হুগলি নদীর বুকে ছুটে চলেছে কলকাতার প্রথম বিদ্যুৎচালিত জলমেট্রো ‘ঢেউ’, যা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে দিচ্ছে শহরের জলপথ অভিজ্ঞতা। গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্সের নির্মাণে ও IIT খড়গপুরের নকশায় তৈরি এই আধুনিক জলযান মিলেনিয়াম পার্ক থেকে দক্ষিনেশ্বর পর্যন্ত ২০-২৫টি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানের পাশ দিয়ে ভেসে চলে। এসি ও নন-এসি কেবিন, ওপেন ডেক, স্ন্যাক্স বক্স ও সংগীতসহ নানা আনন্দঘন পরিসেবায় ‘ঢেউ’ হয়ে উঠেছে এক আকর্ষণীয় ও সাশ্রয়ী নদীপথ ভ্রমণের নতুন উপায়।

★ স্টোরি হাইলাইটস ★

  • প্রথম বিদ্যুৎচালিত জলমেট্রো ‘ঢেউ’ যাত্রা শুরু করে জানুয়ারি ২০২৫-এ

  • নির্মাতা: গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স (GRSE)

  • প্রযুক্তিগত সহযোগিতা: IIT খড়গপুর

  • মোট আসন ১০০টি: ৭০টি নন-এসি (₹২০০), ৩০টি এসি (₹৩০০)

  • যাত্রাপথ: মিলেনিয়াম পার্ক থেকে দক্ষিনেশ্বর — নদীপথে ২০-২৫ দর্শনীয় স্থান

  • তিনটি ওপেন ডেক, সামনের ডেকে প্রবেশ নির্ভর করে নিরাপত্তা কর্মীর অনুমতির উপর

  • যাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে স্ন্যাক্স বক্স এবং সংগীত পরিবেশ

  • পরিষ্কার, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও ফটোগ্রাফি অনুমোদিত যাত্রা

কলকাতার বুক চিরে বহমান হুগলি নদী শুধুই একটি জলধারা নয় — এটি স্মৃতি, সংস্কৃতি আর শহরের আত্মার অংশ। আর সেই নদীপথেই সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির এক অভিনব সংযোজন — বিদ্যুৎচালিত জলমেট্রো ‘ঢেউ’। জানুয়ারিতে উদ্বোধনের পর ছয় মাস পেরিয়ে আজ এই আধুনিক নৌযান শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়, হয়ে উঠেছে এক রোমাঞ্চকর সফরের নাম। এটি যেন নদীর বুকের বুকে নেমে আসা এক তরঙ্গিত কবিতা, যেখানে মিলেছে প্রকৃতি, প্রযুক্তি আর শহরের নদীমাতৃক ইতিহাস।

Kolkata Water Metro | A ride on Kolkata's first water metro Dheu on Hooghly  from Millennium Park to Dakshineswar - Telegraph India

ঢেউয়ের গঠন ও সফরের স্বাচ্ছন্দ্য

IIT খড়গপুরের নকশায় নির্মিত ক্যাটামারান-ভিত্তিক এই জলযানটি শুধুই বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, অভ্যন্তরেও তার নকশায় ছড়িয়ে রয়েছে নান্দনিকতা ও কার্যকরী পরিকল্পনা। ‘ঢেউ’-এর ভিতরে পা রাখলেই চোখে পড়ে দুটি স্বতন্ত্র অংশ — একটি ৭০ সিটের নন-এসি কেবিন এবং অন্যটি ৩০ সিটের এসি কেবিন।

নন-এসি কেবিনে হালকা ফোম কুশনযুক্ত সাধারণ আসন, আরাম কিছুটা সীমিত হলেও বড় জানালার মাধ্যমে নদীর হাওয়া গায়ে মেখে নেওয়া যায়। গরমের দিনে ফ্যানের সহায়তায় চলে সফর। টিকিট মূল্য এখানে ₹২০০।

অন্যদিকে, এসি কেবিন যেন এক প্রশান্তির অভিজ্ঞান। ₹৩০০ দামের টিকিটে যাত্রীরা উপভোগ করতে পারেন উড়ানের আদলে সাজানো আরামদায়ক আসন আর পরিষ্কার কাঁচের জানালা দিয়ে অপরূপ হুগলি দর্শন। কাঠের ফ্রেমে বাঁধা নন-এসি কেবিনের জানালার তুলনায় এখানকার দৃশ্য অনেক বেশি খোলা ও জীবন্ত।

উন্মুক্ত ডেকে নদীর সঙ্গে আলাপ

এই জলমেট্রোতে রয়েছে তিনটি খোলা ডেক — দুটি পেছনের দিকে, একটিমাত্র সামনের দিকে। যেখানে পেছনের ডেকগুলি সকলের জন্য উন্মুক্ত, সামনের ডেকে ওঠা নির্ভর করে নিরাপত্তাকর্মীদের নির্দেশের উপর।

যাত্রাপথে বেশিরভাগ যাত্রীকেই দেখা যায় ডেকে উঠে পড়তে — হাওয়ার ছোঁয়া, নদীর শব্দ, শহরের রেখাচিত্র এবং আকাশের বদল তাদের দৃষ্টি জুড়ে থাকে সফরজুড়ে।

Kolkata Water Metro | A ride on Kolkata's first water metro Dheu on Hooghly  from Millennium Park to Dakshineswar - Telegraph India

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ভেসে চলা

‘ঢেউ’ মিলেনিয়াম পার্ক থেকে যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে দক্ষিনেশ্বরের দিকে। এই যাত্রাপথে হুগলির তীরে অবস্থিত একের পর এক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের পাশে ভেসে চলে জলযানটি।

কুমোরটুলির ঘাট, বাবুঘাট, হাওড়া স্টেশন, বেলুড় মঠ, দক্ষিনেশ্বর কালীমন্দির — প্রতিটি স্থান যাত্রার সময় onboard ঘোষণার মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। যেন নদীর বুক থেকে চোখে চোখ রেখে ইতিহাস পড়ার সুযোগ!

নিরাপত্তায় আশ্বাস, নির্দেশনায় কিছু অভাব

প্রতিটি আসনের নিচে রাখা আছে লাইফ জ্যাকেট এবং অতিরিক্ত জীবাণুসুরক্ষা ব্যবস্থা। উপস্থিত রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ নিগমের নিরাপত্তাকর্মীরাও।

তবুও, অনেক যাত্রীর মতে, শুরুতেই একটি সংক্ষিপ্ত নিরাপত্তা ডেমো থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ত। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে — তার প্রাথমিক জ্ঞান থাকা জরুরি বলেই মনে করেন অনেকে।

উপভোগের উপকরণ ও যাত্রার ছন্দ

একটি মাত্র টিকিটে মিলছে ছোট্ট খুশির প্যাকেট — মার্বেল কেক, ভুজিয়া, সবজি চপ আর একটি বোতল জল। সেই সঙ্গে রয়েছে হালকা সংগীতের সৌন্দর্য, যা যাত্রাকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।

যাত্রাপথে ফটো এবং ভিডিও তোলার অনুমতি থাকায় তরুণ প্রজন্ম ও পর্যটকদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে একটি ইনস্টাগ্রাম-যোগ্য অভিজ্ঞতা। ভিড়ের মধ্যেও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে বলে দেখা গেছে।

Kolkata Water Metro | A ride on Kolkata's first water metro Dheu on Hooghly  from Millennium Park to Dakshineswar - Telegraph India

যাত্রীদের মুখে ঢেউয়ের কথা

সাধনা ঘোষ, হাওড়ার বাসিন্দা বলেন,

“একটা প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রা। যদি শৌচালয় থাকত, তাহলে বয়স্ক যাত্রীদের জন্য সুবিধা হত। দক্ষিনেশ্বরে অল্প সময় দাঁড়ালেও অনেক উপকারে আসত।”

বন্দনা দত্ত, একই জেলার যাত্রী জানান,

“জীবন্ত সঙ্গীত থাকলে তো অভিজ্ঞতা আরও উপভোগ্য হতো। এটা এখনই খুব ভালো, কিন্তু আরও রঙিন করে তোলা যেত।”

মৌমিতা দাস, লেক টাউনের বাসিন্দা বলেন,

“নন-এসি অংশে বসার ব্যবস্থা আর জানালার দৃষ্টিভঙ্গি একটু বাড়ানো গেলে ভালো হতো। সঙ্গে যদি অতিরিক্ত স্ন্যাক্স কেনার সুযোগ থাকত, তাহলে অনেকের উপকারে আসত।”

সময়সূচি ও সহজ টিকিট ব্যবস্থাপনা

মিলেনিয়াম পার্কের প্রবেশপথের পাশে থাকা টিকিট কাউন্টার থেকে সহজেই টিকিট সংগ্রহ করা যায়। সপ্তাহে সোমবার, মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার একটি ট্রিপ — বিকেল ৪.৩০টায়।

আর ছুটির দিন ও সপ্তাহান্তে দু’টি ট্রিপের ব্যবস্থা — দুপুর ১.৩০টায় ও বিকেল ৪.৩০টায়।

‘ঢেউ’ কেবল একটি বিদ্যুৎচালিত জলযান নয়, এটি কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী সংযোজন। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, সাশ্রয়ী যাত্রা, ভ্রমণসুলভ পরিসেবা ও দর্শনীয় স্থানগুলিকে ঘিরে সাজানো যাত্রাপথ — সব মিলিয়ে এটি শহরের জলপথকে নতুন করে চেনাচ্ছে। সরকারি পরিচালনায় পরিষ্কার ও নিয়মিতভাবে চালিত এই জলমেট্রো পর্যটক ও নাগরিকদের কাছে হয়ে উঠছে এক সুখকর অভিজ্ঞতা। হুগলি নদীর ঢেউয়ের মতোই ‘ঢেউ’ ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তির স্নিগ্ধতা ও পরিবেশের সুর। সময় এসেছে নদীকে ঘিরে শহরকে নতুন চোখে দেখার।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে ও শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুন” ফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন—একসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

 

Leave a Reply