পশ্চিমবঙ্গ দিবস: ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক নীরব বিজয়গাথা
২০ জুন, ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ শুধু একটি দিন নয়, এটি বাংলার আত্মপরিচয়ের বর্ণময় দৃষ্টান্ত। ১৯৪৭ সালে বিভক্তির বিভীষিকায় দাঁড়িয়ে বাংলা বেছে নিয়েছিল সভ্যতার পথ, কণ্ঠ দিয়েছিল ভারতের পক্ষে। সেই সময় ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’-এর নামে এক আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব এলে, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাঁর প্রচেষ্টাতেই রক্ষা পায় পশ্চিমবঙ্গ। আজকের প্রজন্মের উচিত সেই নিরব সাহসের স্মরণ ও সম্মান। এই ইতিহাস জানা মানে নিজেকে চেনা, শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া।
📌 STORY HIGHLIGHTS:
২০ জুন, ১৯৪৭: বিভক্তির মুখে দাঁড়িয়ে বাংলা ভারতকে বেছে নেয়।
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী: ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’-এর বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন, বাংলার হিন্দু জনপদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।
সুহারাওয়ার্দীর প্রস্তাব: স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্র, যা ছিল জিন্নাহর ‘টু-নেশন থিওরি’-র ছায়া।
বর্তমান প্রেক্ষাপট: পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০ জুনকে উপেক্ষা করে পয়লা বৈশাখকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসেবে প্রচার করছে।
১৯৪৭ সালের গ্রীষ্মে, যখন ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, তখনই দেশভাগের রক্তাক্ত ছায়া ঘনিয়ে আসে বাংলার ওপর। এই সময় হুসেন শহীদ সুহারাওয়ার্দী, তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী, এক অভিনব ধারণা নিয়ে আসেন—একটি ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’। এই প্রস্তাব ছিল এমন এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিকল্পনা, যা ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে, একটি পৃথক সত্তা হিসেবে গড়ে উঠবে। এর রাজধানী হতো কলকাতা। আদর্শিক ভাবে এটি ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে এক মসৃণ মুখোশ, কিন্তু বাস্তবের মাটিতে এই প্রস্তাব ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এক স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরির কৌশল।
এই সময় দাঁড়িয়ে গর্জে ওঠেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। তিনি কেবল একজন রাজনীতিক নন, একজন চিন্তাবিদ, একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। তিনি বুঝতে পারেন, ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’ আসলে এক পর্দার আড়ালের বিপদ—যেখানে বাংলার হিন্দু জনপদ, তার সংস্কৃতি ও সভ্যতা, ধ্বংসের মুখে পড়বে।
“এটা হবে এক প্রকার ভার্চুয়াল পাকিস্তান,” ড. মুখার্জী বলেছিলেন, “যেখানে বাংলার আত্মা, তার মন্দির, কবিতা, নারী ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
তিনি দিল্লিতে কংগ্রেস নেতাদের সতর্ক করেন, জনমত গড়ে তোলেন, সংবাদপত্রে লেখেন, ভাষণ দেন। কলকাতার পথে পথে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ছিল না—তা ছিল অস্তিত্ব রক্ষার একটি স্বর, যা জাতীয়তাবাদের মূলে দাঁড়িয়ে ছিল।
“আমি কোনও মানচিত্র নয়, একটি সভ্যতার পক্ষে দাঁড়িয়েছি,” বলেছিলেন তিনি।
ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র ভয়াল রক্তাক্ত দিনটি ইতিহাসে কেবল সহিংসতার স্মারক নয়, বরং এটি ছিল একটি জাতির অস্তিত্বের বিরুদ্ধে চালানো গণহত্যার নির্মম পর্ব। ১৯৪৬ সালের সেই অগাস্টের দিনগুলোতে কলকাতা রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছিল মৃত্যু, বিভীষিকা ও নিরীহ মানুষের আর্তনাদ। চারপাশে নেমে এসেছিল এক বিপন্ন সময়, যখন ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ও দিশাহীন।
এই অন্ধকার সময়ে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম, যিনি ফেটালিজম বা ভাগ্যনির্ভর নীরবতা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বুঝেছিলেন, ইতিহাসের এমন বাঁকে যদি নেতৃত্ব সুস্পষ্ট না হয়, তবে বাংলা কেবল মানচিত্রের নয়, আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে নিপতিত হবে।
তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে সরাসরি সতর্ক করেন, ঘটনাপ্রবাহের বিপদের আভাস দেন এবং রাজনীতির শীর্ষপর্যায়ে আলোচনার টেবিলে পৌঁছে দেন বাংলার মানুষের উদ্বেগ। তিনি শুধু পর্দার আড়ালে আলোচনা করেননি, তিনি সরাসরি জনগণের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন, কণ্ঠস্বর তুলেছেন প্রতিরোধের।
তিনি জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেও যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে বিতর্ক করেন এবং হুসেন শহীদ সুহারাওয়ার্দীর ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও কার্যকর অবস্থান গ্রহণ করেন।
এই অবস্থান ধর্মীয় বিভাজনের ভাষা নয়, ছিল অস্তিত্বের ভাষা। এটি ছিল এমন এক কণ্ঠস্বর, যা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি সভ্যতা, একটি সাংস্কৃতিক সত্তাকে রক্ষা করার জন্য উত্থাপিত হয়েছিল।
“তাঁর কণ্ঠস্বর সাম্প্রদায়িক ছিল না, ছিল অস্তিত্বের,”—এই কথাটি এই কারণেই প্রাসঙ্গিক, কারণ তা শুধুই রাজনীতি নয়, বাঙালিত্বের টিকে থাকার একটি উজ্জ্বল প্রতিরোধ হয়ে উঠেছিল।
ড. মুখার্জীর ভূমিকা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস কেবল ঘটনাপ্রবাহের ধারাবিবরণী নয়, তা হলো সিদ্ধান্ত ও প্রতিরোধের মূল্য। সভ্যতার মুছে যাওয়া যখন বাস্তব আশঙ্কা হয়ে ওঠে, তখন কিছু কণ্ঠ নির্ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। সেই কণ্ঠগুলির একটি ছিল তাঁর—যে কণ্ঠ ইতিহাসকে নির্ভীকভাবে প্রশ্ন করেছে, পথ দেখিয়েছে।
বলা যায়, তাঁর এই সাহসী পদক্ষেপ না থাকলে আজ কলকাতা ভারতের অংশ হতো না। আজকের পশ্চিমবঙ্গও হয়তো ভারতবর্ষের মানচিত্রে এক ভিন্ন চেহারায় থাকত। ইতিহাস ড. মুখার্জীর সেই দিনের বিবেকবোধকে তাই নীরবে শ্রদ্ধা জানায়।
তবুও আশ্চর্যজনক ভাবে, আজকের পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই দিনটিকে স্মরণে রাখতে নারাজ। ২০ জুনকে অগ্রাহ্য করে তারা পয়লা বৈশাখ—বাঙালির নববর্ষের দিনটিকে—‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি কি শুধুই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন, নাকি ইতিহাসের প্রতি এক ইচ্ছাকৃত অবহেলা?
“সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা ও ভুলকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া,” নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর এই সতর্কবাণী আজ যেন আমাদের আত্মার অন্তঃস্থলে ধ্বনিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গ দিবস যদি কোনো একক ব্যক্তির জন্মজয়ন্তী না হয়, তা হলে এটি একটি জাতির আত্মস্মৃতির দিন। এমন এক দিন, যেদিন একটা মাটি ঠিক করেছিল, তার ভবিষ্যৎ কোন পথে হাঁটবে। সেটি শুধু রাজনৈতিক পথ ছিল না, সেটি ছিল ভাষা, সংস্কৃতি, চিন্তা ও চেতনার দিশা নির্ধারণ। সেই ইতিহাস ভুলে গেলে, আমরা শুধু অতীতকেই অপমান করি না, ভবিষ্যতের কাছেও হয়ে পড়ি দায়ী।
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী জাতির পক্ষে যে আলো জ্বালিয়েছিলেন, সেই আলোর স্মৃতি ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব। ইতিহাসের যে ক্ষণগুলি জাতিকে রক্ষা করেছিল, সেগুলির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো মানেই নিজের শিকড়ে ফিরে যাওয়া। আর সেই শিকড়ের স্মরণেই—পশ্চিমবঙ্গ দিবস, ২০ জুন।