কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক চাঞ্চল্যকর হাতাহাতির ঘটনায় গ্রেফতার হন এক দম্পতি—যাঁরা অভিযোগের তীর তুলে দেন হাসপাতালের চিকিৎসা-ব্যবস্থার দিকে। কিন্তু সেই অভিযোগ মুছে যায় ধস্তাধস্তি, চিৎকার আর পুলিশের হস্তক্ষেপে। নিরাপত্তাকর্মীর পোশাক ছিঁড়ে যাওয়া, কর্তব্যে বাধা, সরকারি কর্মীর শ্লীলতাহানি—সব মিলিয়ে উত্তপ্ত হয় চত্বর। এই ঘটনা শুধু গ্রেফতার দম্পতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রশ্ন তোলে হাসপাতালের নিরাপত্তা এবং রোগী-পরিজন সম্পর্কের ভঙ্গুর বাস্তবতা নিয়েও। একাধিক জটিল প্রশ্নে জড়িয়ে এই ঘটনা রয়ে গেছে শহরের আলোচনার কেন্দ্রে।
সূচিপত্র
Toggle📸 ঘটনার সূত্রপাত: ভিডিও রেকর্ডিং নিয়ে বিবাদ
শনিবার বিকেল ৩:২৫ নাগাদ, রাহমত আলি হাসপাতাল চত্বরে ভিডিও রেকর্ড করছিলেন। হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মী ও CNMC আউটপোস্টের অফিসাররা তাঁকে রেকর্ডিং বন্ধ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু রাহমত আলি অভিযোগ করেন যে, তাঁর আত্মীয়কে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না এবং তিনি সেই বিষয়ে ভিডিও প্রকাশ করবেন বলে হুমকি দেন। এই সময়ে তাঁর স্ত্রী তনুজাও অফিসারদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন।
হাতাহাতি ও গ্রেফতার: কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে অপ্রীতিকর মুহূর্ত
কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে হাতাহাতি এবং গ্রেফতার দম্পতি– এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে তৈরি হয়েছে আলোড়ন। চলুন খতিয়ে দেখা যাক ঘটনার প্রতিটি সূক্ষ্ম দিক—
🧷 ঘটনাস্থলে সম্পা সরকার: দায়িত্ব পালনে বিপদ
কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মী সম্পা সরকার, যিনি কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে নিয়মিত নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসেন।কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার বদলে আরও উগ্র হয়ে ওঠে।সম্পা সরকারের অভিযোগ—তাঁকে শারীরিকভাবে ধাক্কা দেওয়া হয়, এবং তাঁর ইউনিফর্ম ছিঁড়ে যায়, যা একপ্রকার সরকারি কর্মীর অসম্মান।
🧷 হাতাহাতি ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ
পুলিশ এই ঘটনাকে সরকারি কর্তব্যে বাধা, মহিলার উপর আক্রমণ, এবং শ্লীলতাহানির প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করে।কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে এই ধরণের প্রকাশ্য অপ্রীতিকর ঘটনা হাসপাতালের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে।গ্রেফতার দম্পতি বারবার নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেও, পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইনগত পদক্ষেপ নিতে পিছপা হয়নি।
🧷 মামলা ও গ্রেফতার: আইন নিজের পথে
সম্পা সরকারের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে, বেনিয়াপুকুর থানায় রাহমত আলি ও তনুজার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি ধারায় মামলা রুজু করা হয়।এরপরেই দু’জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পরে গ্রেফতার দম্পতি হিসেবে আদালতে তোলা হয়।
হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ: কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে হাতাহাতি ও গ্রেফতার দম্পতি প্রসঙ্গে বাস্তব চিত্র
কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে হাতাহাতি ও গ্রেফতার দম্পতি ঘটনার পিছনে লুকিয়ে আছে বহুদিনের একটি উপেক্ষিত অথচ জ্বলন্ত সমস্যা—হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বেহাল দশা। চলুন খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক এই ‘রোগী-চিকিৎসক দ্বন্দ্ব’ আর ‘নিরাপত্তার ফাঁকফোকর’-এর আসল চালচিত্র।
🟧 বারবার ঘটছে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা
কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে হাতাহাতি বা ধাক্কাধাক্কির ঘটনা একক নয়।
গেল দু’মাসে কমপক্ষে তিনটি ঘটনায় মাতাল রোগীর আত্মীয়রা জুনিয়র ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলেন।
সাম্প্রতিক গ্রেফতার দম্পতির ঘটনায় পরিষ্কার বোঝা গেল, সিকিউরিটির উপস্থিতি স্রেফ কাগজে কলমে, মাঠে তার কার্যকারিতা প্রায় নেই।
❝ একজন রোগী আত্মীয় যদি নির্ভয়ে পোশাক ছিঁড়ে দিতে পারে একজন সিকিউরিটি মহিলার, তবে প্রশ্ন উঠবেই—কী আছে চত্বরে? ❞
🟧 CCTV আছে, কিন্তু নজরদারি নেই
CNMC-র মতো প্রিমিয়ার মেডিকেল কলেজে কমবেশি ৬০টি CCTV ক্যামেরা রয়েছে, কিন্তু তাদের রিয়েল টাইম মনিটরিং প্রায় শূন্যের কোঠায়।
এই ঘটনার সময়েও ভিডিও ফুটেজ থাকলেও কেউ লাইভ ফিড দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়নি, যা হাসপাতালের নজরদারি ব্যবস্থার উপর আস্থা নষ্ট করে।
🟧 নিরাপত্তাকর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব
নিরাপত্তা রক্ষীদের বড় অংশই অস্থায়ী নিয়োগভিত্তিক, যাঁদের প্রশিক্ষণ দুর্বল, আর মানসিক প্রস্তুতি প্রায় নেই বললেই চলে।
সম্পা সরকার ছিলেন সেই দিনে একমাত্র নারী কর্মী, যিনি একাই সামলাতে গিয়েছিলেন আক্রমণাত্মক দম্পতিকে—এ এক রকমের “ডিউটিতে পাঠাও, বাঁচুক কি মরুক” সংস্কৃতি।
🟧 হাসপাতালের প্রশাসনিক নীরবতা
পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে দৃশ্যত উদ্যোগী হয়নি।
এমনকি, গ্রেফতার দম্পতির ঘটনার আগেও অন্তত দু’বার ওয়ার্ডে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল — কিন্তু কোনও দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
এই প্রশাসনিক ‘কানে তুলো’ সংস্কৃতি হাসপাতালের অভ্যন্তরে বিপজ্জনক সাহস জোগায় উচ্ছৃঙ্খল পরিজনদের মধ্যে।
🟧 আইন আছে, প্রয়োগ নেই
সরকারি হাসপাতাল চত্বরে কর্তব্যরত কর্মীর উপর হামলা হলে আইনের ধারা স্পষ্ট—Section 353 (assault on public servant)।
কিন্তু প্রশ্ন হল, গ্রেফতার দম্পতি ঘটনা ছাড়া আগের মামলাগুলো কতদূর গড়ায়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ অভিযোগ নেয়, পরে বিষয়টি ‘মিউচুয়াল স্যরি-সরি’য় মেটে।
এই সংস্কৃতি দোষীদের উৎসাহ দেয়, আর কর্তব্যরত কর্মীরা ক্রমেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
🟧 প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের
✅ কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে হাতাহাতি ও গ্রেফতার দম্পতি ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়—
প্রতিটি হাসপাতাল চত্বরে চাই পেশাদার নিরাপত্তা সংস্থা।
CCTV-এর রিয়েলটাইম মনিটরিং এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া টিম।
আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ, শুধুমাত্র থানায় গিয়ে নাম লেখালে চলবে না।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য চাই মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা—শুধু শারীরিক নয়।
হাসপাতাল চত্বর শুধুই চিকিৎসার জায়গা নয়, সেটা রোগী, চিকিৎসক ও কর্মীদের মানসিক শান্তিরও জায়গা। কিন্তু কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে হাতাহাতি ও গ্রেফতার দম্পতি-র মতো ঘটনা প্রমাণ করে, এই শান্তি আজ শুধু কল্পনায় রয়ে গেছে। আর তা বদলাতে না পারলে, আগামী দিনে হাসপাতালগুলি চিকিৎসার জায়গা থেকে পরিণত হবে বিশৃঙ্খলার মঞ্চে।