কোভিড-১৯ মহামারির দিনগুলোতে বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ওষুধ উৎপাদন এক অচলাবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। মূল কারণ—ফিটাল বোভাইন সিরাম (FBS)-এর সরবরাহ ভেঙে পড়া। গরুর ভ্রূণের রক্ত থেকে সংগৃহীত এই উপাদানটি সেল কালচার মিডিয়ার অপরিহার্য অংশ। টেস্ট কিট থেকে ভ্যাকসিন, এমনকি ক্যানসার প্রতিরোধী ওষুধের উৎপাদন—সবখানেই এর প্রয়োজন। ঠিক সেই সংকটের মুহূর্তেই সুযোগ চিনে নিয়েছিল একটি তরুণ প্রতিষ্ঠান—Genexis Biotech। ২০১৯ সালে সূচনা করা এই সংস্থা ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিল—প্রাণী-মুক্ত প্রোটিন তৈরির।
নৈতিকতা থেকে প্রযুক্তি: নতুন পথের সন্ধান
Genexis Biotech-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ডিরেক্টর বিপুল কুমারের ভাষায়—
“ইনসুলিন একসময় শূকরের অগ্ন্যাশয় থেকে সংগ্রহ করা হত, কিন্তু আজ তা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি হয়। তাহলে এফবিএস-এর বিকল্প কেন নয়? গরু সীমাহীন সম্পদ নয়। শুধু নৈতিকতার প্রশ্নই নয়, টেকসই দিক থেকেও এটি সমস্যাজনক।”
এই বক্তব্য যেন প্রকল্পটির মূলে থাকা দর্শনের প্রতিফলন। প্রতিষ্ঠানটি গরুর পরিবর্তে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রোবকে ব্যবহার করছে প্রোটিনের জৈব-কারখানা হিসেবে।
প্রযুক্তির মেরুদণ্ড: মাইক্রোব ফ্যাক্টরি
বিপুল কুমার আরও ব্যাখ্যা করেন—
“আমরা প্রথমে ব্যাকটেরিয়াকে এমনভাবে প্রকৌশল করি যাতে তা দক্ষতার সঙ্গে প্রোটিন উৎপাদন করতে পারে। এটাই আমাদের প্রযুক্তির মূল ভিত্তি।”
এই প্রযুক্তি শুধু গরুর বিকল্প নয়, ভবিষ্যতের প্রোটিন উৎপাদনের দিশা হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছে।
প্রসার নিউট্রাসিউটিক্যালস ও বায়োকসমেটিক্সে
প্রোটিন উৎপাদনের পাশাপাশি Genexis Biotech নিউট্রাসিউটিক্যালস ও বায়োকসমেটিক্সের ক্ষেত্রেও কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি-এজিং ক্রিমের মতো পণ্য, যা বর্তমানে প্রাণীর হাড় থেকে সংগৃহীত কোলাজেনের বিকল্প হাজির করছে। ফলে প্রাণী নির্ভরতা হ্রাসের পাশাপাশি প্রসাধনী ও স্বাস্থ্যপণ্য শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হচ্ছে।
খরচ কমানো ও উৎপাদন বৃদ্ধি
প্রতিষ্ঠানটি ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনের ক্ষমতা ৩০ থেকে ৫০ গুণ বাড়িয়েছে। এর ফলে প্রোটিন উৎপাদনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কেবল তাই নয়, Genexis Biotech তাদের প্ল্যাটফর্ম প্রযুক্তি উৎপাদন ও ডাউনস্ট্রিম প্রক্রিয়ার জন্য পেটেন্ট করার উদ্যোগও নিয়েছে।
সিরামের বিকল্প: বৈজ্ঞানিক সাফল্য
কুমারের মতে—
“আমাদের তৈরি সিরামে এমন এক ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া গেছে, যা বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন সিরাম-ফ্রি সেল কালচার মিডিয়ার বিকল্প হতে পারে। এটি নানা ধরনের প্রাণী কোষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
