“বাংলা বললেই বাংলাদেশি?”—এই সরল প্রশ্নটি আজ ভয়ঙ্কর বাস্তবতার রূপ নিচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। কর্ণাটক, দিল্লি, রাজস্থান, অসম—যেখানে-সেখানে বাংলা ভাষাভাষীদের পরিচয় নিয়ে উঠছে সন্দেহ, চলছে পুলিশি তল্লাশি ও যাচাই। ভারতীয় নাগরিকদের প্রমাণ দিতে হচ্ছে নিজেদের ভারতীয়ত্ব! একই ভাষা ও সংস্কৃতির কারণে বিভ্রান্তি বাড়ছে—‘বাঙ্গালী না বাংলাদেশি’ এই পরিচয় সংকট এখন সামাজিক সম্মান ও নাগরিক অধিকারের জন্য বড় হুমকি। সময় এসেছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এই সংকট বিশ্লেষণ করার, ভাষার নামেই যেন না হয় বিচার।

সূচিপত্র

ভাষা আজ অভিশাপ?

আজকের ভারতবর্ষে যেন এক অদ্ভুত দোলাচলে পড়েছে ‘বাংলা’ শব্দটি। যেই কেউ এই মধুর ভাষায় কথা বলছে—হঠাৎ করে তার নাগরিকত্ব নিয়ে উঠছে প্রশ্ন, দৃষ্টিতে জাগছে সন্দেহ। কর্ণাটক থেকে শুরু করে দিল্লি, রাজস্থান, এমনকি অসম—প্রায় প্রতিটি রাজ্যে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে এই ভয়ংকর প্রবণতা।

যেখানে জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি মিলিয়ে গড়ে উঠেছে ভারত, সেখানে শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে মানুষকে আজ ভোগ করতে হচ্ছে হেনস্থার, অসম্মানের ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার। এ যেন এক আত্মপরিচয়ের সংকট, যার বীজ রোপিত হয়েছে বহু বছর আগেই—আজ ফল পাচ্ছে এক বিভ্রান্ত সমাজ।

🧭 ভারতীয় বাঙালিরা কারা?

বাংলা ভাষাভাষী মানেই বাংলাদেশি—এই সরলীকরণ শুধু অজ্ঞতাই নয়, বিপজ্জনকও বটে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খণ্ড, এমনকি ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, হায়দরাবাদ ও বেঙ্গালুরুতেও লক্ষ লক্ষ বাঙালি বসবাস করেন।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ৯ কোটিরও বেশি বাংলা ভাষাভাষী নাগরিক আছেন। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই বহু প্রজন্ম ধরে ভারতের মাটিতে বাস করছেন। তাঁদের পূর্বপুরুষরা এই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন।

তবে কেন হঠাৎ করে এই প্রশ্ন,
“আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?”

🚨 বাংলা মানেই সন্দেহ—পুলিশি তল্লাশির নয়া ট্রেন্ড

পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে জীবিকার খোঁজে যারা ভিন রাজ্যে গেছেন, আজ তাঁদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে এক নিদারুণ বাস্তবতার।

📍 বেঙ্গালুরুতে: হেব্বাল, করমাঙ্গলা, যশবন্তপুর, হালসুর এলাকায় সম্প্রতি বহু বাংলা ভাষাভাষী শ্রমিককে পুলিশ আটক করে পরিচয় যাচাই করেছে। অনেকের বৈধ আধার ও ভোটার আইডি সত্ত্বেও পুলিশ সন্দেহের চোখে দেখছে।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে বেঙ্গালুরুর একটি নির্মাণ সাইট থেকে অন্তত ১২ জন বাংলা ভাষাভাষী শ্রমিককে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। অভিযোগ ছিল—এরা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে এসেছে। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, তাঁদের অধিকাংশই মালদহ ও মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা।

📍 দিল্লিতে: জনকপুরি, আজাদপুর, তুগলকাবাদ—এইসব এলাকায়ও বাংলা ভাষাভাষীদের উপর চলেছে বিশেষ নজরদারি।

📍 রাজস্থানে: কর্মসূত্রে থাকা বাঙালিরা বলছেন—
“এখন আমরা প্রকাশ্যে বাংলায় কথা বলতেও ভয় পাই। সবাই ভাবে আমরা বাংলাদেশি।”

