ভোটার কার্ডে নাম, বাড়ি বাগদায়—কিন্তু নাগরিকত্ব বাংলাদেশের!
বাংলাভাষী পরিচয়ে বছর ত্রিশ ধরে উত্তর ২৪ পরগনার বুকে বসবাসকারী এক ব্যক্তি আসলে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা। পকসো মামলায় ছেলের নাম জড়াতেই ফাঁস হয় গোপন অধ্যায়। রেশন কার্ড থেকে ভোটার আইডি—সবই ছিল ভারতের, কিন্তু পায়ের তলায় ছিল ভিন্ন দেশের মাটি। এ ঘটনা ফের প্রশ্ন তোলে—বাঙালি না বাংলাদেশি? ভাষা-সাম্য কি পরিচয়ের ঢাক কেটে দিতে পারে? প্রশাসনের খাতায় ওঠা এই নাম জানিয়ে দিল, আজকের বিভ্রান্তি শুধু কাগজের নয়—চোখে ধরা পড়া এক জ্বলন্ত বাস্তব।

🧭 Story Highlights :

  • বছর ত্রিশ পশ্চিমবঙ্গের ভোটার ছিলেন রেজাউল মন্ডল, বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতা

  • স্ত্রী শেরফুলের দাবি, তিনি ভারতীয়; রেজাউল তাঁর স্বামী, কিন্তু আসল পরিচয় গোপন করেছিলেন

  • ছেলের বিরুদ্ধে পকসো আইনে মামলা থেকেই পুলিশের সন্দেহ ও তদন্ত শুরু

  • রেজাউলের মা হিসেবে নিজের শাশুড়িকে পরিচয় দেন, তৈরি করেন ভোটার কার্ড

  • ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় নির্বাচন কমিশনের অফিসারদের চোখে পড়ে গরমিল

  • সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় উত্তর ২৪ পরগনায় বাংলাদেশিদের প্রবেশ ও তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে

বিভ্রান্তির জালে বাঁধা বাংলা পরিচয়

বাংলা ভাষা—একটা সংস্কৃতি, একটা গন্ধ, একটা আত্মপরিচয়। কিন্তু আজ এই ভাষাই যেন হয়ে উঠছে সন্দেহের ছায়া। কর্ণাটক, দিল্লি, মহারাষ্ট্র বা আসাম—ভারতের নানা প্রান্তে সম্প্রতি বেঙ্গলি ভাষাভাষীদের বিরুদ্ধে বেআইনি অভিবাসনের অভিযোগে জেরা, তল্লাশি, এমনকি গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটছে। এই বিভ্রান্তিমূলক অভিযানগুলি তুলে ধরছে এক কঠিন প্রশ্ন:

“বাংলা বলা মানেই কি বাংলাদেশি?”

এই প্রশ্ন আজ যেমন আইনি দ্বিধা তৈরি করছে, তেমনই জোর ধাক্কা দিচ্ছে একজন ভারতীয় নাগরিকের আত্মসম্মানে। এই রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা সেই দ্বিধা, আতঙ্ক, এবং সত্যকে পর্দার সামনে আনতে চাই।

🌐 পরিচয়ের ধাঁধা:

“রেজাউল মন্ডল — বছর ত্রিশ ধরে পরিচয়ে ভারতীয়, বাস্তবে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সক্রিয় নেতা।”

সাম্প্রতিক এক পুলিশি অভিযানে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা অঞ্চলে। বছর ত্রিশ ধরে এই জেলার ভোটার পরিচয়পত্রে নাম লেখা এক ব্যক্তি, যিনি কাগজে-কলমে ভারতীয়, আদতে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল বিএনপি-র (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে উঠে এসেছে তদন্তে।

এই অভিযানের সূত্রপাত হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে — রেজাউল মন্ডলের ছেলে ফিরোজের বিরুদ্ধে এক নাবালিকাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ করার অভিযোগ ওঠে। ওই নাবালিকার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পকসো আইনে মামলা রুজু হয়। পুলিশ যখন ফিরোজকে খুঁজতে যায়, তখন একের পর এক তথ্য সামনে আসতে থাকে।

🎭 ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণঃ

“তখন ভাবিনি আমার স্বামী দেশের বাইরের কেউ। বিয়ে হয়েছিল সমাজের চোখে। একসঙ্গে সংসার করেছি। এখন পুলিশ বলছে, উনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন,” — পুলিশের জেরায় এমনটাই জানান রেজাউলের স্ত্রী শেরফুল মন্ডল।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রেজাউল মন্ডল নিজের ভোটার কার্ড তৈরির সময় শেরফুলের মা চেরবানু মন্ডলকে নিজের মা বলে পরিচয় দিয়ে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই পরিচয়েই ভারতীয় নাগরিকত্ব ভোগ করছিলেন।

এক পুলিশ আধিকারিক বলেন,
“প্রথম থেকেই সবকিছু খুব সাবধানে গোপন রাখা হয়েছিল। ভোটার তালিকায় নাম তোলার সময় ফর্ম-৬ ব্যবহার করে ঠিকানায় ত্রুটি করা হয়েছিল যাতে আসল উৎস গোপন থাকে। যখন ফিরোজের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তখনই আস্তে আস্তে সব সামনে আসতে থাকে।”

🏞️ সীমান্তে নজরদারি ও বাংলাদেশ সংযোগ

উল্লেখযোগ্য যে, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত ভাগ করে। গত এক বছরে, বিশেষ করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার পর বিএসএফ এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থা সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিএসএফ সূত্রের মতে,
“২০২৪ সাল থেকেই এই ধরনের বেআইনি অনুপ্রবেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিসেম্বর থেকে জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৩০০ বাংলাদেশি নাগরিককে বিভিন্ন সীমান্ত জেলা থেকে আটক করা হয়েছে।”

এই এলাকাগুলিতে রেশন কার্ড, আধার, এমনকি জন্ম ও মৃত্যু শংসাপত্র জোগাড় করাও এখন খুব একটা কঠিন কাজ নয় বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। স্থানীয় স্তরের দুর্নীতিগ্রস্ত চক্র এবং কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধির সাহায্যেই এই সব সম্ভব হচ্ছে বলে অনুমান।

🧩 পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী ভারতীয় বাঙালিদের জন্য উদ্বেগের বার্তা

এ ধরনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকরা — যাঁরা কেবল বাংলা ভাষায় কথা বলেন বলেই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং আসামে সম্প্রতি বহু ভারতীয় বাঙালিকে “বাংলাদেশি” সন্দেহে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এক বাঙালি প্রবাসী বলেন,
“বাড়ি থেকে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ পুলিশ এসে বলে পরিচয় দাও। আমার দাদার দাদাও এই দেশে জন্মেছেন। অথচ আমরা প্রমাণ করতে পারি না, কারণ নাম বা ভাষা দিয়ে তো দেশ নির্ধারণ হয় না।”

এমন ঘটনাগুলোর ফলে জন্ম নিচ্ছে এক অদৃশ্য অথচ বিষাক্ত ভয়— নিজের রাজ্যের বাইরে বাঙালির পরিচয় যেন হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক সম্ভাব্য সন্দেহের কারণ। আবাসন ভাড়া পেতে সমস্যা, চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য, সামাজিক যোগাযোগে বাধা — এর সবটাই জন্ম নিচ্ছে পরিচয় বিভ্রান্তি থেকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে,
“নির্বিচারে ধরপাকড়ের ফলে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সমাধান হোক প্রোটোকল নির্ধারণ করে, মানুষের মান-সম্মানকে রক্ষা করে।”

বাঙালি না বাংলাদেশি?—এই বিভ্রান্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেমন চ্যালেঞ্জে ফেলছে, তেমনই সমাজে তৈরি করছে অবিশ্বাসের বাতাবরণ। এখনই সময়, প্রশাসন ও সমাজ মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে স্পষ্ট ও সংবেদনশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রকৃত নাগরিকদের সম্মান রক্ষা করে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের যথাযথভাবে চিহ্নিত করে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করে।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply