আমেরিকার সদ্য ঘোষিত সিদ্ধান্ত—ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জেরে ‘secondary sanctions’-এর হুমকি ছুঁড়ে দিয়েছে আমেরিকা। অথচ সেনসেক্সে নেই বড়সড় পতন, । ৭ আগস্ট, সেনসেক্স দিনের শেষে সামান্য ০.১ শতাংশ বেড়ে উঠে যেন এক নীরব বার্তা দিয়ে গেল—চাপ থাকলেও আতঙ্ক নয়। বরং মোদি সরকার দেখাচ্ছে সুসংহত কূটনৈতিক কৌশল। বিরোধীরাও পাশে। রপ্তানি, কৃষি ও রুপি বিপদে পড়লেও, প্রতিক্রিয়া শান্ত ও কৌশলভিত্তিক। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—ভারতের নিরুত্তাপ ভঙ্গিমা কি ট্রাম্পের শুল্কনীতি ব্যর্থ করে দিচ্ছে? আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যুদ্ধের জমিতে এক অনবদ্য মস্তিষ্কের লড়াই চলছে—যেখানে ধৈর্যই হয়ে উঠছে ভারতের প্রধান অস্ত্র।

এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের পটভূমিতে এক নতুন মোড় এসেছে ভারতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। অনেকদিন পর বিরোধী দল ও সরকার এক কণ্ঠে কথা বলেছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের স্বার্থরক্ষা নিয়ে।

“এই শুল্ক আসলে অর্থনৈতিক ব্ল্যাকমেল,” কড়া ভাষায় জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তাঁর মতে, ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে তেল কেনাবেচা কোনও বেআইনি পদক্ষেপ নয়, বরং একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌম অধিকার।

এই মন্তব্যের রেশ টেনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও জানিয়ে দেন তাঁর অবস্থান।

“ভারতের কৃষক, মৎস্যজীবী ও পশুপালকদের স্বার্থের সঙ্গে কখনোই আপস করা হবে না। আমি জানি এর জন্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে মূল্য দিতে হতে পারে, তবুও আমি প্রস্তুত,” মোদির এই বিবৃতিতে স্পষ্ট যে বিষয়টি শুধুই অর্থনীতি নয়, বরং দেশের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন।

📊 শুল্কে অর্থনৈতিক ধাক্কার আশঙ্কা

বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা মরগান স্ট্যানলি হিসাব দিয়েছে—যদি এই শুল্ক পুরোপুরি কার্যকর হয়, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (GDP) ৬০ বেসিস পয়েন্ট বা প্রায় $২৩ বিলিয়নের ক্ষতি হতে পারে।

অন্যদিকে, দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাঙ্কের গবেষণা শাখা SBI জানাচ্ছে, যদি মার্কিন ডেইরি পণ্য ভারতে প্রবেশের অনুমতি পায়, তবে কৃষিপণ্যের দামে ধস নামবে। এর প্রভাবে ভারতীয় অর্থনীতিতে $২০ বিলিয়নের ভার নেমে আসবে, যার সিংহভাগই বহন করতে হবে কৃষকদের।

🇮🇳 ভারত থেকে আমেরিকায় রপ্তানির চিত্র (২০২৪)

ক্ষেত্ররপ্তানি মূল্যমোট রপ্তানির শতাংশ
ইলেকট্রনিক্স$১১.১ বিলিয়ন১৪.৩%
রত্ন ও গয়না$৯.৯ বিলিয়ন১২.৮%
ঔষধ$৮.১ বিলিয়ন১০.৪%
যন্ত্রাংশ$৬.২ বিলিয়ন৮%
পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম$৫.৮ বিলিয়ন৭.৫%

এই তালিকায় থাকা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই এখন শঙ্কার ছায়ায়। রত্ন ও গয়না শিল্পের মুখপাত্র জানিয়েছেন, “এই শুল্ক কার্যকর হলে আমাদের পক্ষে রপ্তানি বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। শিল্প ধসে পড়তে পারে।”

মাছ রপ্তানিকারকরা ইতিমধ্যেই ২৫% শুল্কে প্রতি বছর প্রায় $৩ বিলিয়নের লোকসানের সম্ভাবনা দেখছেন। আর বস্ত্রশিল্প, যার বড় অংশ শ্রমনির্ভর, আগামী কয়েক মাসে $৫ বিলিয়নের অর্ডার হারানোর পূর্বাভাস দিচ্ছে।

