পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন নিয়মিত আয়োজিত হলেও বাস্তবে বিনিয়োগ প্রত্যাবর্তনের হার অত্যন্ত কম, যা শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। প্রতি বছর বহু Memorandum of Understanding (MoU) স্বাক্ষরিত হয়, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আসে, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ভরসার ঘাটতি, প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা এবং কর অবকাঠামোর জটিলতা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, প্রশ্ন উঠছে—শুধুই কি শিল্প সম্মেলন, নাকি প্রকৃত অর্থে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির প্রয়োজন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের স্বার্থে?
বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট: বড় ঘোষণা, ছোট বাস্তবতা
🔹 ঘোষণার বহর বনাম বাস্তবায়নের হার
▪️ ২০২৫ সালের শিল্প সম্মেলনে:
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের স্বপ্ন তুলে ধরা হয়েছিল ₹৪.৪০ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
মোট ২১২টি MoU এবং Letter of Intent স্বাক্ষরিত হয়েছে।
▪️ বাস্তব চিত্র:
আগের বছরগুলোর মতোই এই বিনিয়োগের বড় অংশ বাস্তবায়িত হয়নি।
২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ঘোষিত বিনিয়োগের ১৫–২০% রূপ পেয়েছে মাত্র, যার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রকল্প।
🔹 আকর্ষণীয় বক্তৃতা বনাম নীরব শিল্পপতি
▪️ সামিটে উপস্থিত ছিলেন:
মুকেশ আম্বানি, সাজ্জন জিন্দাল, সঞ্জীব গোয়েঙ্কা প্রমুখ কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব।
তারা পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশংসা করলেও, বাস্তবে নতুন কোনো বড় প্রকল্প শুরু করেননি।
▪️ উল্লেখযোগ্য তথ্য:
Reliance বা JSW-এর মতো সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে ঘোষিত প্রকল্পের একটিও এখনো ভিত্তিপ্রস্তর পর্যন্ত পৌঁছয়নি।
এটা দেখায় যে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” কেবল একটি প্রদর্শনীমূলক ইভেন্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যার মধ্যে শিল্পায়নের মূল ধারা অনুপস্থিত।
🔹 MoU: কাগজে সই, মাটিতে শূন্যতা
▪️ সমস্যার মূল:
বেশিরভাগ MoU হয় ‘non-binding’ অর্থাৎ আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াই প্রতিশ্রুতি।
অনেক বিদেশি ও বহুজাতিক সংস্থা সম্মেলনের পরে কার্যত নিস্ক্রিয়।
▪️ তথ্যসূত্র:
২০২১ সালের শিল্প সম্মেলনে সই হওয়া ১৮০টি MoU-এর মধ্যে মাত্র ৩০টির প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এ থেকেই প্রমাণিত, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” প্রশ্নবিদ্ধ এবং রাজনৈতিক উৎসাহে গঠিত ইভেন্টের ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত।
🔹 ‘ইনফ্রা’ নেই, ‘ইনভেস্ট’ কবে?
▪️ পরিকাঠামো সমস্যার বাস্তব চিত্র:
বিদ্যুৎ সংযোগ, জমি হস্তান্তর, শিল্প পার্কের অভাব – এসবই বড় বাধা।
‘জেমস হাব’, ‘কানেকটিভিটি করিডর’ ঘোষণা হলেও বাস্তব নির্মাণ অদৃশ্য।
▪️ রাজ্যের কিছু অঞ্চল যেমন উত্তরবঙ্গ ও সুন্দরবন অঞ্চলে শিল্প স্থাপন সম্ভাবনা থাকলেও, প্রশাসনিক অদক্ষতা সব পরিকল্পনা পেছনে ঠেলে দিয়েছে।
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” যতই উজ্জ্বল হোক, বিনিয়োগবান্ধব পরিকাঠামো ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা অধরাই থেকে যাবে।
🔹 ‘সামিট’ হলো, কিন্তু ‘আস্থা’ এল না
▪️ রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট:
হঠাৎ জমি নীতির পরিবর্তন, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও স্থানীয় রাজনৈতিক সংঘাত বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে।
২০১১ সালের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অধ্যায় এখনো বিনিয়োগকারীদের মগজে স্পষ্ট।
▪️ প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা:
