কলকাতা শহরের অন্তরে জমে থাকা সময়ের ধ্বংসস্তূপ আজ নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। পুরসভা চিহ্নিত ২,৫০০-রও বেশি ‘বিপজ্জনক’ বাড়ি যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে—তা সত্ত্বেও বাসিন্দারা ছাড়তে নারাজ সেই পুরনো ঠাঁই। সম্প্রতি বউবাজারে এক শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ি ভেঙে মৃত্যুর ঘটনা এই গভীর সমস্যার আভাস দিয়েছে। সংস্কারের নামে নজরদারিহীন নির্মাণ, পুনর্বাসনের প্রতি অনীহা এবং নিরাপত্তাজনিত অজ্ঞানতা—এই তিনের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে শহর। পুরনো দেওয়ালের গায়ে ফাটল, আর ভিতরে বাসিন্দাদের একরোখা মানসিকতা—তাতেই গুমরে মরছে নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
🟠 STORY HIGHLIGHTS
বউবাজারে শতবর্ষ প্রাচীন বাড়ি ভেঙে প্রাণহানি, আহত চার
সংস্কার চলাকালীন অনভিজ্ঞ তদারকি এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের অনুপস্থিতি
কলকাতায় বিপদজনক ভবনের সংখ্যা ২,৫০০-র বেশি, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বরো IV, V ও VI
বাসিন্দাদের উচ্ছেদে অস্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের বিষয়ে তথ্যের অভাব
মেয়রের আশ্বাস: পুনর্নির্মাণের পর সকল বাসিন্দাকে ফিরিয়ে আনা হবে
পুরনো কলকাতার অলিগলি ইতিহাসে ভরা। প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি যুগের সাক্ষ্য বহন করে। তবে সেই ইতিহাসই কখনও কখনও হয়ে উঠছে জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি। রবিবার বউবাজারে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সেই সত্যিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। শতাধিক বছর পুরনো একটি বাড়ি সংস্কারের কাজ চলাকালীন হঠাৎই ভেঙে পড়ে। ঘটনার ফলে মৃত্যু হয় এক স্থানীয় বাসিন্দার, আহত হন আরও চারজন।
প্রথমে মনে করা হচ্ছিল, কাজ চলার সময় হালকা ধস হয়েছে। পরে দেখা যায়, আসলে একেবারে নিচতলা ধসে পড়ে উপরের তলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সংস্কারের সময়, যেখানে শ্রমিকরা ছিলেন কিন্তু কোনও প্রথাগত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধান ছিল না। কলকাতা পুরসভার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান,
“শ্রমিকরা অভিজ্ঞ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এত পুরনো স্থাপত্য নিয়ে কাজ করার জন্য এক ধরনের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। শুধু অভিজ্ঞতা নয়, প্রযুক্তিগত বোঝাপড়া জরুরি।”
এটা কিন্তু নতুন ঘটনা নয়। পুরনো কলকাতার বহু বাড়ি আজ ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে। KMC-এর তালিকা অনুযায়ী, শহরের ২,৫০০-র বেশি বাড়ি ‘বিপজ্জনক’ চিহ্নিত। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বরো IV, V ও VI-তে। বহু বাড়ি এমনই অবস্থা যে যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে। তা সত্ত্বেও বহু বাসিন্দা ওই বাড়িগুলি ছেড়ে যেতে নারাজ।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে এক KMC কর্মকর্তা জানান,
“আমরা বারবার উচ্ছেদের নোটিস দিচ্ছি, সতর্কবার্তা দিচ্ছি। কিন্তু বেশিরভাগ বাসিন্দা বলছেন, যদি পুরসভা অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করে, তবে তাঁরা ছাড়বেন। এই সময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে।”
বাসিন্দাদের এমন মনোভাবের পিছনে মূলত দুইটি কারণ স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, তাঁদের মনে ভয়—বাড়ি ছেড়ে দিলে আর ফেরত পাবেন না। দ্বিতীয়ত, পুনর্বাসনের আইনি দিক বা পুরসভার উদ্যোগ সম্পর্কে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই।
এই পরিস্থিতিতে কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম আশ্বাস দিয়েছেন,
“যাঁরা এইসব বিপজ্জনক বাড়িতে থাকছেন, তাঁদের নাম আমরা পুরসভার তালিকায় নথিভুক্ত করব। ভবিষ্যতে যখন এইসব জায়গায় নতুন নির্মাণ হবে, তাঁরা সেখানে আবাসন পাবেন। কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে না।”
তবে বাস্তব পরিস্থিতি আরও জটিল। পুরসভার প্রচেষ্টার পরও বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ এখনও পুরনো বাড়ি ছাড়তে নারাজ। এর ফলে পুরসভাও এক ধরনের জটিল অবস্থায় পড়েছে—চাইলে ভাঙতে পারছে না, আবার ছাড়লে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ছে।
শহরের আরও কিছু এলাকা থেকেও আসছে উদ্বেগজনক খবর। যেমন, উত্তর কলকাতার শোভাবাজার ও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ক্রসিং-এর সংযোগস্থলে একটি ভবনের অবস্থা চরম দুর্দশার। রাজা সুবোধ মল্লিক রোডের নামাঙ্কিত এক ঐতিহাসিক ভবনও আজ ধসে পড়ার মুখে দাঁড়িয়ে।
বস্তুত, প্রশ্ন উঠছে—শুধু সংস্কার নয়, একটি সুসংগঠিত শহর পরিকল্পনা কি আদৌ আছে? কেবল পুরসভা নয়, নাগরিকদের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি না হলে এমন দুর্ঘটনা আবারও ঘটবে—সেই আশঙ্কা সত্যি হতে আর কতটা সময় লাগবে?
পুরনো কাঠামোর নীরব ধ্বনি আজ কলকাতার ভবিষ্যতের সামনে এক বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরছে। বিপজ্জনক ভবনের সংখ্যা বাড়লেও বাসিন্দাদের অনীহা, সচেতনতার অভাব এবং তদারকির ফাঁকফোকর গোটা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। সময় থাকতে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে এমন দুর্ঘটনা বারবার ঘটবে—এই আশঙ্কা অমূলক নয়। পুরসভা, প্রশাসন ও সাধারণ নাগরিক—সকলেরই সম্মিলিত উদ্যোগে তৈরি হতে হবে একটি নিরাপদ, সচেতন ও পরিকল্পিত শহর, যেখানে ইতিহাস থাকবে, কিন্তু তার ভারে জীবন হারাবে না।