📍আসাম:২০২৩ সালের শেষ দিকে গুয়াহাটির রেল স্টেশন থেকে ধরা হয় এক বাঙালি যুবককে, যিনি বারাসাতের বাসিন্দা এবং আইনি পরিচয়পত্র সহ সফরে ছিলেন। স্থানীয়দের ভাষায়, “বাংলা উচ্চারণেই সন্দেহ”।

এই ঘটনাগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে, কোনও স্থানে বাংলা বললেই তা “সন্দেহের ভাষা” হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকেও মারাত্মক বিপজ্জনক।

📍 উত্তরপ্রদেশের দেওরিয়াতে গ্রেফতার করা হয় ৬ জন শ্রমিককে। অথচ তাঁরা সবাই বৈধ ভারতীয় নাগরিক। পরে মুর্শিদাবাদের জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তাঁদের মুক্তি মেলে।

এই সব ঘটনার পিছনে রয়েছে একটাই কথা—“বাংলা বলছো মানেই তুমি সন্দেহভাজন।”

🌀 ভাষা ও সংস্কৃতির মিল—কেন তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি?

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, নাম, আচার-আচরণ, উচ্চারণ প্রায় একই। খুলনা বা বরিশালের উচ্চারণ হুবহু মেলে বসিরহাট বা ক্যানিংয়ের সঙ্গে। ফলে প্রশাসনিক বা সামাজিক স্তরে অনেকেই বিভ্রান্ত হন।

পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসনের নেই কোনও নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ—যেখানে তারা শিখবেন কিভাবে বৈধ ভারতীয় নাগরিককে আলাদা করবেন একটি বিদেশি অনুপ্রবেশকারীর থেকে। ফলে সমস্যার মূল এখানেই— ভাষা হয়ে উঠছে বিভ্রান্তির উৎস।“বাবুল, আজিজ, মোমিন, রেজাউল, ফেরদৌস — এই নামগুলি কলকাতায় যেমন পরিচিত, তেমনি কুমিল্লা বা নারায়ণগঞ্জেও।”

এক সমাজবিজ্ঞানীর মতে—
“শুধু ভাষা নয়, নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ক্ষেত্রে চাই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বসবাসের ধারাবাহিকতা ও নথিগত বিশ্লেষণ। না হলে জাতিগত বৈষম্য জন্ম নেবে।”

📄 জাল নথি: বাস্তব সমস্যাও আছে

এখানে অস্বীকার করা যাবে না—বস্তুত কিছু বাংলাদেশি নাগরিক, সীমান্তবর্তী এলাকা যেমন উত্তর ২৪ পরগনা, বসিরহাট, কুচবিহার বা নদীয়াকে ঠিকানা বানিয়ে এদেশে অবৈধভাবে বসবাস শুরু করেছেন।

তাঁরা কীভাবে নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করছেন?

  • ভুয়ো আধার কার্ড

  • ভোটার তালিকায় মিথ্যে নাম

  • শংসাপত্রে ভারতীয় আত্মীয়ের পরিচয় ব্যবহার

এই ধরনের অপরাধীদের জন্যই প্রকৃত ভারতীয় বাঙালিরা সন্দেহের মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রশাসনের কাছে এটি চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ—কীভাবে চোরাচালানকারীকে ধরবে অথচ সৎ নাগরিককে হেনস্থা না করে?

💔 মানসিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া: ঘরে থেকেও পরবাসী — একটি গভীর অনুধ্যান

যখন ভাষা আপনার পরিচয়, অথচ সেই পরিচয়ই যদি হয়ে ওঠে সন্দেহের কারণ—তবে কি আপনি সত্যিই নিজভূমে স্বাধীন? আজকের দিনে, বহু ভারতীয় বাঙ্গালী যারা নিজেদের ভবিষ্যতের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে দেশের নানা প্রান্তে পাড়ি দিয়েছেন, তাঁরা ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছেন শুধু তাঁদের ভাষাগত পরিচয়ের জন্য।