ফাইল চলাচলের ধীরগতি, দুর্নীতি এবং অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রিতা পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের পথে বড় প্রতিবন্ধক।
বিনিয়োগ শুধু ‘ইভেন্ট’ নয়, এটি বিশ্বাসের প্রশ্ন — এবং এই বিশ্বাস এখনও গড়ে ওঠেনি।
🔹 সামিট বনাম বাস্তব শিল্পোন্নয়ন: একটি তীব্র দ্বন্দ্ব
▪️ একদিকে:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের, কর্পোরেট মুখ হাজির থাকছে, মিডিয়া কভারেজ হচ্ছে।
▪️ অন্যদিকে:
যুবকদের জন্য চাকরি নেই, নতুন কারখানার প্রকল্প দৃশ্যমান নয়, MSME-দের অবস্থা সংকটজনক।
এক কথায়: “বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট” এখন অনেকটাই ‘ওপেনিং ব্যাটসম্যানের বড় শট, কিন্তু রান নেই’—এর মতো।
‘শিল্প সম্মেলন’ থেকে ‘শিল্প বাস্তবতা’—এটাই হোক মূল লক্ষ্য
পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন যতই আড়ম্বরপূর্ণ হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা যতক্ষণ না দৃশ্যমান উন্নয়ন ও চাকরির সুযোগ তৈরি করছে, ততদিন এগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন:
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
বাস্তবমুখী প্রশাসনিক সংস্কার
পরিকাঠামো উন্নয়ন
এবং সর্বোপরি, বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি আস্থা গড়ে তোলা।
🔍 এই মুহূর্তে একটাই প্রশ্ন উঠে আসে—‘ঘোষণার গর্জন অনেক, কিন্তু শিল্পায়নের বর্ষণ কবে?’
বিনিয়োগ না ফেরার কারণ: রাজনৈতিক ভরসার ঘাটতি
নীতিগত অস্থিরতা: নীতি আছে, ধারাবাহিকতা নেই
▪️ স্থায়িত্বহীন নীতি:
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা সরকারের নীতিগত অবস্থানে আস্থাশীল হতে পারছেন না।
উদাহরণস্বরূপ, জমি নীতি ২০১১–২০২4 সময়ে ৭ বার পরিবর্তিত হয়েছে।
▪️ পরিকল্পনার অসম্পূর্ণতা:
“তেজপুর লেদার পার্ক” ও “হাওড়া গ্রীন ইনডাস্ট্রি ক্লাস্টার”-এর মতো প্রকল্প শুরু হলেও হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় — এই অভিজ্ঞতা বহু বিনিয়োগকারীর কাছে ‘রেড ফ্ল্যাগ’।
✒️ “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” বারবার আয়োজিত হলেও নীতির ধারাবাহিকতা না থাকলে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা রূপ নেয় রাজনৈতিক প্যাকেজে, যা দীর্ঘস্থায়ী নয়।
🔹 প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা ও দুর্বোধ্যতা: কাগজে সম্ভাবনা, মাটিতে জট
▪️ অস্বচ্ছ নথিপত্র প্রক্রিয়া:
বিনিয়োগ অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় একাধিক স্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে ৬টি আলাদা দপ্তরের অনুমতি একত্রে নিতে হয়।
পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলনের মাধ্যমে বহু MoU স্বাক্ষরিত হলেও, প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতায় অধিকাংশ থমকে যায়।
▪️ স্থানীয় স্তরের রাজনীতি:
বহুক্ষেত্রে পঞ্চায়েত বা ব্লক স্তরে রাজনৈতিক রং দেখে প্রকল্পে বাধা আসে।
বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থানীয় দাদাগিরির অভিযোগে প্রকল্প গুটিয়ে নিয়েছে, বিশেষ করে পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায়।
✒️ “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” বুঝতে হলে শুধু উপরের স্তরের বক্তৃতা নয়, নিচের স্তরের প্রশাসনিক জটিলতাও অনুধাবন করতে হবে।
🔹 ভূমি এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ে অনিশ্চয়তা: সিঙ্গুরের ছায়া আজও ভারী
▪️ জমির অপ্রাপ্যতা:
যদিও সরকার দাবি করে জমি ব্যাংক রয়েছে, বাস্তবে বহু জমি চাষযোগ্য, জনবসতিপূর্ণ অথবা আইনি জটে আবদ্ধ।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে বহু শিল্পগোষ্ঠী এখনো পশ্চিমবঙ্গে জমি নিতে দ্বিধাগ্রস্ত।
▪️ আইনশৃঙ্খলার উদ্বেগ:
হুগলি ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু প্রকল্পে শ্রমিক সংগঠনের হস্তক্ষেপ এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে এসেছে।
একাধিক বহুজাতিক সংস্থা “law and order sensitivity report” তৈরি করে রাখে এবং পশ্চিমবঙ্গকে উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় রেখেছে।
✒️ তাই “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” যতই প্রতিশ্রুতি দিক, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” বাস্তবে দাঁড়ায় সুরক্ষিত জমি ও পরিবেশ না থাকলে।
🔹 নেতৃত্বের অপ্রত্যাশিত ভাষা ও বার্তা: কর্পোরেটদের অসহজ করে তোলে
▪️ নেতাদের আক্রমণাত্মক বক্তব্য:
শিল্পপতিদের উদ্দেশে ‘চক্রান্তকারী’, ‘দালাল’, এমনকি ‘লুটেরা’ শব্দের ব্যবহার শোনা গেছে বিভিন্ন মঞ্চে।
কর্পোরেট জগৎ এই ধরনের মন্তব্যকে দীর্ঘমেয়াদে “reputational risk” হিসেবে বিবেচনা করে।
▪️ রাষ্ট্রনির্মাণ বনাম রাজনৈতিক প্রচার:
শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে রাজনৈতিক বক্তৃতা, বিরোধী আক্রমণ, ও স্থানীয় প্রসঙ্গ বেশি গুরুত্ব পায়, যেখানে কর্পোরেট আলোচনার স্থান কমে যায়।
✒️ তাই “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” কখনও কখনও রাজনৈতিক পিআর প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায়, যা “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” গঠনের বদলে তাতে বাধা সৃষ্টি করে।
🔹 বিশ্বাসের অভাব: বিনিয়োগ মানেই শুধু টাকা নয়, মনোভাবও
▪️ কর্পোরেট মনোভাব:
শিল্পপতিরা শুধুমাত্র অর্থ লগ্নি করতে চান না; তারা চান দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং সম্মানজনক অংশীদারিত্ব।
▪️ পরিবর্তনের অভাব:
গত ১০ বছরে একটিও Tier-1 শিল্পগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে নতুন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেনি।
স্টার্টআপ ইনকিউবেটর ও ফান্ডিং হাব গড়ে ওঠার ঘোষণা হলেও বাস্তবায়ন শূন্য।
✒️ “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” বারবার আয়োজিত হলেও বিনিয়োগকারীদের মানসিক নিশ্চয়তা ছাড়া “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” থেকে যাবে নিছক কল্পনায়।
আস্থা ফেরানোর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঔদার্য ও প্রশাসনিক দক্ষতা
পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন কেবল একদিনের অনুষ্ঠান নয় — এটি একটি রাষ্ট্রনৈতিক বার্তা। যদি সরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে চায়, তবে তাকে কঠোরভাবে কাজ করতে হবে:
নীতিগত ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
জমি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি
প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সরলীকরণ
আক্রমণাত্মক অলঙ্কারশাস্ত্র পরিহার করা
কর্পোরেট আস্থা ফিরিয়ে আনা
কারণ, কেবল মঞ্চে আলো থাকলেই শিল্প আসে না — দরকার বিশ্বাসের স্থায়ী আলো।
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন: বাস্তব চিত্র বিশ্লেষণ
সংখ্যার নির্মম বাস্তবতা: ঘোষণার চেয়ে বাস্তবায়ন ঢের কম
▪️ MOU বনাম বাস্তব প্রকল্প:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” প্রতি বছর ১ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির কথা বলে, অথচ সরকারি রিপোর্ট অনুসারে মাত্র ৫-৭% বাস্তব রূপ পায়।
২০১৯ থেকে ২০২4 সালের মধ্যে মোট ৮২৭টি MOU স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্যে বাস্তবিক কাজ শুরু হয়েছে মাত্র ৪১টিতে।
▪️ কর্মসংস্থানের গলদ:
প্রত্যেক শিল্প সম্মেলনে লক্ষাধিক কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও বাস্তবে NSDC (National Skill Development Corporation) অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে গত তিন বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ১.৩%।
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” তাই কেবল ঘোষণায় নয়, বাস্তবে কর্মসংস্থানে বিপুল ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
🔷 গোটা শিল্প মানচিত্রে বাংলার ক্ষীণ উপস্থিতি
▪️ টিয়ার-১ শিল্প গোষ্ঠীর অনুপস্থিতি:
টাটা, মাহিন্দ্রা, আইটিসি, আদানি, রিলায়েন্স— এইসব সংস্থা “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” এ অতিথি হলেও বাস্তবে কোনও বড় শিল্পকেন্দ্র গড়ে তোলেনি।
বরং আদানি গোষ্ঠী ২০২৩ সালে ২০,০০০ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি দিলেও ২০২৫-এর মধ্যে প্রজেক্ট শুরু হয়নি।
▪️ ছোট ও মাঝারি শিল্পের (MSME) স্থবিরতা:
পশ্চিমবঙ্গে MSME নথিভুক্ত সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও বাস্তবে সক্রিয়তা কম।
প্রতি ১০টি নিবন্ধিত ইউনিটে মাত্র ৪টি ব্যবসা চালু থাকে, বাকিগুলো কাগজে।
✒️ “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” MSME প্রণোদনার কথা বলে, অথচ বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা সেখানে স্থবির ও দ্বিধাগ্রস্ত।
🔷 অবকাঠামো: অগ্রগতির বদলে প্রতিশ্রুতির বোঝা
▪️ লজিস্টিক ও পরিবহন সমস্যা:
সড়ক, রেল, পোর্ট সংযোগে দুর্বলতা শিল্পস্থাপনার অন্যতম বাধা।
উদাহরণ: বনগাঁ শিল্প হাব-এর প্রস্তাব ২০১৮ সালে হয়, কিন্তু আজও ফোর-লেন রাস্তা অসম্পূর্ণ।
▪️ বিদ্যুৎ সংযোগ ও রকমারি কর:
বহু শিল্প উদ্যোক্তা অভিযোগ করেন যে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে গড়ে ৬ মাস লেগে যায়, যেখানে অন্য রাজ্যে এটি ৪০-৪৫ দিনে সম্পন্ন হয়।
পশ্চিমবঙ্গের বহু শিল্পজোনে স্থানীয় কর ও চার্জগুলোর স্বচ্ছতা নেই, যা বিনিয়োগের প্রতিবন্ধক।
✒️ বাস্তব চিত্র বলছে, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” যতটা আলোয় থাকে, ততটাই ছায়ায় ঢাকা পড়ে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা”।
🔷 শিল্প সংস্কৃতির অভাব ও তরুণ উদ্যোগের বাধা
▪️ স্টার্টআপ ও R&D-এর সংকট:
Start-up Bengal নামক প্রকল্প থাকলেও Bengal ranks below Tier-2 states in DPIIT innovation index।
R&D ফান্ডিংয়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে ১১তম অবস্থানে, এমনকি ওড়িশার পিছনে।
▪️ ইনকিউবেশন সেন্টারের ব্যর্থতা:
২০২১ সালে ঘোষিত Tech Hub Salt Lake এখনো নির্মাণাধীন।
NSIC ও WBIDC-এর অধীনে ঘোষিত ৯টি ইনকিউবেটর ইউনিটের মধ্যে ৫টি এখনো চালু হয়নি।
✒️ তাই, তরুণ উদ্যোক্তারা “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” দেখে উৎসাহ পেলেও “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” দেখে ধীরে সরে যান।
🔷 তুলনামূলক রাজ্য বিশ্লেষণ: পিছিয়ে থাকা স্পষ্ট
▪️ প্রতিবেশী রাজ্যগুলির অগ্রগতি:
ওড়িশা ২০২৪ সালে ৮৫,০০০ কোটি টাকার শিল্প বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে, তেলেঙ্গানা গড়েছে ১১টি নতুন শিল্পপার্ক।
পশ্চিমবঙ্গে একই সময়ে ঘোষণার সংখ্যা অনেক হলেও বাস্তবিক কাজ শুরু হয়েছে কম।
▪️ Ease of Doing Business সূচকে পতন:
২০২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ছিল ৯ম, যা ২০২3-এ এসে ১৬তম স্থানে নেমে যায়।
মূলত জমি সমস্যা, করের জটিলতা এবং প্রশাসনিক দেরিতেই এই পতন।
✒️ পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে দেয়, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” যতই প্রচার পায়, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” ততই অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে।
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” একটি বার্ষিক কর্মসূচি হলেও, তার ভিত্তিতে শিল্পায়নের কোনও স্থায়ী বাস্তবতা গড়ে ওঠেনি। পরিসংখ্যান, র্যাংকিং, ও স্থবির পরিকাঠামো প্রমাণ করে দেয় যে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” আজও বহু রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক বাঁধার শিকার। যদি সরকার বাস্তব কাঠামো পরিবর্তন না করে, তাহলে সম্মেলন কেবল পোস্টারে থাকবে, মাঠে নয়।
জনগণের প্রতিক্রিয়া: সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ
সোশ্যাল মিডিয়ায় কণ্ঠস্বরের উত্থান: সম্মেলনের ভাষ্য বনাম বাস্তব অভিজ্ঞতা
▪️ সাধারণ মানুষের হতাশা:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”-এর ফ্যানফেয়ারের মাঝে সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন তোলে, “বছরের পর বছর সম্মেলন হচ্ছে, কিন্তু আমাদের পাড়ায় কোনো শিল্প এল না কেন?”
টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম-এ ট্রেন্ড করে হ্যাশট্যাগ #MOUWithoutROI (Return on Investment), যা বর্ণনা করে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা”র অন্তঃসারশূন্যতা।
▪️ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের স্রোত:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”কে কেউ বলেন ‘পাওয়ারপয়েন্টের শিল্পায়ন’, কেউ বলেন ‘মঞ্চে বিনিয়োগ, মাঠে শুন্য’।
টুইটারে ভাইরাল হয় কার্টুন মিম: মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতা দিচ্ছেন আর পিছনে লেখা—”Coming Soon: Future Park (Since 2015)”।
🔷 তরুণদের ক্ষোভ: ভবিষ্যতের সন্ধানে শূন্যে হাতড়ানো
▪️ কর্মসংস্থানের স্বপ্নভঙ্গ:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”-এ উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি খোঁজেন, কিন্তু “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা”তে দেখা যায়, ৫০% স্টেট ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট বাইরে চলে যায় চাকরির সন্ধানে।
LinkedIn ও Reddit-এ পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রফেশনালদের ফোরামে পোস্ট: “Why are we forced to leave Kolkata to earn dignity?”
▪️ প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে তুলনা:
তরুণেরা প্রশ্ন তুলেছেন—ওড়িশা বা গুজরাটের শিল্প সম্মেলন বাস্তব শিল্প উৎপাদনে রূপান্তর হয়, অথচ “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” বরং রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বেশি।
🔷 পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের মতামত: বিশ্বাসের ঘাটতি ও প্রশাসনিক গতি
▪️ ইউজার-জেনারেটেড কনটেন্ট (UGC):
YouTube চ্যানেল যেমন ‘Business Bengal’ ও ‘Industry Speak Kolkata’ এ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলেন, “আমরা সম্মেলনের টেবিলে আমন্ত্রিত হলেও, পরের দিন ব্যাংক বা দপ্তরে গেলে কেউ চেনে না।”
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” এ অংশগ্রহণকারী অনেক MSME মন্তব্য করেছেন—“স্মার্ট শহর, স্মার্ট শিল্প হাব—সবটাই ব্যানারে সীমাবদ্ধ, মাটিতে কিছু নেই।”
▪️ বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা:
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে anonymous ভাবে লেখেন—“বাংলায় প্রথম সমস্যা হচ্ছে স্থিতিশীল নীতির অভাব ও দ্রুত সিদ্ধান্তের অভাব”।
এই প্রতিক্রিয়া “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” সম্পর্কে এক নির্মম প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।
🔷 ডিজিটাল প্রতিরোধের ভাষা: তথ্যের ওপরে জনমত
▪️ ‘Fact vs advertisement”(প্রচার)-এর দ্বন্দ্ব:
ব্লগার এবং ইউটিউবাররা ডেটা-ভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করেন—“২০৩টি MOU, অথচ ২৭টিই বাস্তব”—এবং এই তথ্য সামনে এনে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”-এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এক জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লেখা হয়—“MoU মানে Maybe or Unlikely?”
▪️ ভাইরাল প্রতিবাদ:
২০২৪ সালে #FalsePromiseSummit হ্যাশট্যাগে লক্ষাধিক পোস্ট, যেখানে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” নিয়ে তরুণ সমাজ ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও বানিয়ে প্রতিবাদ জানায়।
সোশ্যাল মিডিয়া এখন শুধু প্রতিফলন নয়, বরং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের এক নতুন ফোরাম হয়ে উঠেছে। “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” যতই সরকারিভাবে সফল বলে দাবি করা হোক, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” সোশ্যাল মিডিয়ার সাধারণ মানুষের চোখে আজও একটি দুর্বল, বিশ্বাসঘাতী প্রচার।
ভবিষ্যতের দিশা: কী করা উচিত?
