হিমালয়ের গ্লেসিয়ার সংকট বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বোচ্চ সতর্ক সংকেত। গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে যদি গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তবে হিন্দুকুশ হিমালয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ বরফ ঝরে যাবে। এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জীবনরেখা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য গ্লোবাল উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অনুসারে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে। এই জরুরি সংবাদে লুকিয়ে আছে বিশ্ব জলবায়ুর ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
সূচিপত্র
Toggleগল্পের মূল বিষয়গুলো
২ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে হিন্দুকুশ হিমালয়ের ৭৫ শতাংশ গ্লেসিয়ার বরফ গলতে পারে।
গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখলে ৪০-৪৫ শতাংশ বরফ রক্ষা সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে গ্লেসিয়ার বরফ থাকবে মাত্র ২৪ শতাংশ।
ইউরোপীয় আলপস, নর্থ আমেরিকান রকি, আইসল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বরফ সংকট তীব্র।
গ্লেসিয়ার গলন শতাব্দী ধরে চলতে পারে, যদিও তাপমাত্রা স্থিতিশীল হয়।
২১ জন বিজ্ঞানী ৮টি মডেল ব্যবহার করে ২ লাখের বেশি গ্লেসিয়ার বিশ্লেষণ করেছেন।
ডুশানবেতে চলমান জাতিসংঘের প্রথম গ্লেসিয়ার সম্মেলনে এই গবেষণা প্রকাশিত।
হিমালয়ের হিমবাহ সংকট: গ্লোবাল উষ্ণতা বাড়লে ২১০০ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ বরফ হারানোর আশঙ্কা
বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিমবাহ অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম হিন্দুকুশ হিমালয় (এইচকেএইচ)। এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমুল্য ধন নয়, বরং এশিয়ার প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষের জীবনজীবিকা ও জল সম্পদ নির্ভর করছে এই অঞ্চলের বরফ ও গলিত পানির উপর। কিন্তু সাম্প্রতিক এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যা প্রকাশিত হয়েছে, তা এই অঞ্চলের জন্য এক গভীর উদ্বেগের বার্তা। গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছে, যদি বিশ্ব গড় তাপমাত্রা শিল্পোত্তর যুগের তুলনায় মাত্র ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে ২১০০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের প্রায় ৭৫ শতাংশ গ্লেসিয়ার বরফ গলে যেতে পারে।
এই তথ্য আমাদের জন্য সতর্কবার্তা যে, আমাদের বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে গ্লেসিয়ার সংকট একদিন শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না, বরং এটি জল সংকট, কৃষি ক্ষতি ও জনজীবনে প্রভাব ফেলবে।
হিমালয়ের গ্লেসিয়ার সংকটের গুরুত্ব
হিমালয় পর্বতমালা শুধু দেশের নয়, সমগ্র উপমহাদেশের জলবায়ু ও বাস্তুসংস্থান নির্ধারণ করে। এই অঞ্চলের বরফ গললে শুধু নদীগুলোতে জলবৃদ্ধি হবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে জলস্রোত কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এতে কৃষিক্ষেত্র, পানীয় জলের সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশ্বের নানা অঞ্চলের মতো, এইচকেএইচ-এর গ্লেসিয়ারগুলোও গরম হয়ে আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি হলে এই অঞ্চলের বরফের ৭৫ শতাংশই গলে যাবে। যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা মারাত্মক হতে পারে তার দৃষ্টান্ত।
বিশ্বব্যাপী গ্লেসিয়ার হ্রাসের চিত্র
গ্লোবাল উষ্ণায়ন শুধু হিমালয়ের সমস্যা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন অংশের গ্লেসিয়ার সংকটেরও প্রতিফলন। বর্তমান জলবায়ু নীতিমালা অনুযায়ী উষ্ণতা যদি ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বৃদ্ধি পায়, তাহলে বিশ্বব্যাপী বরফের মাত্র ২৪ শতাংশই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু যদি আমরা প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অনুযায়ী ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই, তবে ৫৪ শতাংশ বরফ বাঁচানো সম্ভব।
বিশেষত ইউরোপের আলপস পর্বতমালা, উত্তর আমেরিকার রকি পর্বত এবং আইসল্যান্ডের গ্লেসিয়ারগুলো এই সংকটে অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধিতে এসব অঞ্চলের বরফের মাত্র ১০-১৫ শতাংশই বাঁচবে। আর সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা হচ্ছে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে গ্লেসিয়ার বরফ সম্পূর্ণরূপে গলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও জলবায়ু স্থিতিশীলতার পরেও সংকট অব্যাহত
গবেষকরা জানান, যদিও বিশ্বে গড় তাপমাত্রা স্থিতিশীল হয়ে আসে, তবুও গ্লেসিয়ার গলনের প্রক্রিয়া থামবে না। বরং এই গলন কয়েক দশক বা শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে অব্যাহত থাকবে। গ্লেসিয়ার বরফ ধীরে ধীরে উচ্চতর জায়গায় সরতে শুরু করবে এবং নতুন সমতল অবস্থানে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে।
এটি বোঝায় যে, এখন যদি আমরা ব্যবস্থা না নেই, তবুও পূর্ববর্তী তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে মানবজীবনে প্রভাব ফেলতে থাকবে। তাই সময় মতো এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণই বাঁচাতে পারে আমাদের পরিবেশ ও জলসম্পদ।
গবেষণার পদ্ধতি ও প্রেক্ষাপট
এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ১০টি দেশের ২১ জন বিজ্ঞানী। তারা ৮টি উন্নত গ্লেসিয়ার মডেল ব্যবহার করে বিভিন্ন উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে বিশ্বের ২ লাখেরও বেশি গ্লেসিয়ার মূল্যায়ন করেছেন। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আজকের জলবায়ু নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই গবেষণা ডুশানবেতে চলমান জাতিসংঘের প্রথম গ্লেসিয়ার সম্মেলনের সময় প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ৫০টির বেশি দেশ অংশগ্রহণ করছে। এই সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী গ্লেসিয়ার সংকট মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে।
এই সতর্কতামূলক গবেষণার ফলাফল আমাদের জন্য ঘুম থেকে জাগানোর আহ্বান। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংকটে পড়বে। বিশ্বের বড় বড় হিমবাহ অঞ্চল হারিয়ে গেলে, এর প্রভাব শুধু প্রাকৃতিক নয়, মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে স্পষ্ট হবে। তাই এই সংকটের গুরুত্ব বুঝে দ্রুত ও সুসংগঠিত পদক্ষেপ গ্রহণই একমাত্র পথ।
হিমালয়ের গ্লেসিয়ার সংকট শুধু একটি আঞ্চলিক নয়, বরং বিশ্বজনীন চ্যালেঞ্জ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্পষ্ট করে দিয়েছে, যদি বিশ্ব তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তবে আমাদের প্রাকৃতিক জলসম্পদ ও জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব পড়বে। গ্লেসিয়ার গলনের এই ধারা রোধ করা এখন সময়ের দাবি। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও সমন্বিত আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাই পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুলে দিতে। পরিবেশ রক্ষায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।