মোদী-ট্রাম্প ফোনালাপে কূটনৈতিক স্পষ্টতা: ‘সিন্ধূর’ বিরতিতে মার্কিন ভূমিকার দাবি খণ্ডন প্রধানমন্ত্রীর
এক নজরে দৃষ্টিনন্দন হলেও এই বার্তায় লুকিয়ে আছে কূটনীতির সূক্ষ্ম জবাব। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন— ভারত ও পাকিস্তানের ‘সিন্ধূর’ বিরতির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও ভূমিকাই ছিল না। সেইসঙ্গে ট্রাম্পের দেওয়া সফরের আমন্ত্রণও বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দেন তিনি। মোদীর কথায় উঠে আসে— না বাণিজ্যচুক্তির কোনও আলোচনা হয়েছে, না কোনও মধ্যস্থতার সুযোগ ছিল। এই আলোচনার প্রতিটি বাক্যে মিশে ছিল ভারতের আত্মবিশ্বাস, আর কূটনৈতিক দৃঢ়তার সুর।
📰 STORY HIGHLIGHTS
মোদী জানালেন, কোনও মার্কিন মধ্যস্থতার প্রশ্নই ওঠে না
ট্রাম্প দাবি করলেন, যুদ্ধ থামানোর নেপথ্যে তিনি নিজেই
ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিলেন মোদী
অপারেশন সিন্ধূর নিয়ে বিস্তারিত জানালেন মোদী
পাকিস্তান সেনাপ্রধানকে ‘যুদ্ধ থামানোর নায়ক’ বললেন ট্রাম্প
কোয়াড সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রণ পেলেন ট্রাম্প
বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল আবহে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের পরিসরে নতুন করে আলোড়ন তুলেছে একটি ফোনালাপ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য ঘিরে চর্চা শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। তিনি প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধ তিনি নিজে থামিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি সই হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি। অথচ সেই দাবির উল্টো সুরেই মুখ খুলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, এমন কোনও আলোচনার ভিত্তি নেই, বরং যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত এসেছিল সরাসরি ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রচলিত যোগাযোগ চ্যানেলের মাধ্যমে— এবং সেটা পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই তোলা হয়েছিল।
এই ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রে রয়েছে একটি ৩৫ মিনিটের ফোনালাপ। বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, মোদী এবং ট্রাম্পের এই ফোনালাপটি ছিল তাদের প্রথম আলোচনা অপারেশন সিন্ধূরের পর। আলোচনার শুরুতেই ট্রাম্প প্রস্তাব দেন, যদি কানাডা সফর শেষ করে মোদী আমেরিকায় কিছু সময়ের জন্য থামেন। তবে প্রধানমন্ত্রী তার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির কারণ দেখিয়ে এই অনুরোধে সাড়া দিতে পারেননি। মোদী এরপর ক্রোয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হন।
উল্লেখযোগ্যভাবে, কিছুদিন আগেই কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে দু’জনের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা ছিল। তবে ট্রাম্প হঠাৎ করে ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তাই দুই নেতার এই ফোনালাপকেই সেই অনুপস্থিত সাক্ষাতের বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যেখানে ট্রাম্প একরকম কৃতিত্ব দাবি করে বলেন, “আমি যুদ্ধ থামিয়েছি… আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি… মোদী একজন দুর্দান্ত মানুষ”, সেখানে মোদী জানিয়ে দেন, বাস্তবের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। মোদীর সাফ বক্তব্য, ভারত এই ঘটনার প্রতিটি মুহূর্তে নিজের অবস্থান স্পষ্ট রেখেছে— এবং কোনও মধ্যস্থতা গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আরও বলেন, “ভারত-পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচলিত চ্যানেলের মাধ্যমেই এই আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, এবং সেটা এসেছিল পাকিস্তান থেকেই।”
তবে ট্রাম্প থেমে থাকেননি। হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের সময় তিনি বলেন, “এই মানুষটি পাকিস্তানের দিক থেকে যুদ্ধ থামাতে বিশেষভাবে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছেন।” একইসঙ্গে তিনি বলেন, “ভারত ও পাকিস্তান যখন সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছিল— এবং তারা উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর— আমি সেটাকে থামিয়েছি।”
ভারতের তরফে স্পষ্ট করা হয়েছে, এই পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল পহেলগামে জঙ্গি হামলার পর। ২২ এপ্রিলের সেই ঘটনার পর মোদী ট্রাম্পের ফোনালাপে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেন। মোদী জানান, ৬-৭ মে রাতে ভারতের তরফে কেবলমাত্র জঙ্গি ঘাঁটি ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গিদের আস্তানাগুলিকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। অভিযানের ধরণ ছিল নিয়ন্ত্রিত, সুনির্দিষ্ট এবং উস্কানিমূলক নয়।
এরপর আসে ৯ মে রাত। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স ফোন করে জানান, পাকিস্তান বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করছে। মোদী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, যদি পাকিস্তান এমন কিছু করে, তবে তার চেয়ে কঠোর জবাব পাবে। ৯-১০ মে রাতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাল্টা হামলায় পাকিস্তানি সামরিক পরিকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের বিমানঘাঁটি কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে। মিশ্রি জানিয়েছেন, এই কঠোর অবস্থানেই পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করে।
মোদী ট্রাম্পকে আরও জানান, ভারত এখন সন্ত্রাসবাদকে আর প্রক্সি যুদ্ধ নয়, সরাসরি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করছে। এবং সেই মাপকাঠিতে চালানো হচ্ছে অপারেশন সিন্ধূর, যা এখনও চলমান।
এই ফোনালাপে ভারত-মার্কিন ভবিষ্যত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক উঠে আসে। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ— মোদী ও ট্রাম্প উভয়েই মত দেন, শান্তি আনার একমাত্র উপায় হল প্রত্যক্ষ সংলাপ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রসঙ্গে দুই নেতা কোয়াডের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেন, যা চীনের আগ্রাসী মনোভাবের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
সবশেষে মোদী ট্রাম্পকে ভারতের পরবর্তী কোয়াড সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে জানান, তিনি খুব শীঘ্রই ভারত সফরে আসার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন।
এই ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করে দিল— আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে শুধু বয়ান নয়, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং নির্ভুল তথ্য উপস্থাপন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানের মতো পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের বিষয়ে কোনও অসত্য বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে— আর সেই দ্বায়িত্ব কোনও ভাবেই হালকাভাবে নেওয়া যায় না।