নৈতিক স্বচ্ছতা ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তোলা
🔹 ▪️ বিশ্বাসযোগ্য সরকারের ভূমিকা:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”-এর ধারাবাহিকতা অর্থহীন যদি “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” হয় শুধুই ঘোষণার পরিসংখ্যান।
দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিরতা, আইনি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়া বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসে না।
🔹 ▪️ দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন:
যেমন—একটি সফল শিল্প প্রকল্পের Public Audit প্রকাশ করুন, যাতে বাস্তবতা যাচাই করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত শিল্প সম্মেলনের ৩ বছরের ফলাফলের খুলে বলা রিপোর্ট প্রকাশ করা, যাতে প্রকৃত “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” সামনে আসে।
ব্যবসায়িক পরিবেশে গতি ও স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন
🔹 ▪️ Single-Window System বাস্তবে কার্যকর করতে হবে:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”–এর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, বিনিয়োগকারীদের সকল ছাড়পত্র এক জায়গা থেকে পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে ১৭টি দপ্তরে ঘোরাঘুরি করতে হয়, যা শিল্পায়নের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।
🔹 ▪️ রেড টেপের বদলে ব্লু স্কাই চিন্তা দরকার:
প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর না হলে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” কখনো বদলাবে না।
গুজরাটের মত Ease of Doing Business সূচকে রাজ্যকে উন্নত করতেই হবে।
প্রচার নয়, প্রকল্প—MOU নয়, বাস্তবায়ন
🔹 ▪️ MOU সই মানেই শিল্পায়ন নয়:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”–এ বিগত ১০ বছরে প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকার MOU সই হলেও, বাস্তবিক অর্থে ৮৫%–এর কোনো অস্তিত্ব নেই।
তাই MOU Realization Rate গণ্য করে রাজ্যকে আত্মসমীক্ষা করতে হবে।
🔹 ▪️ কার্যকর ফলোআপ মেকানিজম দরকার:
প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে নজরদারি ও অগ্রগতির রিপোর্ট অনলাইনে আপলোড করলে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” বদলাতে পারে।
একাধিক প্রকল্পের উদাহরণে দেখা গেছে, ঘোষণার ৬ মাসের মধ্যেই জমি সমস্যা ও প্রশাসনিক বাধায় তা বাতিল হয়েছে।
শিল্প-বান্ধব অবকাঠামো ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি
🔹 ▪️ গুণমানসম্পন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোর গড়ে তোলা:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”–এর মাধ্যমে ঘোষিত অঞ্চলগুলিতে বিদ্যুৎ, জল, ট্রান্সপোর্টে ঘাটতি এখনও প্রকট।
হাওড়া-হুগলি বেল্টে দীর্ঘদিন ধরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস্টার নীতির বাস্তব রূপ নেই।
🔹 ▪️ দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্কিলিং:
“পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” তখনই ঘুচবে, যখন রাজ্য AI, robotics, automation–এর মতো future skills–এ বিনিয়োগ করবে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কলেজগুলির tie-up বাধ্যতামূলক করলে বাস্তব দক্ষতা বাড়বে।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে শিল্পনীতি বজায় রাখা
🔹 ▪️ নীতিগত ধারাবাহিকতা জরুরি:
সরকার বদলালে শিল্প নীতির ধারা পাল্টালে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” শুধু রাজনৈতিক শো-আফ হয়ে দাঁড়ায়।
একটি নিরপেক্ষ, bipartisan শিল্প উন্নয়ন বোর্ড গঠন প্রয়োজন।
🔹 ▪️ প্রতিশ্রুতি নয়, প্রাপ্তি মূল্যায়ন হোক মূলমন্ত্র:
প্রতি বছরের “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন”–এর শেষে একটি “Reality vs Promise Scorecard” প্রকাশ করতে হবে।
জনগণকে যুক্ত না করলে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” কখনো বদলাবে না।
📌 “পশ্চিমবঙ্গে শিল্প সম্মেলন” বারবার হলেও, বাস্তবিক অর্থে “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের বাস্তবতা” এখনো রাজনৈতিক মঞ্চের বাইরের কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন তৈরি করতে পারেনি। সময় এসেছে মুখে নয়, মাটিতে শিল্প গড়ার মাধ্যমে বিশ্বাস ফেরানোর।