ভাড়া বাড়ি নিতে গেলে বলা হচ্ছে—
“বাংলায় কথা বলেন? আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন না তো?”
এমন প্রশ্ন যেন এখন প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বাড়িওয়ালাদের কাছে। শুধুমাত্র ভাষা ও উচ্চারণের কারণে কোনও ভারতীয় নাগরিককে যদি তার পরিচয় বারবার প্রমাণ করতে হয়, তাহলে তা এক গভীর সামাজিক ব্যর্থতার ইঙ্গিত।

একজন প্রবাসী শ্রমিকের স্ত্রী জানান—

“আমার স্বামী বেঙ্গালুরুতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। একদিন তাঁকে পুলিশ রাস্তা থেকে আটক করে। শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার কারণে। তিনি বলেছিলেন উনি মালদার বাসিন্দা, কিন্তু তাতেও ছাড়া মেলেনি। আধার ও ভোটার আইডি দেখানোর পরেও তাঁদের সন্দেহ কাটেনি।”

এই ধরনের মানসিক চাপ শুধু একজন ব্যক্তির ওপর নয়, পুরো একটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মানসিক নিরাপত্তাকে আঘাত করে। শিশুরাও ভয় পাচ্ছে বাংলা বলতে—স্কুলে বাংলায় কথা বললেই সহপাঠী বা শিক্ষক কটূক্তি করছে, এমন অভিযোগও উঠে আসছে।

অনেকে বলছেন—
“এখন তো পরিচয় লুকিয়ে হিন্দিতে কথা বলি, বাংলা বললে অনেকে আড়চোখে দেখে।”
এটি একপ্রকার সাংস্কৃতিক সংকোচ, যা ব্যক্তিগত গর্বকে নষ্ট করছে। শুধু পুলিশি হয়রানি নয়, সমাজের একাংশও আজ বাঙালি পরিচয়ের উপর আস্থা রাখতে পারছে না।

এই পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে যখন কোনও পেশাজীবী, চাকুরিজীবী বা ছাত্র বাংলা উচ্চারণ করায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ভেবে সন্দেহ করা হয়। চাকরির ইন্টারভিউতে, সরকারি নথি তৈরির সময় কিংবা হাসপাতালেও বাংলাভাষীদের প্রতি ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ।

সামগ্রিকভাবে, এই মানসিক অবজ্ঞা এক সাংস্কৃতিক আত্মহননের সূচনা করছে।
একজন অধ্যাপক বলেছিলেন—
“ভাষা যদি বিচারের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তবে গণতন্ত্রের ভিত্তিই কেঁপে ওঠে।”

এ এক আত্মপরিচয়ের ক্ষরণ, যেখানে মানুষ নিজের বাড়িতেই আজ ‘পরবাসী’ হয়ে যাচ্ছে। তাই এই সমস্যার সমাধান কেবল প্রশাসনিক নয়, সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তনও জরুরি।
ভাষা কখনও অপরাধ হতে পারে না—সে হোক বাংলা, তামিল কিংবা মারাঠি।

⚠️ কেন এই সমস্যা এখনই গুরুত্ব পাবে?

→ কারণ এটি কেবল একটি ভাষাগত বিভ্রান্তি নয়, এটি এক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় আকার নিতে পারে। এই সমস্যাটি এখন গুরুত্ব না পেলে এর প্রভাব পড়বে ব্যক্তির অধিকার, সামাজিক সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের উপর।

🔹 আন্তঃরাজ্য সম্পর্কের উপর মারাত্মক প্রভাব

বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতি ভিন রাজ্যে সন্দেহ ও পুলিশি হয়রানি পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে।

  • বাঙালি নাগরিকদের উপর এই আচরণকে অপমান হিসেবেই নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।

  • বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট জন্ম নিচ্ছে, যা ফেডারেল কাঠামোর জন্য ক্ষতিকর।

🔹 সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন

ভারতের সংবিধান স্পষ্টভাবে নাগরিকদের বাসস্থান, কাজ ও যাতায়াতের স্বাধীনতা প্রদান করেছে (ধারা ১৯)।

  • বাংলা ভাষা বলার কারণে যদি কাউকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তা স্পষ্টতই এই অধিকারের বিরোধিতা।

  • এটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর এক বিপজ্জনক চিহ্ন, যেখানে ভাষা হয়ে দাঁড়ায় নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অযৌক্তিক মানদণ্ড।

