প্রথমবারের মতো ‘খালিস্তানি চরমপন্থী’দের জাতীয় হুমকি বলল কানাডা
অবশেষে সরল স্বীকারোক্তি এল উত্তর আমেরিকার মাটি থেকে। কানাডার সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা CSIS তাদের বার্ষিক রিপোর্টে প্রথমবারের মতো খালিস্তানি চরমপন্থীদের “জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি” বলে অভিহিত করেছে। সহিংসতা না ঘটলেও, ভারতের ভিতরে অশান্তি ছড়াতে কানাডা-ভিত্তিক খালিস্তানপন্থীদের কার্যকলাপ চলছেই—এই ভাষ্যকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন পরিণতির আভাস মিলছে। ভারত বহুবার যে ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, এবার তা কানাডার দপ্তরে লেখা পড়ে গেল। খালিস্তানি প্রশ্নে পশ্চিমী ভূমিকা নিয়ে বহু বিতর্কের মাঝেই এল এই জোরালো প্রশাসনিক বার্তা।
📌 স্টোরি হাইলাইটস:
CSIS-এর বার্ষিক রিপোর্টে খালিস্তানি চরমপন্থীদের নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে চিহ্নিত
২০২৪ সালে কানাডায় কোনো হামলা না হলেও ভারত-বিরোধী সহিংস কার্যকলাপ চলছে
কানাডাকে ব্যবহার করে অর্থ সংগ্রহ, প্রচার ও সহিংস পরিকল্পনা চলছে, বলছে রিপোর্ট
ভারত সরকারের তরফে ২০টিরও বেশি প্রত্যর্পণ অনুরোধ আগে জমা দেওয়া হয়েছে
১৯৮৫ সালের এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট বোমা হামলা এখনো মনে করিয়ে দেয় অতীতের ভয়াবহতা
ভারতের উপর হস্তক্ষেপের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এই চরমপন্থা, জানাচ্ছে CSIS
দীর্ঘদিন ধরে ভারত যে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল, সেই ইস্যুতেই অবশেষে কানাডা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করল। বার্ষিক গোয়েন্দা রিপোর্টে “খালিস্তানি চরমপন্থী”দের সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করল কানাডার নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা Canadian Security Intelligence Service (CSIS)। এ ধরনের স্বীকৃতি অতীতে দেখা যায়নি। রিপোর্টটি কানাডার পার্লামেন্টে পেশ করা হয় এবং এর মধ্যে এমন কিছু মন্তব্য উঠে এসেছে, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
CSIS-এর রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “২০২৪ সালে খালিস্তানি চরমপন্থীদের দ্বারা কানাডায় কোনো আক্রমণ সংগঠিত না হলেও, কানাডা-ভিত্তিক খালিস্তানি চরমপন্থীদের (CBKEs) সহিংস কার্যকলাপে জড়িয়ে থাকা এখনো কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচিত।” এই বিবৃতি শুধু একটি বার্ষিক রিপোর্টের তথ্য নয়, বরং ভারত ও কানাডার সম্পর্কের গতিপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।
খালিস্তানি আন্দোলনের ইতিহাস বহু পুরনো হলেও, সাম্প্রতিক কালে এটি একটি কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত বিষয় হিসেবে আরও জোরালোভাবে সামনে এসেছে। রিপোর্টটি উল্লেখ করেছে যে, “খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তি এই চরমপন্থায় জড়িত, যাঁরা কানাডাকে ভিত্তি করে ভারতের অভ্যন্তরে সহিংসতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ, প্রচার এবং পরিকল্পনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।”
ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে কানাডার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছে। বারবার অনুরোধ জানানো হয়েছে, যাতে খালিস্তানি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ভারত ইতিমধ্যে কানাডাকে ২০টিরও বেশি প্রত্যর্পণ অনুরোধ পাঠিয়েছে, যার মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ভারতে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
রিপোর্টটি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে—১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২-এর বোমা হামলার ঘটনা। এটি ছিল খালিস্তানি চরমপন্থীদের দ্বারা সংঘটিত ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান সন্ত্রাসবাদ, যাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩২৯ জন। এই ঘটনাই প্রথম ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে কানাডাকে একটি উদ্বেগজনক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
CSIS বলেছে, “কানাডা-ভিত্তিক খালিস্তানি চরমপন্থীরা সহিংস উপায়ে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে একটি স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করছে“, এবং “এই বাস্তব ও প্রতিপাদিত চরমপন্থা ভারতের বিদেশনীতি নিয়ে কানাডার ভূখণ্ডে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিচ্ছে।“
এই স্বীকৃতিকে অনেকেই ভারতের দীর্ঘদিনের উদ্বেগের এক প্রকার কূটনৈতিক স্বীকৃতি বলেই মনে করছেন। যদিও বিষয়টি একটি নিরাপত্তাজনিত ইস্যু, তবু এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্যও কম নয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি জি৭ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে আলবার্টায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। বৈঠকে দু’দেশ একে অপরের রাজধানীতে নতুন হাইকমিশনার নিয়োগ, বাণিজ্য আলোচনার পুনরারম্ভসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে একমত হয়।
প্রসঙ্গত, দুই দেশের সম্পর্কের অবনমন ঘটে সেই সময়, যখন কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা থাকার অভিযোগ আনেন, যদিও সে বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ কখনো প্রকাশ্যে আসেনি।
নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি ভারত-কানাডা সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা দিয়ে চলেছেন। তাঁর এই উদ্যোগ এবং কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার এই স্পষ্টীকরণ হয়তো দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ চিত্রটিকে নতুন ভাবে গড়ে তুলতে পারে।