কলকাতার ব্যস্ত জীবনের ভিড় থেকে মুক্তি পেতে দূরে নয়, হাতের নাগালেই লুকিয়ে আছে স্বল্প খরচের স্বপ্নময় ঠিকানা। টাকি থেকে গরপঞ্চকোট—প্রকৃতির কোলে, পাহাড়-নদী-ইতিহাসে ভরা এই স্থানগুলো মাত্র পাঁচ হাজার টাকার মধ্যেই এনে দেবে শান্তি, রঙিন দৃশ্য ও তাজা বাতাসের স্বাদ। স্বল্প বাজেটে অবকাশযাপনপ্রেমীদের জন্য এই গন্তব্যগুলি কেবল ছুটি নয়, বরং এক অনাবিল প্রশান্তির আহ্বান। শহরের ধোঁয়া আর হট্টগোল ছেড়ে সুলভ ব্যয়ে কোথায় মিলবে প্রকৃতির কোলে নির্ভেজাল সময়, তারই উত্তর এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণতালিকা।
শহরের বাইরে পাঁচ হাজার টাকায় শান্তির খোঁজে
শহরের কোলাহল, ধোঁয়া আর যান্ত্রিক রুটিনের মাঝে আমরা প্রায়ই ভাবি—
“ইশ! যদি কিছুদিনের জন্য সবকিছু ছেড়ে নিরিবিলিতে চলে যেতে পারতাম!”
যাদের বাজেট সীমিত, তাদের কাছে ভ্রমণ মানেই বড় খরচের ভাবনা। কিন্তু, কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথেই এমন কিছু গন্তব্য আছে, যেখানে বাজেট পাঁচ হাজারের মধ্যে মিলবে ইতিহাস, প্রকৃতি, নদীর ধারে শান্তি, পাহাড়ি হাওয়া আর গ্রামবাংলার স্নিগ্ধতা। স্বাধীনতা দিবসের সপ্তাহান্তে, হোক তা একক সফর বা পরিবার-বন্ধুর সঙ্গে, এই ছয়টি ঠিকানা আপনার জন্য হতে পারে নিখুঁত পালাবদল।
ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি — ঔপনিবেশিক বাংলার স্মৃতি
উত্তর ২৪ পরগনার বুকে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি।
“যদি আপনি কলকাতার সব রাজবাড়ি দেখে ফেলেও তৃপ্ত না হন, তবে ধান্যকুড়িয়ার ডাক উপেক্ষা করা কঠিন,” বলছেন স্থানীয়রা।
নব্য-ধ্রুপদী স্থাপত্যে গড়া এই প্রাসাদের দরজা সম্প্রতি খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্য। সাশ্রয়ী মূল্যের হোমস্টেতে থেকে মিলবে প্রাচীন বাংলার আবহ।
যাওয়ার উপায়: সিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোকাল, কঙ্করা মির্জানগর, সেখান থেকে ই-রিকশা/অটো। অথবা উল্টাডাঙা থেকে বসিরহাটগামী বাসে।
বাজেট: রুম ₹১২০০-১৫০০, খাবার ₹৬০০, যাতায়াত ₹৪০০-৫০০।
দর্শনীয় স্থান: গায়েন বাগানবাড়ি, বল্লভ ম্যানশন, রশমঞ্চ, চন্দ্রকেতুগড়, কাচুয়া ধাম।
গাদিয়াড়া — তিন নদীর আলিঙ্গন
হুগলি, দামোদর ও রূপনারায়ণ নদীর মিলনস্থল গাদিয়াড়া যেন এক শান্ত চিত্রপট।
“সূর্য যখন নদীর জলে ডুবে যায়, মনে হয় সময় থেমে গেছে,” বলেন নিয়মিত ভ্রমণকারীরা।
এখানে আছে ১৮শ শতকে লর্ড ক্লাইভের গড়া ফোর্ট মর্নিংটনের ধ্বংসাবশেষ, আর কাছেই গড়চুমুক হরিণ উদ্যান।
যাওয়ার উপায়: হাওড়া থেকে উলুবেড়িয়া, সেখান থেকে গাড়ি/অটো/ট্রেকার। এসপ্ল্যানেড থেকেও বাসে গাদিয়াড়া রুটে যাওয়া যায়।
বাজেট: হোটেল ₹১০০০-১৭০০, খাবার ₹৫০০-৬০০, যাতায়াত ₹১০০০।
টাকি — ইছামতীর ধারে দিনের অবকাশ
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত টাকি, ইছামতীর শান্ত স্রোতের ধারে সময় কাটানোর জন্য বিখ্যাত। এখানে নৌবিহার, জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, ডাচ কবরস্থান আর দুর্গাপূজায় দুই দেশের প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
“টাকির ছানার মালপোয়া না খেলে সফর অসম্পূর্ণ,” জানায় স্থানীয় অতিথিশালা মালিকেরা।
যাওয়ার উপায়: সিয়ালদহ থেকে টাকি রোড স্টেশন, অথবা এসপ্ল্যানেড থেকে বাস।
বাজেট: হোটেল ₹৫০০ থেকে, খাবার ₹৫০০-৬০০, যাতায়াত ₹২০০০।
দর্শনীয় স্থান: গোলপাটা বন, ইকো পার্ক, পুবের বাড়ি।
গরপঞ্চকোট — পাহাড়ের কোলে ধ্বংসাবশেষ
পুরুলিয়ার গরপঞ্চকোটে পাহাড়, বাঁধ ও ইতিহাস একসঙ্গে মিলেছে। পঞ্চকোট রাজবংশের প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, জোরবাংলা মন্দির, কঙ্কালী মাতা মন্দির—সব মিলিয়ে এটি প্রকৃতিপ্রেমী ও ইতিহাসপিয়াসীদের জন্য সমান আকর্ষণীয়।
“এখানে দাঁড়িয়ে আপনি সময়ের স্তরগুলো দেখতে পাবেন,” বলেন স্থানীয় গাইডরা।
যাওয়ার উপায়: হাওড়া থেকে বর্ধমান-আসানসোল হয়ে ট্রেন, অথবা এসপ্ল্যানেড থেকে এসবিএসটিসি বাসে আসানসোল।
বাজেট: হোটেল ₹৮০০-১০০০, খাবার ₹৫০০-৬০০, যাতায়াত ₹২০০০।
দর্শনীয় স্থান: পাঞ্চেত বাঁধ, জয়চণ্ডী পাহাড়।
আউসগ্রাম — বাউল সুরে ভেসে থাকা গ্রামবাংলা
বর্ধমানের আউসগ্রামে খোলা মাঠ, কাঁচা রাস্তা, কাদামাটির ঘর, আর বাউল সঙ্গীতের অনবদ্য পরিবেশ—সব মিলিয়ে এটি এক অন্যরকম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। বনবাগ্রাম বাউল আশ্রমে থাকতে পারবেন, শুনতে পারবেন সরাসরি বাউল গান।
“এখানে সময় মাপা হয় সুরের তালে, মিনিটে নয়,” হাসেন আশ্রমের বাউল শিল্পীরা।
যাওয়ার উপায়: হাওড়া থেকে গুসকরা স্টেশন, সেখান থেকে অটো/ই-রিকশা।
বাজেট: রুম ₹২০০০-২৫০০ (তিনবেলা খাবারসহ), যাতায়াত ₹৫০০-৬০০।
দর্শনীয় স্থান: চাঁদনি জলটুঙ্গি, সমন্তপাড়া বন, ওড়গ্রাম ফরেস্ট দামু।
মুকুটমনিপুর — বাঁধ, পাহাড় আর সন্ধ্যার রঙ
বাঁকুড়ার মুকুটমনিপুরে কংসাবতী বাঁধের নীল জলাশয় ঘিরে আছে পাহাড় আর অরণ্যের শান্ত প্রান্তর। এখানে নৌবিহার, বাঁধের ধারে হেঁটে বেড়ানো আর সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা অবিস্মরণীয়।
“পাহাড়ের গায়ে যখন সন্ধ্যার আলো পড়ে, মনে হয় প্রকৃতি নিজেই ছবি এঁকেছে,” বলেন এক পর্যটক।
যাওয়ার উপায়: হাওড়া থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস বা অরণ্যক এক্সপ্রেসে বাঁকুড়া, সেখান থেকে গাড়িতে ২-৩ ঘণ্টা।
বাজেট: হোটেল ₹১৬০০-১৭০০, খাবার ₹৫০০-৬০০, যাতায়াত ₹২০০০।
স্বল্প বাজেটের ভ্রমণ শুধু সঞ্চয়ের উপায় নয়, বরং মন ও শরীরকে নতুন করে সাজিয়ে নেওয়ার এক সহজ রাস্তা। টাকি থেকে গরপঞ্চকোট—প্রতিটি গন্তব্যই প্রমাণ করে, বিলাসিতা নয়, প্রকৃতিই হল আসল বিলাস। শহুরে কোলাহলের বাইরে অল্প খরচে মিলতে পারে শান্তির ঠিকানা, স্মৃতির খোঁজ আর প্রকৃতির অবাধ সান্নিধ্য। এই স্থানগুলো দেখিয়ে দেয়, আনন্দের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন নেই—প্রয়োজন কেবল সঠিক নির্বাচন আর মুক্ত মন।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো