আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিতে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়—প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের প্রতি উপেক্ষা ও অবহেলা। এক সময় যাঁদের জাতীয়তাবাদী সাহিত্য দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটাত, আজ তাঁদের লেখা সাহিত্যের মূলস্রোত থেকে ক্রমশ বাদ পড়ছে। সাহিত্যের আধুনিকীকরণ, বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি, এবং সাহিত্যের রাজনৈতিক রূপ—এই সব কিছু মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক জটিল বাস্তবতা। দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন কেবল একটি সাহিত্যিক ধারা নয়, বরং আমাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিচ্ছবি। এই প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে প্রশ্ন—আসলে কী কারণে তাঁদের লেখা আজ উপেক্ষিত?
সূচিপত্র
Toggleপ্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক ও তাঁদের অবদান: এক গভীর বিশ্লেষণ
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক বলতে আমরা বুঝি সেইসব লেখক, যাঁরা কলম ধরেছিলেন দেশের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে। তাঁদের জাতীয়তাবাদী সাহিত্য শুধু সাহিত্যের অংশ নয়, বরং এক রকম ইতিহাস। কিন্তু কেন এই সাহিত্য আজ বিতর্কিত? কেন আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত তাঁদের গুরুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে? আসুন পয়েন্ট ধরে দেখি।
দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের মূল লক্ষ্য: সাহিত্য বা সংগ্রাম?
আদর্শে লেখা, আদর্শে বাঁচা
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক কখনো নিছক কল্পনার আশ্রয়ে লেখেননি। তাঁদের লেখা ছিল একটি নির্দিষ্ট জাতীয় সংকল্পের অংশ।
উদাহরণ: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ” কেবল উপন্যাস নয়, বরং এক রাজনৈতিক কনসার্টো। “বন্দে মাতরম” আজও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক।
বিশেষ তথ্য: ব্রিটিশ শাসনের সময় এই উপন্যাস নিষিদ্ধ করা হয়, কারণ শাসকেরা বুঝে গিয়েছিলেন—জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য একত্র হলে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
আদর্শগত সাহস ছিল মূল শক্তি
তাঁদের সাহিত্যে ছিল স্পষ্ট বক্তব্য—দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও সম্মিলিত শক্তির গল্প। সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁরা তৈরি করেছিলেন সংগ্রামের মানসিকতা।
সাহিত্যিক রূপান্তর ও ভুলে যাওয়া নায়করা
সাহিত্য বদলেছে, পাঠকও বদলেছে
আজকের আধুনিক লেখকরা নিজেদের আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা, সমাজবীক্ষা ও গ্লোবাল টার্মে ভাবতে ভালোবাসেন।
ফলাফল? জাতীয়তাবাদী সাহিত্য অনেকের কাছে ‘পুরনো ধ্যানধারণা’র অংশ।
অজানা তথ্য: একাধিক সাহিত্য উৎসবে ‘প্যাট্রিওটিক সাহিত্য’ বিভাগকেই বাদ দেওয়া হয়েছে, কারণ তা নাকি “সাংস্কৃতিক নিরপেক্ষতার পরিপন্থী”।
ইতিহাসের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া কিছু নাম
সরোজিনী নাইডু—উচ্চমানের কবি, যাঁর “The Broken Wing” কাব্যগ্রন্থ দেশপ্রেমে উজ্জ্বল, কিন্তু আজকের পাঠ্যক্রমে অনুপস্থিত।
সৈয়দ মুজতবা আলী—দেশভাগের বেদনা আর জাতীয়তাবাদকে মিশিয়ে দুর্দান্ত লেখালেখি করেছিলেন। আজ তাঁর নাম শুনেছে কয়জন?
সাহিত্যিক সমালোচনার নতুন দর্শন: একটি রূপান্তর
সাহিত্যের রাজনৈতিক রূপকে ঘিরে বিতর্ক
বর্তমানের বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য সমালোচনা প্রায়শই প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের লেখাকে “অতি আবেগপ্রবণ” বা “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” আখ্যা দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—যে সাহিত্য মানুষকে জাগিয়ে তোলে, তা কি রাজনীতি নয় বরং জনচেতনার প্রতিফলন?
অভ্যন্তরীণ বিরোধ: সাহিত্য বনাম জাতীয়তা
অনেক আধুনিক লেখকরা মনে করেন, জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য একসঙ্গে চললে তা সাহিত্যিক স্বাধীনতায় বাধা দেয়। এই চিন্তাধারার ফলেই প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকরা তাঁদের যথার্থ স্থান হারান।
কিছু অপ্রচলিত ও বাস্তব গল্প
‘নন্দিনী’ নামক এক বিস্মৃত কবি
১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়, বাঁকুড়ার এক মহিলা কবি ‘নন্দিনী’ লিখেছিলেন,
“আমি দেশ খুঁজি মাটির ভিতর, আমি গন্ধে খুঁজি শহীদের শরীর”
তাঁর লেখা বিপ্লবীদের মুখে মুখে ঘুরত, কিন্তু আজ কোথাও নেই তাঁর নাম।
এমন অনেক দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন আমাদের সংস্কৃতির এক গভীর ক্ষয়।
বাংলা ছোটগল্পের দেশপ্রেমিক ধারা
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার কিছু সাহিত্যিক বাংলা ছোটগল্পে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন।
কিন্তু আজকের আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত এসবকে বলে “অতীতচর্চার আবেগ”।
প্রশ্ন: আবেগ কি সাহিত্যের বিরুদ্ধ, না সাহিত্যের প্রাণ?
বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি বনাম স্থানীয় বাস্তবতা
গ্লোবাল থিমে স্থানীয় চেতনার সংকট
আধুনিক সমাজে সাহিত্য এখন পরিবেশ, লিঙ্গ রাজনীতি, প্রযুক্তি ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশি আগ্রহী।
জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য এই ট্রেন্ডে প্রায় অস্পৃশ্য।
তথ্যসূত্র: আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারগুলির তালিকায় ‘প্যাট্রিওটিক থিম’-এর লেখার সংখ্যা বছরে কমছে।
দেশপ্রেমিক সাহিত্য কি এখন ইতিহাসের বিষয়?
একটা বড় প্রশ্ন: দেশপ্রেমিক সাহিত্যিক কি কেবল ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে পড়েছেন? নাকি নতুন রূপে তাঁদের লেখা ফের সমাজে স্থান পেতে পারে?
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক এবং তাঁদের জাতীয়তাবাদী সাহিত্য যে শুধু অতীতের স্মারক নয়, বরং আমাদের পরিচয়বোধের অন্যতম স্তম্ভ, তা ভুলে গেলে চলবে না।
আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত তাঁদের স্থান কেড়ে নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু একদিন হয়তো আবারও এই সাহিত্যিকরা ফিরে আসবেন—নতুন পাঠকের হৃদয়ে, নতুন ভাষায়।
✍️ দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন শুধু সাহিত্যজগতের সমস্যা নয়, বরং আমাদের স্মৃতিহীনতার এক নির্মম ছবি।
আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত ও সাহিত্যের আধুনিকীকরণ: এক গভীর বিশ্লেষণ
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক আর তাঁদের জাতীয়তাবাদী সাহিত্য আজকের সাহিত্যে ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে? এক সময় যাঁদের কলম দেশের শিরদাঁড়া সোজা করত, আজ তাঁরা কোথাও যেন অদৃশ্য। এর পেছনে বড় ভূমিকা নিচ্ছে আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত ও তথাকথিত সাহিত্যের আধুনিকীকরণ। এবার চলুন, গভীরে গিয়ে দেখি কেন এই রূপান্তর ঘটেছে।
আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত কীভাবে গঠন হচ্ছে?
বিষয়বস্তুর পরিবর্তন
আগের সাহিত্যিকরা লেখার মাধ্যমে দেশের আত্মা তুলে ধরতেন।
এখনকার লেখকরা দিচ্ছেন:
আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতা
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
ভিন্ন যৌন পরিচয়, লিঙ্গ রাজনীতি, প্রযুক্তি-নির্ভর ভবিষ্যৎ ইত্যাদি
🖊️ এই বদলের ফলে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য-র সংযোগ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বিশ্বসাহিত্যের ছাঁচে স্থানীয়তা চাপা পড়ছে
পুরস্কার, অনুবাদ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—সবকিছু এখন নির্ভর করছে ‘গ্লোবাল থিম’-এর ওপর।
তাই প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের লেখা হয়ে পড়ছে “লোকালাইজড” আর “সেন্টিমেন্টাল”।
ফলাফল: সাহিত্যের আধুনিক মনোভাব দেশের চেয়ে বেশি চিন্তা করছে ‘বিশ্ব মানবতা’ নিয়ে।
সাহিত্যের আধুনিকীকরণ: একটি রূপান্তর নাকি একচোখো দৃষ্টিভঙ্গি?
ভাষা ও স্টাইলের পরিবর্তন
নতুন লেখায় সরলতা নয়, বরং বিমূর্ততা ও জটিলতা বেশি।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী সাহিত্য সবসময়ই সহজ, আবেগভিত্তিক, সরাসরি।
আধুনিক পাঠক এই সরলতাকে নিচু মানের সাহিত্য হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত করেন।
মূল্যায়ন ব্যবস্থায় গড়বড়
বর্তমান সাহিত্যের সমালোচকরা ‘টেকনিক্যাল এলিটিজম’ অনুসরণ করছেন।
ফলে দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন হচ্ছে একেবারে মৌলিক স্তর থেকেই।
বিশেষ তথ্য: গত ১০ বছরে সাহিত্যের যে সমস্ত সরকারি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তার মাত্র ৩% ছিল জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য-ভিত্তিক রচনার জন্য।
বাস্তব ঘটনা: এক বিস্মৃত বিপ্লবী লেখক
🧾 গল্প: ‘রঘুনাথ চক্রবর্তী’ – এক বিস্মৃত নাম
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময়, মেদিনীপুরের রঘুনাথ চক্রবর্তী নামের এক স্কুল শিক্ষক রাতে বসে কবিতা লিখতেন।
তাঁর লেখা:
👉 “তুই শুধু সীমান্ত নয়, তুই আমার ভোরের আলো” – এই পঙক্তিটি সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হত প্রতিদিন সকালে, মনোবল বৃদ্ধির জন্য।
অথচ আজ এই মানুষটির নাম নেই কোনো পাঠ্যসূচিতে।
তাঁর লেখা প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক হিসেবে জাতীয়তাবাদের বার্তা বহন করলেও, আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত তাকে জায়গা দেয়নি, কারণ তার ভাষা ছিল সরল এবং বক্তব্য স্পষ্ট।
পাঠকের মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন
ভোক্তাপরিস্থিত সাহিত্য
আজকের পাঠক সাহিত্য থেকে খুঁজে পান ব্যক্তিগত মুক্তি, নয় আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা।
তাই জাতীয়তাবাদী সাহিত্য তাঁরা পড়েন ‘মর্যাদাপূর্ণ পুরাতন বই’ হিসেবে—not emotional identity।
প্রজন্মগত ফাঁক
নতুন প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেম মানে ‘ট্রেন্ডি হ্যাশট্যাগ’ – সাহিত্যে তার জন্য সময় কম।
এই ফাঁক তৈরি করছে এমন এক সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা, যেখানে দেশের প্রতি আবেগ আর কলমে ধরা পড়ে না।
নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক
সাহিত্যের আধুনিকীকরণ অবশ্যই জরুরি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের মুছে ফেলতে হবে।
বরং নতুনভাবে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য-কে একত্র করে তোলা দরকার—জীবনঘনিষ্ঠ গল্প, হাইব্রিড ভাষা, সিনেমাটিক প্রকাশভঙ্গি দিয়ে।
আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত যতই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠুক না কেন, দেশের ইতিহাস, আত্মত্যাগ আর আবেগ কখনও মুছে ফেলা যায় না।
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকরা হয়তো আজ পাতায় নেই, কিন্তু তাঁদের কলমেই লেখা আছে আমাদের রক্তাক্ত শিকড়।
সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ: প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের অন্তরাল জীবন
একটা সময় ছিল, যখন সাহিত্য ছিল সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। কিন্তু আজ? প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকরা অনেকটাই নীরব, একপ্রকার সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা-র শিকার। শুধু বাহ্যিক অবহেলা নয়, এই চুপিসারে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আছে একধরনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ—যা আসলে সাহিত্যের অন্দরমহলের অদৃশ্য যুদ্ধ।
সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা: কীভাবে তা জন্ম নেয়?
সৃষ্টিশীল অনুপ্রেরণার অভাব
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের লেখায় দেশে প্রেম থাকলেও—তা আজকের প্রজন্মের কাছে নস্টালজিয়া বলে মনে হয়।
এই দূরত্ব লেখকদের হতাশ করে তোলে।
ফলে তাঁরা ধীরে ধীরে লেখার অভ্যাস হারান।
📝 উদাহরণ: আশুতোষ মজুমদার, এক প্রাক্তন সেনা ও লেখক, স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে ‘তেজস্বিনী’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। প্রকাশকের অনিচ্ছা ও সমালোচকদের “ওভার ইমোশনাল” তকমা তাঁকে লেখার জগৎ থেকে সরিয়ে দেয়। গত ১২ বছরে আর একটি বইও লেখেননি।
পাঠক ও প্রকাশকের তির্যক দৃষ্টি
বহু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আজ জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য-কে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘লোকসানের বস্তু’ বলে মনে করে।
পাঠকেরাও সাহিত্যে ‘ড্রামা’ চান, দেশপ্রেম নয়।
এই চাহিদার পার্থক্য লেখকদের সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা-তে ঠেলে দেয়।
অভ্যন্তরীণ বিরোধ: সাহিত্যিক মহলের দ্বিমত
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক বনাম আধুনিক লেখক
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকরা বিশ্বাস করেন সাহিত্য এক ধরনের সামাজিক দায়িত্ব।
অপরদিকে আধুনিক লেখকরা বলেন, সাহিত্য হোক ব্যক্তিগত, রাজনীতি-বর্জিত।
এই মূল দৃষ্টিভঙ্গির সংঘর্ষ থেকেই জন্ম নেয় অভ্যন্তরীণ বিরোধ।
🧩 বিশেষ তথ্য: কলকাতার একটি নামী সাহিত্যসভায় ২০২৩ সালে একটি প্যানেল আলোচনা বাতিল করা হয়, কারণ আলোচনার বিষয় ছিল: “জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য: বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা”। আধুনিক লেখকদের একাংশ এটিকে ‘রাষ্ট্র প্রচার’ বলে বিরোধিতা করেন।
সাহিত্য পুরস্কারে পক্ষপাতিত্ব
সাহিত্যিক পুরস্কার নির্ধারণে আজ যে প্যানেল বসে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত-এর ধারক।
ফলে দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে জাতীয় সাহিত্য পুরস্কারে জাতীয়তাবাদী সাহিত্য স্থান পেয়েছে মাত্র ২ বার।
ব্যক্তিগত অভিমান ও আত্মনির্বাসন
পেশাদার মহলে ‘বিরুদ্ধ স্বর’ হয়ে ওঠা
অনেক প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক নিজের অজান্তেই ‘রাজনৈতিক ঘরানার লেখক’ হিসেবে ট্যাগড হয়ে পড়েন।
এতে তাঁর পরিচিতি সংকুচিত হয়।
ফলে, তিনি নিজেই সাহিত্যের মূলধারা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
🧾 বাস্তব কাহিনি:
বর্ধমানের বাসিন্দা লেখক নীলরতন গোস্বামী তাঁর উপন্যাস “শেষ পতাকা”য় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের নিয়ে গর্বের গল্প লিখেছিলেন।
পাঠকপ্রিয়তা পেলেও, তিনি ৩টি বড় লিট ফেস্ট থেকে বাদ পড়েন, কারণ আয়োজকদের মতে “উনি কিছুটা বেশি দেশপ্রীমী”।
প্রভাব: সাহিত্য সমাজে নতুন ধরনের বিভাজন
বিভাজনমূলক সাহিত্য প্রবণতা
আজ সাহিত্যে দেখা যাচ্ছে দুই স্পষ্ট লাইন:
📚 জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য
🧪 আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বস্তুনিষ্ঠতা
এর ফলে লেখকরা আলাদা আলাদা ‘ঘরানা’তে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন।
পাঠকের দ্বিধা
একজন সাধারণ পাঠক এখন দ্বিধায় পড়ে যায়—সে কি আবেগকে মূল্য দেবে, না বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণকে?
এই দ্বিধা প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা আর অভ্যন্তরীণ বিরোধ কেবল কিছু লেখকের দুঃখ নয়, এটা গোটা সাহিত্যের দায়।
যতদিন না জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সম্মান পাবে, ততদিন প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের কলম নীরবই থাকবে।
সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ: আধুনিক সাহিত্যে প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের নিঃশব্দ পরিত্যাগ
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের বর্তমান সাহিত্যের পরিমণ্ডলে ক্রমাগত অন্তরালে চলে যাওয়ার মূল দুই কারণ—সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধ। বিষয়টি শুধু শিল্পের সমস্যা নয়, এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংকট, যেখানে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য একে অপরের পরিপূরক নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।
সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা: মনোজগতের এক অপ্রকাশ্য প্রতিবাদ
আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত থেকে বাদ পড়া
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকদের লেখার ভাষা, আবেগ, এবং বিষয়বস্তু আজকের আধুনিক সাহিত্য পরিপ্রেক্ষিত-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সাহিত্যের আধুনিক মনোভাব এক ধরনের বিমূর্ততা, নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বজনীনতা চায়, যেখানে দেশপ্রেমের প্রকাশ প্রায় ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়ে।
এই বৈপরীত্য লেখকদের মাঝে লেখার ইচ্ছাকে নষ্ট করে।
🎤 বাস্তব ঘটনা: বাংলা সাহিত্যের একসময়ের উজ্জ্বল নাম ছিল অনিরুদ্ধ রায়। তাঁর উপন্যাস “স্বাধীনতার স্বর” ছিল ব্রিটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা। পাঠকপ্রিয় হলেও তিনি একাধিক সাহিত্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হন। এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যখন শুনি—আমার লেখা নাকি ‘পলিটিকালি ওভারলোডেড’—তখন মনে হয়, দেশের গল্প বলতে গিয়ে আমি কি অপরাধ করেছি?”
সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা মানে শুধু না লেখা নয়
লেখক অনেক সময় লিখছেন, কিন্তু প্রকাশ করছেন না।
অনেকে আত্মপ্রকাশের আগেই থেমে যান, কারণ বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য সমালোচনা তাঁদের নিরুৎসাহ করে তোলে।
মূলধারার সাহিত্যপত্র বা সাময়িকীতে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্যকে ‘চিন্তাহীন আবেগ’ হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা তাঁরা অবলীলায় অনুভব করেন।
অভ্যন্তরীণ বিরোধ: প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক বনাম আধুনিক সাহিত্য ধারক
সাহিত্যিক রাজনীতির অদৃশ্য লাইন
সাহিত্যের রাজনৈতিক রূপ আজকাল ঘুরপাক খায় এক কঠিন জটিলতায়—
একদল লেখক বিশ্বাস করেন, সাহিত্য রাষ্ট্রনিরপেক্ষ হওয়া উচিত।
অন্যদিকে, প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক মনে করেন, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।
এই বিতর্ক অভ্যন্তরীণ বিরোধ তৈরি করে, যেখানে দেশপ্রেমিক লেখকরা প্রান্তিক হয়ে পড়েন।
সাহিত্য মাফিয়ার মতো গোষ্ঠীবদ্ধ প্রভাব
সাহিত্য মহলে অদৃশ্য গোষ্ঠীবদ্ধতা কাজ করে, যা জাতীয়তাবাদী সাহিত্য-কে নিয়মিতভাবে উপেক্ষা করে।
উৎসব, পুরস্কার, আলোচনাচক্র—সব জায়গাতেই আধুনিক লেখকরা মুখ্য ভূমিকা নেন, আর প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিকরা অদৃশ্য হয়ে যান।
সাহিত্যের সমালোচনা এখন অনেকাংশেই মতাদর্শনির্ভর।
🧾 প্রাসঙ্গিক ঘটনা:
২০১৯ সালের এক প্রখ্যাত সাহিত্য পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন লেখক বিভাস চক্রবর্তী, তাঁর বই “জাতির পাথেয়”-এর জন্য। পরে জানা যায়, জুরির একাংশ তাঁর ‘অতিরিক্ত ভারতকেন্দ্রিক মনোভাব’ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে নাম বাদ দেন। বিভাসবাবু সেই থেকে আর কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেননি।
সাহিত্যিক আত্মগ্লানি ও মনস্তাত্ত্বিক অবসাদ
লেখকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
প্রতিনিয়ত এই অবমূল্যায়ন লেখকের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে।
এক সময় আসে, যখন তিনি ভাবেন—“আমি কি ভুল সময়ে লিখছি?”
এই অনুভব থেকেই জন্ম নেয় সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা, যা তাঁর সৃষ্টিশীলতার অকাল মৃত্যু ঘটায়।
পাঠকের নীরবতা
পাঠকের চোখে আজ প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক মানে হয় ইতিহাসের ক্লিশে, নয় একঘেয়ে বক্তব্য।
এই গ্রহণযোগ্যতার অভাব লেখকের কাছে হয় এক ধরনের বর্জন।
একমাত্রিক পাঠ প্রতিক্রিয়া তাঁকে ধীরে ধীরে নীরব করে তোলে।
ফলাফল: প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক মানেই নিঃসঙ্গ লড়াই
সমসাময়িক সাহিত্যে বিচ্ছিন্নতা
আজ আধুনিক সমাজে সাহিত্য হিপ, কনটেম্পোরারি, দার্শনিক—এমনকি রাজনৈতিকও, কিন্তু ‘দেশভক্ত’ নয়।
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক তাই ঐতিহাসিক ডায়েরির লেখকের মতো—যার কণ্ঠ সকলে পড়ে, কিন্তু শোনে না।
প্রজন্মান্তরের সংযোগ ছিন্ন হওয়া
নতুন প্রজন্মের লেখকরা অনেকেই মনে করেন—জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য এক ধরনের বিপদজনক মিশ্রণ।
এই ভুল ব্যাখ্যা দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন-কে আরও প্রবল করে তোলে।
সাহিত্যিক নিষ্ক্রিয়তা ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ কেবল কিছু প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-এর ব্যক্তিগত যন্ত্রণা নয়, এটি এক গভীর সাংস্কৃতিক দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। যতদিন না জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য-কে ন্যায্যভাবে আলোচনার জায়গায় আনা হবে, ততদিন অনেক প্রতিভাবান কণ্ঠ নির্বাক হয়ে পড়বে।
আধুনিক সমাজে সাহিত্য ও বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি
— যখন প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক রয়ে যান ‘আউটডেটেড’ হিসেবে চিহ্নিত
আধুনিক সমাজের সাহিত্য দর্শন: এক বৈশ্বিক মানসিকতা
বিশ্বজনীনতা বনাম দেশপ্রেম
আধুনিক সমাজে সাহিত্য আজ ব্র্যান্ডেড “গ্লোবাল থট”-এর প্রজেকশন।
এই বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি চায় ভাষা, সংস্কৃতি, ও ভূখণ্ড-নিরপেক্ষ এক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
বিপরীতে, প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-এর সৃষ্টি মূলত ভূখণ্ডনির্ভর, অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এবং স্থানিক আবেগঘন।
ফলে আধুনিক সাহিত্যের এই অপার্থিব বৈশ্বিকতা-র মাঝে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য যেন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে।
“আউটডেটেড” লেবেল—এক মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা
একাধিক সাহিত্য আলোচনায় দেখা যায়, প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-দের লেখা প্রায়শই “ন্যারো ন্যাশনালিস্ট ন্যারেটিভ” বলে উল্লেখ করা হয়।
একবার কোনো লেখক এই ‘লেবেল’ পেয়ে গেলে, তা তাঁর সাহিত্যিক ভবিষ্যতকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে প্রভাবিত করে।
📘 বাস্তব ঘটনা: ২০১৫ সালে বিশাখা ভট্টাচার্য-এর উপন্যাস “মাটি ও মানচিত্র” প্রকাশিত হয়। মূলত বাংলা ভাষায় লেখা এই উপন্যাস ছিল এক সেনানায়কের চোখে দেখা ভারত-পাক যুদ্ধের দলিল। কিন্তু কলকাতার এক প্রভাবশালী সাহিত্য চক্র এটিকে “পলিটিকাল প্রপাগান্ডা” বলে রিভিউ দেয়। ফলত, বইটি জনপ্রিয় হলেও কোন সাহিত্য পুরস্কারই পায়নি। বিশাখা এক সাক্ষাৎকারে বলেন—“আমি কী ভুল করেছিলাম? আমি শুধু আমার বাবার দেখা দেশ বলেছি…”
বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতির বৈশিষ্ট্য ও প্যাট্রিওটিক লেখার সঙ্গে সংঘাত
বিষয়বস্তুতে সীমাহীনতা
বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি চায় এমন একটি বিষয় যা ‘সকলের’, যেমন—মানবতা, পরিবেশ, একাকীত্ব।
বিপরীতে, প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক লেখেন “আমার দেশের ইতিহাস”, “আমার জাতির বেদনা”, “আমার ভাষার গল্প”।
ফলে, বিশ্বসাহিত্যের মানদণ্ডে সেই লেখা হয়ে পড়ে “লোকাল” এবং কখনও কখনও “সেন্টিমেন্টাল”।
ভাষার নিরপেক্ষতা বনাম আবেগঘন ভাষাবিন্যাস
বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি-র ভাষা সাধারণত ঠান্ডা, পর্যবেক্ষণধর্মী ও বিমূর্ত।
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-এর ভাষা ঘন, কবিত্বপূর্ণ, ও মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ, কারণ তা হৃদয়ের গভীর থেকে আসে।
এই ভাষাগত ফারাক আধুনিক সমাজে সাহিত্য-কে এক ধরনের শ্রেণিবদ্ধতা তৈরি করতে সাহায্য করে।
পাঠক-মনস্তত্ত্ব ও সাহিত্যিক বিপর্যয়
তরুণ পাঠকের মানসিক প্রবণতা
আজকের পাঠক—বিশেষ করে শহুরে তরুণ প্রজন্ম—প্রায়শই প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-দের লেখা পড়ে অনুভব করেন, এটি অতীতমুখী বা “মরাল সেন্টার্ড”।
তাঁদের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ কল্পবিজ্ঞানের অদূর ভবিষ্যৎ, সম্পর্কের জটিলতা, এবং ব্যক্তিগত মানসিক অন্বেষণে বেশি।
ফলে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য রয়ে যায় পাঠকের দৃষ্টিসীমার বাইরেই।
সাহিত্যের হাইপার-মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং
আধুনিক সমাজে সাহিত্য শুধুমাত্র সাহিত্যিক মানের ভিত্তিতে নয়, বরং বিপণনের দক্ষতার ওপরও নির্ভর করে।
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-রা মূলত নির্লিপ্ত, আত্মস্থ লেখক; তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব একটা সক্রিয় নন।
ফলে তাঁদের লেখা ব্র্যান্ড হতে পারে না—আর বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি ব্র্যান্ডেড লেখক চায়।
বিশ্বব্যাপী সাহিত্য পুরস্কারে প্রবণতা
লংলিস্ট ও শর্টলিস্টে “প্যাট্রিওটিক সাহিত্য” নেই কেন?
আন্তর্জাতিক পুরস্কার যেমন ম্যান বুকার, পেন ফকনার বা সাহিত্য অ্যাকাডেমি—সেখানে বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি-র আধিপত্য সুস্পষ্ট।
যেসব লেখা “ন্যাশনাল ইমোশন” বহন করে, সেগুলিকে প্রায়শই ‘প্রচারণামূলক’ বলে উপেক্ষা করা হয়।
এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-দের লেখার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
📝 প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২০২2 সালে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য জার্নাল “GlobeLit” তাদের সম্পাদকীয়তে জানায়—“We are consciously avoiding literature that over-emphasizes patriotism, nationalism or military history, as we believe in a global citizenship-oriented narrative.”
আধুনিক সমাজে সাহিত্য ও বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি আজ এমন এক রূপরেখা তৈরি করেছে, যেখানে প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক যেন এক অনাহুত ভাস্কর—অভিজাত পাঠককুলের জন্য খুব বেশি ‘স্থানিক’, আর পুরস্কারপ্রদান সংস্থার কাছে অতিমাত্রায় ‘রাজনৈতিক’। তবু সত্যি কথা এই যে, যতই জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য কে অন্তরালে ঠেলে দেওয়া হোক, যতদিন মানুষ তার শিকড় ভুলবে না, ততদিন এই সাহিত্যের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে না—হয়তো শুধু বদলে যাবে তার প্রকাশভঙ্গি।
দেশপ্রেমিক সাহিত্যিকদের অবমূল্যায়ন: একটি ভাবনা
— যখন সাহিত্যিক মূল্যের বিচার হয় জনপ্রিয়তার পাল্লায়
সাহিত্যিকদের পরিচিতি নির্মাণে দ্বৈত মানদণ্ড
জনপ্রিয়তা বনাম আদর্শভিত্তিক সাহিত্য
আজকের আধুনিক সমাজে সাহিত্য মূলত একটি “রিডার বেসড প্রডাক্ট”—যা পাঠকের বাজার চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত।
এই পদ্ধতিতে দেশপ্রেমিক সাহিত্যিক-দের চিন্তাশীল, সময়সন্ধানী ও আদর্শনিষ্ঠ রচনাগুলি পড়ে যায় অবহেলায়, কারণ তারা ‘ট্রেন্ডি’ নয়।
ফলে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য মিলে যে নীতিনির্ভর সাহিত্যিক ধারা তৈরি হয়, তা এক প্রকার সাহিত্যিক অবমূল্যায়ন-এর শিকার।
“ভালো লেখক মানেই নির্দ্বিধায় নিরপেক্ষ”—এই মিথ
আধুনিক সাহিত্যিক মূল্যায়নে একটি ভ্রান্ত ধারনা হল: সাহিত্যিকদের রাজনীতি, সমাজ বা জাতীয়তা নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান থাকা চলবে না।
দেশপ্রেমিক সাহিত্যিক-রা যখন তাঁদের লেখায় জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য মেলান, তখন তা “biased” বলে পরিগণিত হয়।
অথচ আদর্শভিত্তিক সাহিত্য চর্চা মানেই পক্ষপাত নয়—বরং তা আত্মপরিচয়ের সাহসী প্রতিচ্ছবি।
প্রকাশনা ও প্রাতিষ্ঠানিক গেটকিপিং
মঞ্চ পাওয়ার লড়াই
বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি-কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আজকের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-দের বই “মার্কেটেবল” নয় বলে সরিয়ে রাখা হয়।
বহু প্রকাশক এমন লেখাকে “সংবেদনশীল” বা “রাজনৈতিক বিতর্কমূলক” হিসেবে বাতিল করেন।
📘 বাস্তব কাহিনি: ২০১9 সালে হুগলির শিক্ষক ও লেখক অনিরুদ্ধ গাঙ্গুলির লেখা “প্রতিরোধের পাতা” (একটি সত্তর দশকের বাংলার নকশাল আন্দোলনে জাতীয়তাবোধের অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা উপন্যাস) কলকাতার তিনটি নামী প্রকাশনা সংস্থা প্রত্যাখ্যান করে। শেষমেশ বইটি ছোট এক ইনডি প্রেস থেকে বের হয়। পরের বছর এই বইটি একটি সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবুও কোনও জাতীয় সাহিত্য পুরস্কারের আলো বইটির গায়ে পড়েনি।
সাহিত্য পুরস্কার এবং প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া মানদণ্ড
পুরস্কার মানেই প্রগতিশীলতা?
বেশিরভাগ সাহিত্য পুরস্কার আজ এমন লেখাকে পুরস্কৃত করে যেগুলো “সমাজের গ্লোবাল বাস্তবতা” তুলে ধরে।
জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য যেখানে আবেগ ও ঐতিহ্যের কথা বলে, সেখানকার লেখকরা “কনসারভেটিভ” বা “রিগ্রেসিভ” হিসেবে দাগানো হন।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব ও সাহিত্যিক মূল্যবোধ
প্যাট্রিওটিক সাহিত্যিক-রা সাহিত্যকে গণসচেতনতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান।
কিন্তু আজকের সাহিত্য পুরস্কার সংস্থা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বা মেট্রো শহরকেন্দ্রিক গোষ্ঠীগুলি, সাহিত্যকে দেখে এক ‘নির্বিকল্প ভাববাদ’ হিসেবে।
ফলে, আবেগ, দেশপ্রেম এবং বীরত্ব যেখানে সাহিত্য হয়ে ওঠে, তা তাদের মানদণ্ডে “বস্তাপচা” ধরা হয়।
মিডিয়া ও সমালোচকদের ভূমিকা
প্রভাবিত পাঠকমন
সাহিত্য রিভিউ, ইউটিউব চ্যানেল, বইব্লগ ইত্যাদিতে বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি-র আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।
পাঠকরা এসব দেখে আধুনিক সমাজে সাহিত্য বলতে মনে করেন সেটাই “ওয়েস্টার্নাইজড বা নিউট্রাল” সাহিত্য।
এতে দেশপ্রেমিক সাহিত্যিক-দের লেখা পাঠের আগ্রহ তৈরি হওয়ার আগেই তা চাপা পড়ে যায় ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ছাপের নিচে।
সমালোচনার ভাষা ও উপেক্ষা
অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য নির্ভর লেখাকে ‘প্রচারণামূলক’, ‘অতি আবেগঘন’, বা ‘সংঘাতময়’ বলে ট্যাগ দেওয়া হয়।
অথচ সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু বা ঋত্বিক ঘটকের মতো মহীরুহরাও তাঁদের লেখায় দেশ ও জাতির কথা বলেছেন। তাঁদের ক্ষেত্রে সেটি সাহিত্য, আজ সেটিই হয়ে উঠেছে বিতর্ক।
আজকের আধুনিক সমাজে সাহিত্য যদি হয়ে থাকে ভিন্নতার, উদারতার ও অন্তর্ভুক্তির প্রতীক, তবে কেন দেশপ্রেমিক সাহিত্যিক-দের উপেক্ষা করা হয়? বিশ্বজনীন সাহিত্য রীতি-র নামে একরৈখিকতা চাপিয়ে দেওয়া হলে, তা কি সত্যিই সাহিত্যের অগ্রগতি, না এক নীরব বিদ্রুপ? এক নতুন সাহিত্যিক বিবেক দরকার—যেখানে জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য একত্রে বসবাস করতে পারে, পরস্পরের অস্বীকার না করে।