📉 রুপির চাপে প্রাথমিক আঘাত, পরোক্ষে লাভও

আদিত্য বিড়লা মিউচুয়াল ফান্ডের প্রধান বিনিয়োগ আধিকারিক মহেশ পাটিল বলছেন,
“রুপি দুর্বল হতে বাধ্য এই পরিস্থিতিতে। তবে একদিক দিয়ে এই দুর্বল রুপি রপ্তানিকারকদের জন্য একটা সুযোগ হয়ে উঠতে পারে, যা কয়েক মাস পরে তার প্রভাব দেখাবে।”

ভারত-আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যানও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ:

বিবরণমূল্য (২০২৪)
মোট বাণিজ্য$২১২.৩ বিলিয়ন
পণ্য বাণিজ্য$১২৯ বিলিয়ন
পরিষেবা বাণিজ্য$৮৩.৪ বিলিয়ন
পণ্য বাণিজ্যে আমেরিকার ঘাটতি$৪৫.৮ বিলিয়ন
পরিষেবা বাণিজ্যে আমেরিকার উদ্বৃত্ত$১০২ মিলিয়ন

এইখানেই বিশ্লেষকদের প্রশ্ন—যেখানে পরিষেবা খাতে আমেরিকা লাভবান হচ্ছে, সেখানে কেন পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক চাপানো হলো?

🌍 কূটনীতি ও মধ্যপন্থার খেলা

বেইজিং বা ব্রাসিলিয়ার মত রণহুংকার নয়, বরং ভারত কৌশলগত অপেক্ষা ও কূটনীতির পথ বেছে নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি একদিকে চীন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অন্যদিকে রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।

পররাষ্ট্র মন্ত্রক সরাসরি প্রশ্ন তুলেছে—“আমেরিকা নিজেরাই রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো কতটা ন্যায্য?”

ট্রাম্পের উপদেষ্টা পিটার নাভারো অভিযোগ করেছেন, ভারত আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য করে সেই টাকা রুশ তেলের জন্য ব্যবহার করছে। যদিও ভারতের রিফাইনারিরা জানিয়েছে, লেনদেন হচ্ছে মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিরহামে।

🕰️ অপেক্ষার ২১ দিন

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, ২১ দিনের মধ্যে পূর্ণ ৫০% শুল্ক কার্যকর হবে। এই সময়টুকুকেই ভারতের আলোচনার সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভারতের প্রাক্তন WTO দূত অঞ্জলি প্রসাদ বলেন,
“এই অবস্থায় কেবল একক প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট নয়। আমাদের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সংখ্যা থাকলেই শক্তি আসবে।”

এদিকে ট্রাম্পের আসন্ন বৈঠক রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ইউক্রেনের জেলেনস্কির সঙ্গে। যদি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনও সমাধান হয়, তাহলে ভারতের রুশ তেল কেনার প্রশ্নও হারিয়ে যাবে গুরুত্বহীনতায়।

এই মুহূর্তে, ভারতীয় অবস্থান যেন ঘূর্ণিঝড়ের আগে গভীর নিস্তব্ধতা—চোখ খোলা, কান খাড়া, কিন্তু পদক্ষেপ নয়… এখনই নয়।
“সময়ই বলবে, কোন পথে যাবে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক,” মন্তব্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের।

ভারতের উপর শুল্ক চাপিয়ে ও তেল আমদানির ইস্যু তুলে ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে, তাতে আপাতত ভ্রুক্ষেপ করছে না দিল্লি। বরং সংযত কূটনীতির পথে, সময়কে নিজের অনুকূলে ব্যবহার করার কৌশলে অটল থেকেছে ভারত। শেয়ার বাজারের স্থিরতা, বিরোধী দলগুলোর ঐক্য, এবং প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা—সব মিলিয়ে ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, সে শুধু প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে না, বরং নিজের শর্তে খেলতে প্রস্তুত। এখন প্রশ্ন, এই চাপ ও পাল্টা কৌশলের খেলায় শেষ হাসি কে হাসবে—ওয়াশিংটন না দিল্লি?
সময়ই তার জবাব দেবে।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply