়। একের পর এক উইকেট পড়ছিল, কিন্তু তিনি ধৈর্য হারাননি। তার ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি ঠিকই জানেন কীভাবে এই বিপর্যয় সামাল দিতে হবে। শুরুতে ধৈর্য ধরে খেললেন, উইকেটে সময় নিলেন, তারপর ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ভারতের বোলাররা যেখানে অন্য ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলে দিচ্ছিল, সেখানে হৃদয় ঠিকঠাক ব্যাটিং করছিলেন।হৃদয় যখন ক্রিজে আসেন, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৭৮ রানে ৫ উইকেট! এমন অবস্থায় বড় শট খেলার চেষ্টা করলে সেটাই বোকামি হতো। তাই প্রথমে তিনি একদম ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে থাকলেন। ছোট ছোট সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক পরিবর্তন করলেন। একেবারে পরীক্ষিত কৌশল—প্রথমে সেট হও, তারপর হাত খুলবে।ভারত তখন পুরোপুরি আক্রমণে ছিল। কুলদীপ যাদব, রবীন্দ্র জাদেজা, শামি—সবাই উইকেট তুলে নেওয়ার জন্য মরিয়া ছিল। কিন্তু হৃদয় কারও ফাঁদে পা দেননি। তিনি নিখুঁত ডিফেন্স করছিলেন, বাইরের বলে ব্যাট না ছোঁয়ানোর ধৈর্য দেখাচ্ছিলেন, আর এক-দুই রান নিয়ে ইনিংস বাড়াচ্ছিলেন।
প্রথম ৫০ রান করতে হৃদয়ের লেগেছিল ৬৮ বল, কিন্তু পরের ৫০ রান করতে লেগেছে মাত্র ৩৫ বল! সেট হয়ে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন, ভারতীয় বোলারদের কাবু করা সম্ভব।তারপর জাদেজার একটি ফুলটস বলকে একেবারে লং অনের ওপর দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠালেন।তারপর শামির স্লোয়ার বলকে কাট করে চার মারলেন।
তারপর বুমরাহর ইয়র্কার মিস করে গেলেও পরের বলেই পুল করে চার মারলেন।
এক কথায়, হৃদয় একাই পুরো ইনিংসের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ৪৫তম ওভারে এসে তিনি তুলে নেন তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সেঞ্চুরি! বাংলাদেশ ড্রেসিং রুমে তখন হাততালির আওয়াজ। ডাগআউটে বসে থাকা কোচ হাতুরুসিংহের মুখেও হাসি।
ভারতের ব্যাটিং: সহজ জয়, কিন্তু রোহিতের দুঃখ
বাংলাদেশ ২৫০ রানের লক্ষ্য বেঁধে দিলেও ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের গভীরতা ও শক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এই রান তাড়া করা খুব একটা কঠিন হবে না। ওপেনিংয়ে নামলেন রোহিত শর্মা ও শুভমান গিল। দুজনেই ভারতের ইনিংসের ভিত গড়ার জন্য পরিচিত, আর এই ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
রোহিত-গিলের বিধ্বংসী শুরু: বাংলাদেশ বোলারদের ঘুম উড়িয়ে দিলেন!
২৫১ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ভারত যেন প্রথম থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং করতে চেয়েছিল। পেসার তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলাম নতুন বল হাতে নিলেও ভারতীয় ওপেনাররা এক মুহূর্তের জন্যও চাপে পড়েননি।
রোহিত শর্মা তার স্টাইল অনুযায়ী শুরু করলেন। প্রথম দুই ওভার দেখেশুনে খেলার পর তৃতীয় ওভারেই শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুটি দারুণ বাউন্ডারি মারেন। একবার মিড উইকেট দিয়ে, আরেকবার স্কয়ার লেগ দিয়ে। পরের ওভারেই তাসকিন আহমেদকে লং অনের ওপর দিয়ে বিশাল ছক্কা মারেন রোহিত!
অন্যদিকে, শুভমান গিলও ধীরে ধীরে ছন্দে আসছিলেন। চতুর্থ ওভারে তিনি তাসকিনের এক দুর্দান্ত কভার ড্রাইভ খেলেন, যা সীমানা ছুঁয়ে যায়।
বাংলাদেশের বোলারদের চাপে ফেলে দেন রোহিত-গিল
পাওয়ারপ্লেতে ভারতের স্কোর ছিল ৫৪/০! মাত্র ৬ ওভারের মধ্যেই ৫০ পার করে ফেলে ভারত।
বাংলাদেশ তখন রণনীতি পরিবর্তন করে। সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজকে দ্রুত আনা হয় স্পিন আক্রমণে, কারণ পেসাররা কোনোভাবেই ভারতের ওপেনারদের চাপে ফেলতে পারছিলেন না।
কিন্তু স্পিনাররাও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সাকিবের প্রথম ওভারে রোহিত মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকান!
এরপর গিলও হাত খুলতে শুরু করেন। মিরাজের একটি লুজ ডেলিভারিকে সরাসরি কভার বাউন্ডারির বাইরে পাঠান তিনি। ১২তম ওভারে স্কোরবোর্ডে ১০০ পার করে ফেলে ভারত!
রোহিতের মাইলফলক, কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ
এই ম্যাচে রোহিত শর্মার সামনে ছিল একটি বড় অর্জনের সুযোগ। ওডিআই ক্যারিয়ারে তিনি ১১,০০০ রানের মাইলফলকের খুব কাছাকাছি ছিলেন। তিনি জানতেন, আর মাত্র ৪৫ রান করলেই তিনি এই ল্যান্ডমার্ক ছুঁয়ে ফেলবেন।
রোহিত ধাপে ধাপে এগোচ্ছিলেন। তার ব্যাটিং ছিল স্বাভাবিকভাবেই দুর্দান্ত। এক পর্যায়ে ৪৫ রানে পৌঁছে যান তিনি। কমেন্টেটররা তখন ঘোষণা করেন, “রোহিত শর্মা ওডিআই ইতিহাসে ১১,০০০ রানের ক্লাবে ঢুকে গেলেন!” ভারতীয় সমর্থকরাও স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছিলেন।
কিন্তু ঠিক এরপরেই আসে দুঃখজনক মুহূর্ত।
শরিফুল ইসলাম তখন দ্বিতীয় স্পেলে ফিরেছেন। তার করা অফ স্টাম্পের বাইরের একটি লেংথ বল রোহিত কাট করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু বলটা ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে সোজা উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমের গ্লাভসে জমা পড়ে। আম্পায়ার সঙ্গে সঙ্গে আউট দেন, রোহিতও বুঝে যান যে তিনি ফাঁদে পড়েছেন।
রোহিত থমকে গেলেন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তার চোখেমুখে হতাশার ছাপ ছিল স্পষ্ট। তিনি জানতেন, এটা আরও বড় ইনিংস হতে পারতো। সাজঘরে ফেরার সময় দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানায়।
রোহিত আউট হলেন ৪৫ রানে, ৩০ বলে ৬টি চার ও ২টি ছক্কাসহ।
কোহলি-গিলের দৃঢ়তা: সহজ জয়ের পথে ভারত
রোহিত আউট হলেও, ভারতের টার্গেট খুব একটা কঠিন ছিল না। ক্রিজে এলেন বিরাট কোহলি।
কোহলি ও গিল এরপর ধীরস্থির ব্যাটিং করলেন। তারা বুঝতে পারছিলেন, উইকেটে সেট হয়ে গেলে বাংলাদেশকে আর ম্যাচে ফেরানো সম্ভব হবে না।
গিল তার ফিফটি করলেন ৪৭ বলে, আর কোহলি ৩৬ বলে ৫০ রান করেন! দুজনই একেবারে দারুণ ছন্দে ছিলেন। বাংলাদেশ চেষ্টা করছিল উইকেট তুলে নেওয়ার, কিন্তু ভারতের ব্যাটসম্যানরা কোনো সুযোগই দিচ্ছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত ৪২তম ওভারে ম্যাচ শেষ করে ফেলে ভারত। কোহলি ৮২ রানে অপরাজিত থাকেন, গিল করেন ৭৫ রান।