কলকাতার পুরাতন ট্রামপথ নিয়ে ফের উত্তাল শহর। সম্প্রতি চিৎপুর-মহাত্মা গান্ধী রোড সংযোগস্থলে চলমান বিটুমিনাইজেশন ঘিরে এক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে। কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দাবি, এই কাজ সরাসরি কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ অমান্য করছে, যেখানে ট্রামপথে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ ছিল। এই প্রেক্ষিতে দায়ের হয়েছে FIR, সামনে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের শুনানির দিনও। ঐতিহ্য ও উন্নয়নের দ্বন্দ্বে ট্রামপথ আবার আইনি লড়াইয়ের মঞ্চে — আর এই লড়াইয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আদতে কতটা নিরাপদ শহরের ট্রাম-পরিচয়?

📌 স্টোরি হাইলাইটস

  • ট্রামপথ বিটুমিনাইজেশন ঘিরে অভিযোগ, পুরসভার বিরুদ্ধে FIR

  • হাই কোর্টের ‘স্টেটাস কো’ নির্দেশের স্পষ্ট লঙ্ঘন

  • অবিলম্বে কাজ বন্ধ এবং আইনি পদক্ষেপের দাবি

  • তদন্ত দাবি: কারা নির্দেশ দিলেন এই বেআইনি উন্নয়নের?

  • আগামী ২৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত শুনানি

নীরবে, ধীরলয়ে চলতে থাকা কলকাতার ট্রামের গন্তব্য যেন আজ পথভ্রষ্ট। শহরের বুকে শতাব্দীপ্রাচীন এই পরিবহণব্যবস্থার অস্তিত্ব ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু, আর সেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই যেন পৌঁছেছে প্রশাসনিক জটিলতার নতুন মোড়ে। একদিকে আইন, অন্যদিকে ইচ্ছাধীন উন্নয়নের মোড়কে চাপা পড়ছে কলকাতার ঐতিহ্য — সেই অভিযোগেই এবার পুলিশের দ্বারস্থ হলেন শহরের ট্রামপ্রেমীরা।

কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের (CTUA) সভাপতি এবং পেশায় অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী দেবাশিস ভট্টাচার্য রবিবার বারাবাজার থানায় দায়ের করেছেন একটি এফআইআর। তাঁর অভিযোগ, কলকাতা পুরসভার তরফে শহরের অন্যতম প্রাচীন ট্রামপথ চিৎপুর-মহাত্মা গান্ধী রোড চৌরাস্তায় বেআইনিভাবে বিটুমিনাইজেশনের কাজ চলছে — যা সরাসরি লঙ্ঘন করছে কলকাতা হাই কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ।

“আমাদের নজরে এসেছে যে চিৎপুর-মহাত্মা গান্ধী রোডের ট্রামপথে বিটুমিনাইজেশনের কাজ চলছে। ৫ জুলাই এই কাজ শুরু হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। অথচ চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাই কোর্ট একটি মামলার শুনানিতে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল যে যেসব ট্রামপথ এখনো বিদ্যমান, সেগুলোর ক্ষেত্রে স্টেটাস কো বজায় রাখতে হবে, অর্থাৎ সেখানে কোনও ধরনের বিটুমিনাইজেশন করা যাবে না,” — FIR-এ এই ভাষাতেই অভিযোগ জানান দেবাশিসবাবু।

তিনি FIR-এ স্পষ্ট দাবি জানান, “এই বেআইনি কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। যারা আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে তদন্ত করে বের করতে হবে — কার অনুমতিতে এবং কার তত্ত্বাবধানে এই অবাঞ্ছিত বিটুমিনাইজেশন চালানো হচ্ছে।”

এই প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে দেবাশিসবাবু বলেন,

“আমি বিশ্বাস করি, একটি উচ্চ ঘনত্ববিশিষ্ট শহরে টেকসই পরিবহণের সর্বোত্তম পথ হল ট্রাম। মেট্রো রেল যতই দক্ষ হোক, সেটি কেবল করিডর। তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বহু শহর ট্রাম ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবহণ বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটি শুধু আমার মত নয়, বিশ্বের পরিবহণ-বিশেষজ্ঞরা একথা বারবার বলছেন।”

তিনি আরও বলেন,

“ট্রাম ব্যবস্থাকে বন্ধ করা মানেই অপরাধ। আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য ও দলিল রয়েছে যা প্রমাণ করে — ট্রাম একেবারেই পরিবেশবান্ধব, অর্থনৈতিকভাবে সফল এবং শহরের চরিত্রের অংশ। দুর্নীতিই একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে ট্রামকে দুর্বল করে তোলা যায়। উন্নয়নের নামে ঐতিহ্য মুছে দেওয়া একধরনের সামাজিক গাফিলতি।”

এই ঘটনার ভবিষ্যৎ পরিণতি এখন অনেকটাই নির্ভর করছে আদালতের ওপর। দেবাশিসবাবুর কথায়,

“এই বিষয়ে আগামী ২৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে শুনানি নির্ধারিত আছে। সেদিন সর্বোচ্চ আদালতের মন্তব্যের উপর ভিত্তি করেই কলকাতা হাই কোর্ট পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একসময় কলকাতার বুকে অসংখ্য ট্রামরুট বিস্তৃত থাকলেও বর্তমানে কার্যত মাত্র দুটি রুটেই ট্রাম চলে। একমাত্র শহর হিসাবে ভারতের বুকেই কেবল কলকাতা আজও ট্রামচালনার ঐতিহ্য বহন করছে। অথচ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে যে ট্রাম পরিবহণ ট্র্যাফিক জ্যামের একটি বড় কারণ এবং প্রশাসন কেবল একটি রুট পর্যটনের উদ্দেশ্যে রাখার পক্ষপাতী।

এই অবস্থানই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন ট্রামপ্রেমীরা। তাঁদের মতে, কলকাতার শহরজুড়ে ছড়ানো ট্রামপথ শুধু ঐতিহাসিক সম্পদ নয়, বরং পরিবেশ ও অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার দিক থেকেও এটি অপরিহার্য। এখন দেখার, প্রশাসনিক বিবাদ ও আইনি তরজার মাঝখানে শতবর্ষীয় ট্রামপথ তার নিজস্ব গতিপথে আবার ফিরতে পারে কি না।

কলকাতার ট্রাম শুধু এক পরিবহণ ব্যবস্থা নয়, বরং শহরের ইতিহাস, পরিবেশ সচেতনতা ও নাগরিক স্মৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই পরিচয় যখন প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও আইনি নির্দেশ অমান্যের অভিযোগে প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন তা শুধু প্রযুক্তিগত নয় — নৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটও বয়ে আনে। এখন নজর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিকে। ট্রাম কি ফিরবে নিজের সম্মানে, নাকি নগর উন্নয়নের দোহাইয়ে হারাবে তার শেষ চলার পথও — উত্তর দেবে সময়।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply