চীনের উৎপাদন খাত আবারও প্রবল চাপের মুখে। জুন মাসে প্রযোজক মূল্য সূচক (PPI) ৩.৬% হ্রাস পেয়ে পৌঁছেছে দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে, যা শিল্প খাতে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। ভোক্তা ব্যয় প্রায় স্থবির, রপ্তানি আদেশে টান, আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন শুল্কে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। শিল্পে মূল্যযুদ্ধ, প্রযুক্তি খাতে ছাড়ের ঝড়—সব মিলিয়ে বেজিংয়ের সামনে এক কঠিন পথচলা। ব্যাংক সুদ কমানোর সম্ভাবনা থাকলেও, অস্থিরতা রয়ে গেছে। এই অর্থনৈতিক সংকট কী চীনের স্থিতি নাড়িয়ে দেবে? বিষয়টি গভীরভাবে ভাবনার।
📌 স্টোরি হাইলাইটস
জুনে চীনের প্রযোজক মূল্য সূচক (PPI) ৩.৬% হ্রাস – ২০২৩ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন
তৃতীয় মাসের মতো কারখানাগুলির উৎপাদন সংকুচিত
ভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) মাত্র ০.১% বৃদ্ধি – দুর্বল চাহিদার ইঙ্গিত
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কে রপ্তানি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস
মূল্য যুদ্ধ, ভর্তুকি এবং বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির আশঙ্কা
চীনের অর্থনৈতিক ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা যেন আরও একবার বড় প্রতিকূলতার সামনে এসে পড়েছে। নতুন পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জুন মাসে চীনের উৎপাদন খাতে সংকট গভীরতর হয়েছে। মূল্য পতন, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও আমেরিকার সঙ্গে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনা চীনের অর্থনীতির ওপর একযোগে চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।
দুর্বল অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং উদ্বেগজনক প্রযোজক মূল্য পতন
চীনের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (NBS) সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রযোজক মূল্য সূচক বা ফ্যাক্টরি-গেট প্রাইস জুন মাসে ৩.৬ শতাংশ কমেছে। এটি মে মাসের ৩.৩ শতাংশ হ্রাসকেও ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২৩ সালের জুলাইয়ের পর সর্বোচ্চ পতন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা শুধুই সংখ্যার বিষয় নয়, এটি চীনের শিল্প খাতের মধ্যে জমে থাকা গভীর সংকটের বহিঃপ্রকাশ।
এনবিএস-এর পরিসংখ্যানবিদ ডং লিজুয়ান রয়টার্সকে জানান, বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা এবং চাহিদার ঘাটতি চীনা শিল্পকে রীতিমতো চাপে ফেলেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্যিক উত্তেজনা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর রপ্তানি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগে আস্থার অভাব তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধ: বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রে চীন
একদিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যখন দুর্বল, তখন বাইরের বাজার থেকেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করছেন – যার মধ্যে রয়েছে কপার, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপগুলিকে দেশীয় শিল্প ও কর্মসংস্থান রক্ষার জন্য বললেও, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চীনের মতো বড় অর্থনীতির উপর সরাসরি পড়ছে।
রয়টার্স জানাচ্ছে, জুন মাসে চীনের ফ্যাক্টরি কার্যক্রম টানা তৃতীয় মাস সংকুচিত হয়েছে। যদিও মে মাসের তুলনায় এই সংকোচনের হার কিছুটা ধীর, তবে নতুন রপ্তানি অর্ডার ও কর্মসংস্থানের দিক থেকে পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক। এই সংকোচনের পেছনে বাণিজ্য সংঘাতই প্রধান কারণ বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
ভোক্তা খরচে অনাগ্রহ, মূল্যস্ফীতির প্রায় স্থবির অবস্থা
অন্যদিকে, ভোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধির ইঙ্গিতও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। জুন মাসে চীনের ভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) মাত্র ০.১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি মে মাসের ০.১ শতাংশ পতনের বিপরীত হলেও কোনো উল্লেখযোগ্য পুনরুদ্ধার নয়। মাসভিত্তিক হিসাবে CPI ০.১ শতাংশ কমেছে, অর্থাৎ বাজারে সামগ্রিক চাহিদা এখনো দুর্বল।
মূল্যস্ফীতির এই নিম্ন হার যদিও ব্যাংকিং নীতির ক্ষেত্রে কিছুটা নীতিগত স্বাধীনতা দেয়, তবুও এটি ভোক্তা আস্থাহীনতা এবং চাকরি-বাজারে দুর্বলতার প্রতিফলন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। মূল মূল্যস্ফীতি (Core Inflation) সামান্য করে ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও এটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের ইঙ্গিত নয়।
বাজারে মূল্য যুদ্ধ ও বড় সংস্থার সাবসিডি যুদ্ধ
চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারেও সংকট স্পষ্ট। অটোমোবাইল খাতে ব্যাপক মূল্যছাড় চলছে, যা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে যে সরকারকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরণের মূল্য যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে শিল্প খাতকে আরও অস্থির করে তুলতে পারে।
শুধু গাড়ির বাজার নয়, ই-কমার্স খাতেও প্রবল প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। Alibaba এবং JD.com-এর মতো সংস্থাগুলো দ্রুত ডেলিভারি পরিষেবার বাজারে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে। এই প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, ভোক্তাদের খরচ কমে যাওয়ায় বড় সংস্থাগুলিও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মরিয়া।
বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করণীয়
চীনা শেয়ারবাজারে প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। রয়টার্স জানিয়েছে, সাংহাই কম্পোজিট সূচক বুধবার দুপুরে ০.৩ শতাংশ বেড়েছে, যা নির্দেশ করে কিছু বিনিয়োগকারী কেন্দ্রের সহায়তার আশায় রয়েছেন। তবে হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক ০.৭ শতাংশ পতন দেখিয়েছে, যা বাজারের উদ্বেগকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
আইএনজি ব্যাংকের চীনের প্রধান অর্থনীতিবিদ লিন সং জানিয়েছেন, এই মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি পিপলস ব্যাংক অফ চায়নাকে সুদের হার আরও কমানোর সুযোগ দিচ্ছে। তার মতে, ২০২৫ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে সুদের হার হ্রাসের সম্ভাবনা প্রবল।
নীতিনির্ধারকদের কঠিন সমীকরণ: ঘাটতি না বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা
এখন চীনা নীতিনির্ধারকদের সামনে বড় প্রশ্ন – কিভাবে অর্থনীতিকে গতিশীল করা যায়, আবার ঋণের ঝুঁকি ও সম্পত্তি বাজারের অতিরিক্ত উত্তাপ ঠেকানো যায়? শিল্প খাতে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস, ভোক্তা ব্যয় স্থবির এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে চীনকে খুব সতর্কভাবে এগোতে হবে।
রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীনের সামনে যেসব সমস্যা আছে তা স্বল্পমেয়াদী নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক চাপে রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে, ভেতরে চাহিদা নেই, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, এবং বাজারে দাম নিয়ে মারাত্মক প্রতিযোগিতা। এই অবস্থায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য সামনে পথ মসৃণ হবে না।
চীনের অর্থনীতির বর্তমান চিত্র নানা বিপরীতমুখী সংকেত দিচ্ছে – একদিকে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অন্যদিকে বৈশ্বিক চাপ। একে শুধুই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বলা যাবে না, এটি আগামী দিনের রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সিদ্ধান্তেরও ভিত্তি হতে চলেছে। এখন দেখার বিষয়, চীন কতটা দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।