🔹 সমাজে বিভেদ ও অসহিষ্ণুতার প্রসার

  • যখন এক ভাষাগোষ্ঠীকে বারবার অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন তাদের প্রতি সামাজিক মনোভাব নেতিবাচক হয়ে ওঠে।

  • ফলে তৈরি হয় ভাষাগত হিংসা, অবিশ্বাস ও ঘৃণা, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘর্ষের কারণ হতে পারে।

  • বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা সহাবস্থানের বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে।

🔹 সত্যিকারের সমস্যা থেকে নজর ঘোরানো হচ্ছে

  • দেশজুড়ে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, দুর্নীতি—এই সমস্ত মৌলিক সমস্যা থেকে মানুষের মনোযোগ ঘোরাতে পরিচয় ভিত্তিক বিভ্রান্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

  • এই চর্চা সমাজকে ভুল পথে চালিত করছে—ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দিকে।

🔹 বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অপমান

  • বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়—এটি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজি, বিবেকানন্দের ভাষা।

  • এই ভাষাকে সন্দেহের চোখে দেখা মানে ভারতের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা।

  • দীর্ঘদিনের সংস্কৃতিকে হেয় করা হচ্ছে শুধুমাত্র উচ্চারণ, নাম বা পোশাক দেখে।

🔹 পরবর্তী প্রজন্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব

  • বাংলা ভাষাভাষী শিশুরা যখন দেখে তাঁদের মা-বাবাকে শুধুমাত্র ভাষার কারণে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, তখন তাদের মনে জন্ম নেয় এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ভয়।

  • ভবিষ্যতে তারা হয়তো নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে চাইবে, নিজের সংস্কৃতি ও ভাষা থেকে দূরে সরে যাবে।

🔹 ভবিষ্যতের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের সম্ভাবনা

  • ভাষার ভিত্তিতে মানুষের ওপর অন্যায় আচরণ চলতে থাকলে এক সময় এর থেকে জন্ম নিতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব

  • ভারত যদি তার ভাষাভিত্তিক নাগরিকদের যথাযথ মর্যাদা না দেয়, তবে তা হতে পারে জাতীয় নিরাপত্তারও হুমকি।

এই সংকট মূলে একটি ভাষাকে টার্গেট করে নাগরিকদের ওপর অবিচার করছে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নিলে ভারতের ঐক্যবদ্ধ ও সংবেদনশীল সমাজব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখনই সময়, ভাষাকে ‌‘সন্দেহ’ নয়—‘স্নেহ’ ও ‘সম্মান’-এর চোখে দেখার।

এই কারণগুলিই প্রমাণ করে—‘বাংলা মানেই বাংলাদেশি’ এই ধ্বংসাত্মক বিভ্রান্তি এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। না হলে খুব দেরি হয়ে যাবে।

🛠️ সমাধানের পথ: করণীয় কী?

ভাষার ভিত্তিতে নাগরিকদের সন্দেহ করা বা হয়রানি করা বন্ধ করতে হলে চাই সুসংহত, মানবিক ও কার্যকর প্রশাসনিক ও সামাজিক উদ্যোগ। নিচে সেই দিকগুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:

পুলিশ প্রশাসনের কাছে চাই স্পষ্ট প্রোটোকল

ভাষা নয়, নাগরিকত্ব নির্ধারণে নথি, দীর্ঘমেয়াদি বসবাস ও সামাজিক পরিচয় হবে মূল ভিত্তি।

🔸 পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে কিভাবে ভাষা ও নাগরিকত্ব আলাদা করতে হয়, এবং শুধুমাত্র উচ্চারণ বা উপভাষা দেখে বিচার না করতে।
🔸 আধার, ভোটার আইডি, প্যান ও স্থায়ী ঠিকানার মতো সরকারি নথির ভিত্তিতে যাচাই করতে হবে।
🔸 সন্দেহজনক ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন বা রাজ্য স্তরের হেল্পলাইন ও যাচাইকারী টিমের সাহায্য নেওয়া উচিত।

📌 “সন্দেহ নয়, প্রমাণ-ভিত্তিক তদন্ত হোক মূল নীতি।”

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন

ভিন রাজ্যে থাকা বাঙালিদের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষায় নিজ রাজ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

🔹 প্রতিটি বড় শহরে (যেমন দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই) বাংলা হেল্পডেস্ক চালু করতে পারে রাজ্য সরকার।
🔹 হেল্পডেস্কে থাকা আধিকারিকরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তবিক পরিচয় যাচাই ও হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
🔹 এছাড়া, প্রবাসী বাঙালিদের রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যারা ইচ্ছা করলে স্বেচ্ছায় নাম নথিভুক্ত করে নিজেদের প্রয়োজনের সময় সহায়তা চাইতে পারবেন।

📌 “ঘরে না থাকলেও, সরকার পাশে আছে—এই বার্তা পৌঁছাতে হবে প্রবাসীদের কাছে।”

সামাজিক সংগঠন ও মিডিয়ার দায়িত্ববোধ বাড়ানো জরুরি

ভাষাভিত্তিক বিদ্বেষ থামাতে হলে দরকার সামাজিক সচেতনতা ও জনমত গঠনের উদ্যোগ।

🔸 মিডিয়া হাউসগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে, যাতে বিভ্রান্তি না ছড়ায় বরং স্পষ্ট বার্তা যায়।
🔸 সামাজিক সংগঠন, ছাত্র সংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাতে হবে।
🔸 স্কুল, কলেজে ভাষাভিত্তিক বৈচিত্র্য ও সহনশীলতা বিষয়ে ওয়ার্কশপ ও সেমিনার চালু করা দরকার।

📌 “ভাষা বৈচিত্র্য নয়, তা ভারতের গৌরব—এই বার্তাই দিতে হবে সমাজকে।”

প্যান-ইন্ডিয়া ডেটা কো-অর্ডিনেশন সিস্টেম গড়ে তোলা জরুরি

এক রাজ্য যেন অন্য রাজ্যের বৈধ নাগরিককে ‘সন্দেহভাজন’ না ভাবে, তার জন্য দরকার সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার।

🔹 আধার, ভোটার তালিকা, জন্মনিবন্ধন, স্থায়ী ঠিকানা প্রভৃতি তথ্য একত্র করে রাজ্যস্তরে ও কেন্দ্রীয়ভাবে একটি যাচাইযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে।
🔹 পুলিশ ও নাগরিক পরিষেবা সংস্থাগুলো একই তথ্যভাণ্ডার থেকে যাচাই করতে পারলে বিভ্রান্তির সুযোগ থাকবে না।
🔹 রাজ্য সরকারের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেন কোন নাগরিককে অকারণে হয়রানির শিকার না হতে হয়।

📌 “এক দেশ, এক পরিচয়—কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে নয়, নথির ভিত্তিতে।”

এই সমস্যার সমাধান এক দিনে হবে না, কিন্তু সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ থাকলে এই পরিচয়-সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
এখন সময়, যাতে ভারতীয় বাঙালিরা দেশের যে কোনও প্রান্তে নির্ভয়ে বাংলায় কথা বলতে পারেন, নিজের পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে পারেন। ভাষা কোনও অপরাধ নয়—তা সম্মানের প্রতীক।

একটি ভাষা কেবলমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়, তা একটি পরিচয়ের ভিত্তি, একাধিক প্রজন্মের আত্মমর্যাদার প্রতীক। আজ সেই বাংলা ভাষা হয়ে উঠেছে সন্দেহের ছায়া, পুলিশের চোখে ‘পরিচয় যাচাইয়ের সংকেত’। অথচ বাস্তব হল—সব বাংলা ভাষাভাষী বাংলাদেশি নন, অনেকেই এই দেশেরই প্রকৃত নাগরিক। ভাষার মিল মানেই নাগরিকত্বের গুলিয়ে ফেলা এক চরম ভুল।

তাই এখনই প্রয়োজন সচেতনতা, সংবেদনশীলতা ও সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক নীতিমালা, যাতে ভারতীয় বাঙালির অধিকার রক্ষা হয়—আর ভাষা কোনও নাগরিককে সন্দেহের কাঠগড়ায় না দাঁড় করায়।
বাংলা বললেই বাংলাদেশি—এই ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতেই হবে।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply