কীভাবে নাগরিক উদ্যোগ বদলে দিতে পারে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশের ভবিষ্যৎ?” আমাদের শহর, আমাদের গ্রাম – প্রতিদিনই একটু একটু করে রং হারাচ্ছে, সবুজ হারাচ্ছে। অথচ কিছু মানুষ নীরবে হাতে হাত রেখে, প্রকৃতির রং-তুলি দিয়ে আঁকছেন নতুন ছবি – পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন। পশ্চিমবঙ্গে এমনই কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক নাগরিক উদ্যোগ আজ বদলে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ।
কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় ধোঁয়া, প্লাস্টিকের স্তূপ আর দূষিত জলধারা—এগুলো যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। তবে এরই মধ্যে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ নাগরিকরা পরিবেশ রক্ষায় অভিনব উদ্যোগ নিচ্ছেন। পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন এখন আর কেবল বড় সংস্থাগুলির কথা নয়, বরং স্থানীয় বাসিন্দারাও নাগরিক উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন।
এখানে প্রশ্ন হলো—আমরা কি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটু সচেতন হলে পরিবেশ রক্ষা করতে পারি? উত্তরটা হল: অবশ্যই পারি!
পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
পৃথিবীর বুক থেকে সবুজের হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু প্রকৃতির রং মুছে যাওয়া নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্নের রং ফিকে হয়ে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার যে চেষ্টা চলছে, তা শুধুমাত্র বর্তমানকে নয়, আগামীকালকেও বাঁচিয়ে রাখছে।
নিঃশ্বাসে বিষাক্ত বাতাসের ছায়া
- শহরের বাতাসে বিষের ছড়াছড়ি: কলকাতার বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা (PM 2.5) আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর এই দূষণের কারণে হাজার হাজার মানুষ শ্বাসজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
- নাগরিক উদ্যোগ: এয়ার পিউরিফায়ার গাছ (স্পাইডার প্ল্যান্ট, স্নেক প্ল্যান্ট) লাগিয়ে ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখার প্রচলন বাড়ছে। কিছু অঞ্চল যেমন সৌদামিনগর এবং জয়নগর-এ স্থানীয় মানুষ রাস্তার ধারে ফল ও ঔষধি গাছ লাগিয়ে বায়ুদূষণ কমানোর চেষ্টা করছেন।
জলসংকটে হাহাকার: নাগরিকের ছোট ছোট প্রচেষ্টা
- পশ্চিমবঙ্গে জলস্তরের অবনতি: সমীক্ষা বলছে, দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ জলস্তর ৪-৫ ফুট নেমে যাচ্ছে।
- নাগরিক উদ্যোগ: কিছু এলাকায় নাগরিকরা বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প চালু করেছেন। যেমন, হাওড়ার গোপালপুরে কিছু বাসিন্দা ব্যক্তিগতভাবে জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যার ফলে তাঁদের এলাকার ভূগর্ভস্থ জলস্তর আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ: বর্জ্য নয়, সম্পদ
- প্লাস্টিক দূষণের মহামারী: ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক প্রায় ৮৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ১৫-২০% পুনঃচক্রণ হয়।
- নাগরিক প্রচেষ্টা: কিছু উদ্যোগী মানুষ প্লাস্টিকের বদলে কাপড় বা পাটের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করেছেন। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে কিছু দোকানদার এখন শুধুমাত্র কাপড়ের ব্যাগে পণ্য দিচ্ছেন।
নবায়নযোগ্য শক্তির আলোয় পথচলা
- বিদ্যুৎ সঙ্কটের সমাধান: রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ৭-৮% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- সৌরশক্তির ব্যবহার: দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু গ্রামে, যেখানে বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে, সেখানে গ্রামবাসীরা সৌরশক্তির ব্যবহার শুরু করেছেন। যেমন, গঙ্গাসাগর মেলা প্রাঙ্গনে সৌরবাতি বসানোর মাধ্যমে বিদ্যুতের চাহিদা কমানো হয়েছে।
পরিবেশবান্ধব কৃষি: বিষমুক্ত ফসলের হাতছানি
- রসায়নিক কৃষির ক্ষতি: পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ কৃষিজমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে।
- জৈবচাষে নাগরিক উদ্যোগ: বীরভূম ও বাঁকুড়ার কিছু কৃষক রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করে ফসল ফলাচ্ছেন। তাঁদের মতে, এতে মাটির স্বাস্থ্য ঠিক থাকছে এবং উৎপাদনও ভাল হচ্ছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নাগরিক সজাগতা
- জঞ্জালের পাহাড়: পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন প্রায় ৪,০০০ টন বর্জ্য জমা হয়, যার বড় অংশই প্লাস্টিক ও ই-ওয়েস্ট।
- নাগরিক উদ্যোগ: কলকাতায় কিছু অ্যাপার্টমেন্টে “ওয়েট” ও “ড্রাই” বর্জ্য আলাদা করার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সল্টলেকের কিছু আবাসনে বর্জ্য থেকে সার তৈরি করা হচ্ছে, যা স্থানীয় বাগানের জন্য ব্যবহার করা হয়।
পরিবেশ সচেতনতা ও শিক্ষা
- অজ্ঞতার প্রাচীর: বেশিরভাগ মানুষ এখনও পরিবেশ সচেতনতার গুরুত্ব জানেন না।
- স্কুল-কলেজে উদ্যোগ: কলকাতার কিছু স্কুলে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেমন, গার্ডেন রিচের একটি স্কুলে ছাত্ররা প্রতি মাসে “সবুজ দিবস” পালন করে গাছ লাগায় এবং প্লাস্টিকমুক্ত অভিযানে অংশ নেয়।