এটি নিঃসন্দেহে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
ব্যবসা-টু-ব্যবসা মডেল
কোম্পানিটি ব্যবসা-টু-ব্যবসা মডেলে পরিচালিত হয়। পণ্য সরাসরি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা অথবা ডিলার চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রি হয়। যদিও Genexis Biotech সেবা প্রদান করে না, তবুও প্রাথমিক ফর্মুলেশন ক্লায়েন্টদের দেওয়া সম্ভব। সংস্থা ওরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার মডেলেও কাজ করতে আগ্রহী, যেখানে উপাদান সরাসরি সরবরাহ করা যায়।
দেশীয় বিকল্পের পথে অগ্রগতি
গত এক বছরে Genexis Biotech রিকম্বিন্যান্ট গ্রোথ ফ্যাক্টর, পেপটিডেজ ও সেল কালচার রিএজেন্ট তৈরি করেছে। কুমারের মতে, ভারত বর্তমানে এই ধরনের পণ্যের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে দেশীয় বিকল্প তৈরি হওয়া ভারতের জৈবপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে এক বড় পদক্ষেপ।
স্মার্ট প্রোটিন উদ্যোগ
বায়োই-৩ (Biotechnology for Economy, Environment, and Employment) নীতি চালুর মাধ্যমে সরকার এখন স্মার্ট প্রোটিন উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। জমি, জল ও শক্তির ব্যবহার কমিয়ে এ ধরনের প্রোটিন উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে, যা পুষ্টিগত ঘাটতি ও প্রোটিন সংকট মোকাবিলায় কার্যকর হবে।
সরকারি সহায়তা ও বিনিয়োগ
২০২৩ সালে Genexis Biotech গুজরাট সরকারের সঙ্গে এমওইউ সই করেছে রিকম্বিন্যান্ট প্রোটিন উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। সম্প্রতি স্টার্টআপটি জিভিএফএল ও বেঞ্জাই১০-এর অংশগ্রহণে ₹৪ কোটি সিড ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আগামী দিনে Genexis Biotech বায়োরিঅ্যাক্টর ক্ষমতা বৃদ্ধি, ডাউনস্ট্রিম প্রসেসিং অবকাঠামো তৈরি এবং নতুন স্মার্ট প্রোটিন ও রিকম্বিন্যান্ট পেপটিডেজ এনজাইম বাজারে আনার পরিকল্পনা করেছে। ইতিমধ্যেই ভাদোদরায় তাদের সার্টিফায়েড ক্লাস ১০,০০০ ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট চালু হয়েছে এবং জিএমপি-সম্মত ইউনিট গড়ার প্রস্তুতিও চলছে।
👉 এই সংস্কারমূলক পদক্ষেপে স্পষ্ট, Genexis Biotech শুধু বিকল্প প্রোটিন তৈরির চেষ্টা করছে না, বরং নৈতিকতা, স্থায়িত্ব ও প্রযুক্তির এক নতুন যুগের সূচনা করছে।
প্রাণী-মুক্ত প্রোটিন এখন আর কেবল গবেষণার সীমাবদ্ধ অধ্যায় নয়, বরং এক বাস্তব দিশা। জেনেক্সিস বায়োটেক দেখিয়ে দিয়েছে—মাইক্রোবের বায়ো-ফ্যাক্টরি হতে পারে নৈতিক, সাশ্রয়ী ও টেকসই সমাধান। চিকিৎসা, পুষ্টি ও প্রসাধনীতে এর ব্যবহার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। এ উদ্যোগ প্রমাণ করছে, প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগেই তৈরি হতে পারে এমন ভবিষ্যৎ, যেখানে বিজ্ঞান ও মানবতার সমন্বয়ে গড়ে উঠবে প্রাণী-মুক্ত প্রোটিনের এক স্থায়ী ভরসা।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো