তামিলনাড়ুর গঙ্গাইকোন্ডা চোলপুরম শিব মন্দিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পুজো, ইতিহাস ও রাজনীতির মিশ্র এক মুহূর্তে পরিণত হয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে আদি তিরুবাধিরাই উৎসব উপলক্ষে রাজেন্দ্র চোলা-I-র ১০০০ বছর পূর্তি স্মরণে প্রকাশিত হয়েছে একটি স্মারক মুদ্রা। সম্রাটের সামুদ্রিক জয়যাত্রা, চোল সাম্রাজ্যের গরিমা ও দ্রাবিড় সংস্কৃতির উজ্জ্বলতা—সব একত্রে জড়িয়ে এই সফরের মধ্যে। নির্বাচনের আগমুহূর্তে এই ঐতিহাসিক আবহ রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে—যেখানে ইতিহাস, ভক্তি ও কৌশলী পদক্ষেপের নাট্যমঞ্চে মিলেছে এক মোহনীয় দৃশ্যপট।

🔶 STORY HIGHLIGHTS

• প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পুজো দিলেন গঙ্গাইকোন্ড চোলপুরমে
• রাজেন্দ্র চোলা-I-র স্মরণে ১০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মারক মুদ্রা প্রকাশ
• আদি তিরুবাধিরাই উৎসব এবং শিব ঠাকুরের উপাসনা
• রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বার্তার এক যুগপৎ বহিঃপ্রকাশ
• তামিলনাড়ু নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সফরের তাৎপর্য

তামিলনাড়ুর প্রাচীন মাটি, যেখানে ইতিহাস আজও নিঃশব্দে কথা বলে, সেই ভূমিতেই রবিবার পা রাখলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর সফরের গন্তব্য ছিল গঙ্গাইকোন্ডা চোলপুরমের শিব মন্দির—একটি স্থাপত্য কাব্য, একটি ধর্মীয় তীর্থ, আবার এক বিস্মৃত সাম্রাজ্যের অতুল মহিমার সাক্ষ্যবহনকারী। ইউনেস্কো ঘোষিত এই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী মন্দির শুধু এক স্থাপত্য নিদর্শন নয়, বরং চোল সাম্রাজ্যের বিজয়গাথার অক্ষয় স্মারক।

সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এই বিশেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রকাশ করেন একটি স্মারক মুদ্রা—ভারতের ইতিহাসে এক অমোঘ নাম, সম্রাট রাজেন্দ্র চোলা-I-কে শ্রদ্ধা জানিয়ে। রাজেন্দ্র চোলার কিংবদন্তীতুল্য সামুদ্রিক অভিযানের ১০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই উৎসব ও স্মরণানুষ্ঠান যেন ইতিহাসের অন্ধকার কোণে আলো ফেলে দিল আবার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন,


“রাজা রাজা চোলা এবং রাজেন্দ্র চোলা-I হলেন সেই দুই মহান পুরুষ, যাঁদের নাম ভারতের গর্ব ও পরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।”
তাঁর ঘোষণা ছিল—তামিলনাড়ুতে রাজা রাজা চোলা ও রাজেন্দ্র চোলার সম্মানে নির্মিত হবে তাদের বিশাল মূর্তি, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁদের কীর্তির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।

এই সফরের তাৎপর্য শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক মন্দির পরিদর্শন নয়। রাজেন্দ্র চোলা-I-র তৈরি এই মন্দির শুধু ধর্ম নয়, এক রাজনৈতিক মহত্ত্ব, এক সাংস্কৃতিক দৃঢ়তা ও এক সামরিক সাহসিকতার প্রতীক। ইতিহাসবিদ কে.এ. নিলকান্ত শাস্ত্রী লিখেছিলেন—
“গঙ্গাইকোন্ডা চোলপুরম, অর্থাৎ ‘গঙ্গা জয়ী চোলের নগরী’, ছিল দক্ষিণ ভারতের নতুন শক্তির এক নিরব ঘোষণা।”
এই নাম ছিল আত্মবিশ্বাসের ভাষ্য, বিজয়গর্বের প্রতিচ্ছবি।

রাজেন্দ্র চোলার রাজত্বকাল (১০১৪-১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিল এক মহাকাব্যিক অধ্যায়। গঙ্গার তীর পর্যন্ত তাঁর বিজয়যাত্রা, পাল সাম্রাজ্যের পতন, এবং তারপর নির্মিত হয় গঙ্গাইকোন্ড চোলপুরম—এক নতুন রাজধানী, এক জলাধার ‘চোলগঙ্গম’, এক তরল বিজয়স্তম্ভ। তাঁর এই গর্ব যেন স্থাপত্যের ভাষায় জীবন্ত হয়ে ওঠে মন্দিরের অলংকরণে, স্তম্ভে, সুউচ্চ গর্ভগৃহে।

তাঁর পিতা, রাজা রাজা চোলা-I, তাঞ্জোরে নির্মাণ করেছিলেন বিখ্যাত ব্রিহদেশ্বর মন্দির। রাজেন্দ্র চোলার এই মন্দির সেই ধারা বজায় রেখে আরও অলংকৃত, আরও সূক্ষ্ম। শাস্ত্রী লিখেছেন,
“তাঞ্জোরের মন্দির ছিল গরিমায় উজ্জ্বল, গঙ্গাইকোন্ডা চোলপুরমের মন্দিরে সেই গরিমায় সংযোজিত হয়েছে কৃশতা, কোমলতা ও রাজকীয় সৌন্দর্য।”

এই মন্দিরেই পালিত হয় ‘আদি তিরুবাধিরাই’ উৎসব। আদি মাসের তিরুবাধিরাই নক্ষত্র, যা শিবের সঙ্গে যুক্ত, এবং বিশ্বাস করা হয় এটি রাজেন্দ্র চোলার জন্ম নক্ষত্র। এই দিন তাঁকে সম্মান জানিয়ে হয় থেরুকুথু বা পথনাট্য, যেখানে তাঁর জীবনের কাহিনি অভিনীত হয়, আর তাঁর মূর্তিতে পরানো হয় নতুন রেশমি পোশাক। উৎসবের মধ্যেই জেগে ওঠে ইতিহাস, আর ইতিহাসের মধ্যেই মিশে যায় ধর্মের আবেগ।

তবে শুধু ধর্ম বা ইতিহাস নয়, এই সফর ঘিরে রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। একদিকে তামিল সংস্কৃতির গর্ব, অন্যদিকে দ্রাবিড় পরিচয়ের আবেগ—এই দুটি স্তম্ভেই ভর করে দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি। রাজেন্দ্র চোলা ও রাজা রাজা চোলাকে সামনে এনে হিন্দু শক্তির গৌরবের বার্তা যেমন দেওয়া যায়, তেমনই তাঁদের দ্রাবিড় শিকড় তুলে ধরা যায় সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় হিসাবে।

শাস্ত্রী তাঁর বইয়ে বলেন,
“উত্তর ভারত যখন বিভাজিত ও দুর্বল, এবং ইসলামিক আক্রমণে পর্যুদস্ত, তখন দক্ষিণ ভারতে রাজা রাজা ও রাজেন্দ্র চোলা এনে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক ঐক্য, স্থাপন করেছিলেন এক দুর্ভেদ্য সামুদ্রিক শক্তি।”
সুতরাং, এই সাম্রাজ্য ছিল একযোগে হিন্দু ও দ্রাবিড় গর্বের প্রকাশ।

তামিলনাড়ুতে আগামী বছর নির্বাচন। বিজেপি রাজ্যে প্রবেশ করতে চায় শক্তি সঞ্চয়ে, আর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন দ্রাবিড় পরিচয়ের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এই আবহে প্রধানমন্ত্রীর সফর ও ঘোষণাগুলি নিছক সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক নয়, বরং নির্বাচনী ময়দানে এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ বলেই বিশ্লেষণ করছে রাজনৈতিক মহল।

একটি মন্দির, এক উৎসব, এক সম্রাট—আর সেই আড়ালে ইতিহাস ও রাজনীতির সূক্ষ্ম সুর। গঙ্গাইকোন্ড চোলপুরম যেন ফের একবার ভারতবর্ষকে মনে করিয়ে দিল, ইতিহাস কখনও নিঃশব্দ নয়। তা প্রতিধ্বনি তোলে, যদি কণ্ঠ থাকে শুনবার মতো।

গঙ্গাইকোন্ডা চোলপুরমে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিছক এক ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কৌশলের এক সূক্ষ্ম সংমিশ্রণ। রাজেন্দ্র চোলার সাম্রাজ্যগাথা ও দ্রাবিড় গর্বের আবহে মোদীর উপস্থিতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে অতীতের মহিমা কিভাবে বর্তমানের রাজনৈতিক বুননে প্রভাব ফেলে। শিবভক্তি, ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও স্মারক মুদ্রা প্রকাশের মধ্যেও স্পষ্ট বার্তা—তামিল মন জয় করতে ইতিহাসই এখন রাজনৈতিক অস্ত্র। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসুক, গঙ্গাইকোন্ড চোলপুরম এই মুহূর্তে হয়ে উঠেছে শুধু ধর্মস্থল নয়, রাজনৈতিক বার্তার মঞ্চ।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply