পশ্চিমবঙ্গের শিল্পনীতি নিয়ে ফের তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকার সম্প্রতি এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা ব্যবসা-বাণিজ্য মহলে গভীর অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। “The Revocation of West Bengal Incentive Schemes and Obligations in the Nature of Grants and Incentives Bill 2025”–এর মাধ্যমে ১৯৯৩ সাল থেকে কার্যকর হওয়া সমস্ত প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে ইতিমধ্যেই প্রাপ্ত সুবিধাগুলিও বাতিল হয়েছে।
Story Highlights (Read Box)
Act Name: The Revocation of West Bengal Incentive Schemes and Obligations in the Nature of Grants and Incentives Bill 2025
Effective From: ১৯৯৩ সাল থেকে কার্যকর হওয়া সমস্ত প্রণোদনা বাতিল
Industrial Loss: দালমিয়া ও বীরলা গ্রুপের সম্মিলিত ক্ষতি প্রায় £430 কোটি
Legal Challenge: শিল্প সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা, আইনটি ‘অসাংবিধানিক’ দাবি
Key Impact: বিনিয়োগ কাঠামো, সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ও অর্থায়নে বড় ধাক্কা
প্রত্যাহারের বিস্ময়কর পদক্ষেপ
রাজ্য সরকার দাবি করেছে এই পদক্ষেপ সমাজকল্যাণের স্বার্থে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিল্পমহল বলছে, এ সিদ্ধান্ত “অভূতপূর্ব” এবং “অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক”। শিল্পমহলের এক কর্তা বলেছেন,
“আমরা রাজ্যের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন হঠাৎ প্রণোদনা প্রত্যাহার ব্যবসার পরিকল্পনাকে ভেঙে দিচ্ছে।”
দালমিয়া ও বীরলা গ্রুপের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় £430 কোটির ক্ষতির কথা জানিয়েছে। অন্য সংস্থাগুলির ক্ষতির হিসাব এখনও প্রকাশ পায়নি।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পপতিদের আস্থা হারানোর ইতিহাস নতুন নয়। বামফ্রন্ট আমলে ধর্মঘট, ইউনিয়নবাদের দাপট ও শিল্পপতিদের উপর হামলা শিল্পকে দুর্বল করে তোলে। এক সময়ের শিল্পরাজ্য ধসে পড়ে। সিংহানিয়ারা দিল্লি, বীরলারা মুম্বইয়ে চলে যান।
পরে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সিঙ্গুর আন্দোলনের জেরে টাটা মোটরস রাজ্য ছেড়ে চলে যায়। কেন্দ্রের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ২০১১ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ৬৬০০ সংস্থা, যার মধ্যে ১১০টি তালিকাভুক্ত, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়েছে।
প্রণোদনার প্রয়োজনীয়তা
অর্থনীতির তত্ত্ব বলছে বাজার ব্যর্থ হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে প্রণোদনার প্রয়োজন হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিবছর অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যবসায়িক কর ছাড় দেয়। ভারতে কেন্দ্রের Production Linked Incentives (PLI) স্কিমের মাধ্যমে প্রায় £1.97 লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগ £1.76 লাখ কোটিতে পৌঁছেছে এবং বড় আকারের ইলেকট্রনিক্সে এফডিআই ২৫৪% বেড়েছে।
এক অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন,
“যেখানে কেন্দ্র আক্রমণাত্মকভাবে বিনিয়োগ আনতে চাইছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই আইন শিল্পকে আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে।”
আইন রক্ষার যুক্তি কেন দুর্বল
রাজ্য সরকারের যুক্তি, এই অর্থ সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় হবে। কিন্তু শিল্পপ্রণোদনা প্রত্যাহার অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনকে দুর্বল করে এবং নতুন বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। কোসের ‘The Nature of the Firm’–এর মতে, মানবসম্পদকে দক্ষভাবে সংগঠিত করে অর্থনৈতিক উৎপাদন বাড়ায় মূলত শিল্পই।
রাজ্যের শিল্প বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই পিছিয়ে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে রাজ্যে এফডিআই এসেছে মাত্র ২,৫৩৪ কোটি টাকা, ভারতের শীর্ষ ১০ রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ নেই। এর পরেও “The Revocation of West Bengal Incentive Schemes and Obligations in the Nature of Grants and Incentives Bill 2025” শিল্পপতিদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করছে।
সংবিধানের আত্মার পরিপন্থী
আইনের ৩ নং ধারা অনুযায়ী ১৯৯৩ সাল থেকে কার্যকর হওয়া সমস্ত প্রণোদনা প্রত্যাহার, বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে। ৪ নং ধারা অনুযায়ী পূর্বের কোনও অঙ্গীকার বা আদালতের রায় থেকেও রাজ্য দায়মুক্ত থাকবে এবং অতিরিক্ত বিতরণকৃত প্রণোদনা জমির রাজস্ব বকেয়া হিসেবে আদায় করা যাবে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে,
“এই পদক্ষেপ promissory estoppel ও legitimate expectation–এর মত নীতি লঙ্ঘন করছে। এটি অসাংবিধানিক।”
এটি অনুচ্ছেদ ১৪ ও ১৯(১)(গ)-এর পরিপন্থী বলে দাবি উঠেছে।
রাজ্য ও শিল্পের সংকট
তৃণমূল সরকারের কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে সরে আসা, সিবিআইয়ের সাধারণ সম্মতি প্রত্যাহারসহ নানা পদক্ষেপে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ইতিমধ্যেই তিক্ত। রাজ্যে পুলিশ প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় মাত্র ৯৭.৬৬ জন, যা শিল্পের নিরাপত্তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অপ্রতুল।
এক শিল্প প্রতিনিধি বলেছেন,
“রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ও শিল্পের অবস্থা দুটোই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। প্রণোদনা প্রত্যাহার এই অবস্থা আরও খারাপ করবে।”
জনগণের ক্ষতি
পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক ঘাটতি রাজ্যের জিএসডিপির ৩৮% ছুঁয়েছে। ব্যক্তিপ্রতি আয় জাতীয় গড়ের ৮৩.৭%। গ্রামীণ ও শহুরে ব্যয় ভারতের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তরে। বহু-মাত্রিক দারিদ্র্যের হার এখনও বেশি, যা উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের তুলনায় দুর্বল অবস্থানে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেখানে কেন্দ্রের বৃদ্ধির গতিকে সমর্থন না করে উল্টে শিল্পপ্রণোদনা প্রত্যাহারের পথে হেঁটেছে, সেখানে “The Revocation of West Bengal Incentive Schemes and Obligations in the Nature of Grants and Incentives Bill 2025”–এর ফলে রাজ্যের শিল্প বিনিয়োগ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির গাড়ি যখন দ্রুত চলছে, তখন রাজ্যের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে শিল্পক্ষেত্রে গভীর সংকট তৈরি করতে পারে এবং রাজ্যের সাধারণ মানুষ তার মূল ভুক্তভোগী হবে।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো