মন্দির শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্র নয়, এটি ভারতের এক অনন্য শিল্প-সংস্কৃতির সজীব নিদর্শন। হাজার বছর ধরে মন্দিরগুলোর প্রতিটি ইট, প্রতিটি খোদাই করা ভাস্কর্য একেকটি গল্প বলে। কখনও দেব-দেবীর মহিমা, কখনও রাজবংশের ঐতিহ্য, আবার কখনও প্রকৃতি ও জ্যামিতির এক জাদুকরি সংমিশ্রণ—এই মন্দিরগুলি ভারতীয় সভ্যতার সময়সাক্ষী।

প্রাচীন স্থপতিরা পাথরের বুকে যে নিখুঁত শিল্প ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আজও আমাদের বিস্মিত করে। মন্দিরের অলংকৃত স্তম্ভ, জ্যামিতিক নকশা, আকাশ ছোঁয়া গোপুরাম আর সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখে মনে হয়, এ যেন কোনও এক ঈশ্বরীয় হাতের ছোঁয়ায় তৈরি এক অনন্য সৃষ্টি! প্রতিটি মন্দির শুধু স্থাপত্যের নয়, বরং বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যামিতির এক বিস্ময়কর নিদর্শন।

এই অনন্য মন্দিরগুলি শুধু তীর্থস্থান নয়, বরং স্থাপত্যপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। ভারতের পুরানো মন্দিরগুলির প্রতিটিতে লুকিয়ে আছে অপূর্ব শিল্পকলা, ঐতিহাসিক রহস্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। এই প্রবন্ধে আমরা আবিষ্কার করব ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যের ১০ টি বিস্ময়কর মন্দির, যেগুলি শুধু ভক্তদের নয়, ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকদের মনও জয় করে নেয়। আপনি কি প্রস্তুত এই অনন্য ভ্রমণের জন্য?

সূচিপত্র

মন্দির স্থাপত্যের বিস্ময়: অতীতের নিখুঁত শিল্পকর্ম

ভারতের মন্দির স্থাপত্য শুধু প্রার্থনার স্থান নয়, এটি অতীতের এক অমর কাব্য। হাজার বছরের পুরনো এই মন্দিরগুলি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক নয়, বরং তা ভারতীয় সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও শৈল্পিক কৌশলের এক অনন্য নিদর্শন। প্রতিটি মন্দির যেন এক মহাকাব্যিক সৃষ্টি, যার প্রতিটি ইট, প্রতিটি খোদাই করা ভাস্কর্য একেকটি গল্প বলে।

এই মন্দিরগুলির স্থাপত্য এতটাই সূক্ষ্ম এবং জটিল যে তা আজও স্থপতিদের বিস্মিত করে। খোদিত পাথরে ফুটে ওঠা নৃত্যের দৃশ্য, শাস্ত্রীয় কাহিনি, দেব-দেবীর প্রতিমা এবং জ্যামিতিক নিখুঁত বিন্যাস দেখে মনে হয়, এটি কোনও মানবীয় নির্মাণ নয়, বরং দেবশিল্পীদের স্পর্শে গড়ে ওঠা এক অপূর্ব সৃষ্টি। ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যে এই মন্দিরগুলি বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও শিল্পকলার এক আশ্চর্য মেলবন্ধন।

প্রতিটি মন্দিরের নির্মাণশৈলী একে অপরের থেকে আলাদা, যা বিভিন্ন শাসকের রুচি, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার প্রকাশ ঘটায়। দক্ষিণ ভারতের বিশাল গোপুরাম, উত্তর ভারতের নাগরা শৈলী, ওড়িশার কলিঙ্গ স্থাপত্য কিংবা পশ্চিমবঙ্গের টেরাকোটা মন্দির—সবাই নিজ নিজ সৌন্দর্যে অনন্য। ভারতের পুরানো মন্দিরগুলি শুধু ধর্মীয় তীর্থস্থান নয়, বরং স্থাপত্যপ্রেমী, ইতিহাসবিদ এবং পর্যটকদের জন্য এক অপার বিস্ময়।

এই প্রবন্ধে আমরা আবিষ্কার করব ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যের ১৫টি বিস্ময়কর মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য ও রহস্য। চলুন, এক নজরে দেখে নিই ভারতের পুরানো মন্দিরগুলির মধ্যে ১৫টি উল্লেখযোগ্য মন্দির, যেগুলি স্থাপত্যের বিস্ময় হিসেবেই আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। আপনি কি প্রস্তুত এই ঐতিহাসিক ভ্রমণের জন্য?

লেপাক্ষী বীরভদ্র মন্দির, অন্ধ্রপ্রদেশ: স্থাপত্য ও ইতিহাসের বিস্ময়

লেপাক্ষী বীরভদ্র মন্দির ভারতের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য, যা অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রী সত্যসাই জেলায় অবস্থিত। ১৬শ শতকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজা আচ্যুতদেব রায়ের শাসনামলে দুই ভাই, বিরুপন্না এবং বীরান্না, এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। মন্দিরটি হিন্দু পুরাণের এক ঐতিহাসিক কাহিনির সঙ্গে জড়িত, যেখানে লঙ্কাপতি রাবণ যখন সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জটায়ু নামক এক বিশাল পাখি তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। রাবণ যখন জটায়ুকে মারাত্মকভাবে আহত করেন, তখন ভগবান রাম এখানে এসে জটায়ুর শেষ সময়ের সাক্ষী হন এবং বলেছিলেন “লে পাক্শি”, যার অর্থ “ওঠো পাখি”। এখান থেকেই লেপাক্ষী নামের উৎপত্তি।

Lepakshi, Lepakshi - TimesTravel


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

বীরভদ্র মন্দির দ্রাবিড় ও বিজয়নগর স্থাপত্যের অপূর্ব মিশ্রণ। এটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি এক বিস্ময়কর ভাস্কর্যশিল্পের সংগ্রহশালা, যা ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন

স্তম্ভবিহীন শিলা ভাস্কর্য

  • মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ হলো “ভাসমান স্তম্ভ”, যা মাটির স্পর্শ ছাড়াই শূন্যে ঝুলে রয়েছে।
  • এটি ভিজয় নগর স্থাপত্যকলার দক্ষতার প্রমাণ, যেখানে ভারসাম্যের মাধ্যমে পাথরকে স্থির রাখা হয়েছে।
  • পর্যটকরা এই স্তম্ভের নিচে কাপড় বা কাগজ চালিয়ে এটি পরীক্ষা করেন।

মন্দিরের প্রধান কাঠামো ও গর্ভগৃহ

  • মন্দিরের প্রধান অংশে ভগবান বীরভদ্রের বিগ্রহ স্থাপিত, যিনি শিবের এক রুদ্র রূপ।
  • গর্ভগৃহের চারপাশে অসংখ্য পাথরের খোদাই করা মূর্তি রয়েছে, যা দেবদেবী, অপ্সরা ও পৌরাণিক দৃশ্য প্রদর্শন করে।
  • মন্দিরের ছাদে বিভিন্ন পৌরাণিক চিত্র অঙ্কিত রয়েছে, যা ভিজয়নগর আমলের আঁকা ফ্রেস্কো শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

বিশাল নন্দী মূর্তি

  • মন্দিরের কিছুটা দূরে অবস্থিত বিশালাকার একশিলা নন্দী মূর্তি, যা ভারতের বৃহত্তম একক পাথরের নন্দী ভাস্কর্য।
  • মূর্তিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ ফুট এবং উচ্চতা ১৫ ফুট, যা সম্পূর্ণ গ্রানাইট পাথর থেকে তৈরি।
  • নন্দীর মুখ ভগবান শিবের দিকে তাক করা, যা মন্দিরের মূল গর্ভগৃহের দিকে নির্দেশ করে।

কল্পবৃক্ষ ও গণেশ মূর্তি

  • মন্দির চত্বরে রয়েছে একটি বিশাল কল্পবৃক্ষের খোদাই, যা জীবনের শাশ্বততা প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • একটি বৃহৎ গণেশ মূর্তি রয়েছে, যা মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ।

মণ্ডপ ও খোদাই করা স্তম্ভ

  • মন্দিরের “নট্যমণ্ডপ” বা নৃত্যমণ্ডপের স্তম্ভগুলোতে অপূর্ব খোদাই করা নর্তকী ও দেবদেবীর চিত্র দেখা যায়।
  • স্তম্ভের খোদাইগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম, যা বিজয়নগর স্থাপত্যের জটিল নকশার পরিচায়ক।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রভাব

  • লেপাক্ষী মন্দিরের স্থাপত্য বিজয়নগর আমলের সমৃদ্ধ স্থাপত্যশৈলীর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
  • এই সময়কালেই ভারতের মন্দির নির্মাণশিল্পে এক নতুন ধারা দেখা দেয়, যেখানে বৃহৎ পাথর খোদাই করে মূর্তি নির্মাণের প্রচলন ঘটে।

পুরাণের সঙ্গে সম্পর্ক

  • রামায়ণের জটায়ুর কাহিনির কারণে মন্দিরটি ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • জনশ্রুতি রয়েছে যে, মন্দির নির্মাণের সময় অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগে নির্মাতা বিরুপন্না মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন এবং তিনি নিজেই মন্দিরের এক অংশে তাঁর চোখ উপড়ে রেখে যান।

সংস্কৃতি ও শিল্পকলার কেন্দ্র

  • মন্দিরটি শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, এটি দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিল্পের এক অপূর্ব মিলনক্ষেত্র
  • ফ্রেস্কো পেইন্টিংগুলোতে বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র ও কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

কিভাবে পৌঁছাবেন লেপাক্ষী বীরভদ্র মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বেঙ্গালুরু, যা লেপাক্ষী থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরে।
  • রেলপথ: নিকটতম রেলস্টেশন হিন্দুপুর, যা লেপাক্ষী থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে।
  • সড়কপথ: বেঙ্গালুরু থেকে NH44 ধরে ২ ঘণ্টার মধ্যেই গাড়ি বা বাসে সহজে লেপাক্ষী পৌঁছানো যায়।

এলোরা কৈলাসনাথ মন্দির, মহারাষ্ট্র: স্থাপত্যের এক অতুলনীয় বিস্ময়

ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য নিয়ে আলোচনা হলে মহারাষ্ট্রের এলোরা কৈলাসনাথ মন্দির অবশ্যই এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম একশিলা খোদাই করা মন্দির, যা প্রমাণ করে প্রাচীন ভারতের স্থপতিরা কতটা দক্ষ এবং বিজ্ঞানসম্মত নির্মাণশৈলীতে পারদর্শী ছিলেন।

এই মন্দিরটি রাষ্টকূট রাজবংশের রাজা কৃষ্ণ প্রথম (৮ম শতাব্দী) নির্মাণ করেন। এটি মূলত ভগবান শিবের জন্য উৎসর্গ করা হলেও এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মন্দিরগুলোর অপূর্ব সহাবস্থান রয়েছে।

Ellora Cave Temples | Maharashtra, India | Attractions - Lonely Planet


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

কৈলাসনাথ মন্দির শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্যের বিস্ময়। এটি সম্পূর্ণ একটি পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে মন্দিরের গঠন ও শৈলী এককথায় অতুলনীয়।

একশিলা খোদাই প্রযুক্তি

  • পুরো মন্দিরটি একটি পাহাড় কেটে তৈরি, যা ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত।
  • প্রায় ৪,০০,০০০ টন পাথর সরিয়ে এই বিশাল মন্দির খোদাই করা হয়েছিল, যা নির্মাণশৈলীর অসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক।
  • উপরের দিক থেকে খোদাই করার ফলে মন্দিরের কাঠামোতে কোনো ভুল হয়নি, এবং প্রতিটি স্তম্ভ ও ভাস্কর্য নিখুঁতভাবে খোদাই করা হয়েছে।

কৈলাসনাথ মন্দিরের মূল কাঠামো

  • মন্দিরটি ভগবান শিবের কৈলাস পর্বতের অনুকরণে নির্মিত, তাই এর নাম “কৈলাসনাথ”।
  • প্রধান গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ স্থাপিত, যা ভক্তদের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক।
  • মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা প্রায় ১০৭ ফুট এবং পুরো মন্দির ২৭৬ x ১৫৪ ফুট জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।

প্রধান প্রবেশপথ ও স্তম্ভশ্রেণি

  • মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে বিশালাকার গজস্থান (হাতির মূর্তি), যা কৈলাসনাথের শক্তির প্রতীক।
  • মূল মন্দির চত্বরের চারপাশে রয়েছে স্তম্ভশ্রেণি ও গুহামন্দির, যা বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ফুটিয়ে তোলে।

ভাস্কর্য ও খোদাই করা দৃশ্য

  • মন্দিরের দেওয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনিচিত্র সূক্ষ্ম খোদাই করা হয়েছে।
  • মন্দিরের বিভিন্ন অংশে দেখা যায় শিব-পার্বতীর বিবাহ, রাবণ কর্তৃক কৈলাস পর্বত উত্তোলনের দৃশ্য, নটরাজ রূপে শিবের নৃত্য, ইত্যাদি।
  • মন্দিরের ছাদে সূক্ষ্ম খোদাই করা গণেশ, নন্দী, কার্তিকেয় ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি বিদ্যমান।

দ্রাবিড় ও নাগর স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ

  • মন্দিরের নির্মাণশৈলীতে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় শৈলী ও উত্তর ভারতের নাগর শৈলীর মিশ্রণ রয়েছে।
  • মন্দিরের স্তম্ভ ও ছাদে শৈব ধর্মের বিভিন্ন প্রতীক খোদাই করা হয়েছে, যা ভারতের পুরানো মন্দিরগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

রাষ্টকূট রাজাদের স্থাপত্য পৃষ্ঠপোষকতা

  • রাজা কৃষ্ণ প্রথমের আমলে (৮ম শতাব্দী) এলোরা গুহামন্দিরগুলোর মধ্যে কৈলাসনাথ সর্ববৃহৎ নির্মাণ
  • এটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন স্থাপত্যের মিলনস্থল, যা ভারতের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক।

মন্দির নির্মাণ রহস্য

  • আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই এত নিখুঁত স্থাপত্য নির্মাণ কিভাবে সম্ভব হয়েছিল, তা আজও এক রহস্য।
  • ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় ২০০ বছর ধরে হাজার হাজার শিল্পী ও স্থপতি একসঙ্গে কাজ করেছেন এই মহাকাব্যিক নির্মাণ শেষ করতে।

পৌরাণিক সম্পর্ক

  • কিংবদন্তি বলে, রাক্ষসরাজ রাবণ যখন কৈলাস পর্বত উত্তোলন করেছিলেন, তখন শিব তাঁর এক আঙুলের চাপে তা স্থির করে দেন। মন্দিরের এক দেয়ালে সেই দৃশ্য খোদাই করা আছে।
  • মন্দিরের বিভিন্ন খোদাইয়ে শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও দেবী দুর্গার বিভিন্ন কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে।

কিভাবে পৌঁছাবেন কৈলাসনাথ মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর অরঙ্গাবাদ বিমানবন্দর, যা এলোরা থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে।
  • রেলপথ: নিকটতম রেলস্টেশন অরঙ্গাবাদ, যা মুম্বাই, পুনে ও হায়দরাবাদ থেকে সরাসরি সংযুক্ত।
  • সড়কপথ: মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর থেকে বেসরকারি গাড়ি, ট্যাক্সি ও সরকারি বাস সরাসরি এলোরা পর্যন্ত চলে।

বৃহদীশ্বর মন্দির, তামিলনাড়ু: এক ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক বিস্ময়

বৃহদীশ্বর মন্দির, যা রাজরাজেশ্বর মন্দির নামেও পরিচিত, দক্ষিণ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য বিস্ময়। এটি তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুরে অবস্থিত এবং ১০০৩-১০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চোল সাম্রাজ্যের মহান শাসক রাজরাজা চোল I নির্মাণ করেন। এই মন্দির চোল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এবং ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

Brihadishvara Temple | History, Description, & Facts | Britannica


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

 মন্দিরের গঠনশৈলী ও উচ্চতা

বৃহদীশ্বর মন্দির দ্রাবিড় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত, যা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।মন্দিরের প্রধান গর্ভগৃহ (Sanctum Sanctorum) বা ভীমানা প্রায় ৬৬ মিটার (২১৬ ফুট) উঁচু, যা ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ গঠন।মন্দিরের শিখর বা কলাশ একটি একক গ্রানাইট পাথর দ্বারা তৈরি, যার ওজন প্রায় ৮০ টন!

 ছায়াহীন শিখর—স্থাপত্যের এক বিস্ময়

এই মন্দিরের স্থাপত্যের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হলো, এর প্রধান স্তম্ভ বা শিখরের ছায়া দিনের কোনও সময়েই মাটিতে পড়ে না!এটি এমনভাবে নির্মিত যে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে ছায়াটি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু মন্দিরের ভিত্তির উপর কখনোই স্থির থাকে না। এটি এক চমকপ্রদ জ্যামিতিক ও প্রকৌশল কৌশলের নিদর্শন।

 নির্মাণ উপকরণ ও প্রযুক্তি

এই মন্দির গ্রানাইট পাথর দ্বারা নির্মিত, যা স্বাভাবিকভাবে তাঞ্জাভুর অঞ্চলে পাওয়া যায় না।অনুমান করা হয়, ৬০ কিলোমিটার দূরের পাহাড় থেকে হাজার হাজার শ্রমিকের সাহায্যে এগুলো এনে নির্মাণ করা হয়েছিল।সেই সময়ের জন্য এত বিশাল আকারের পাথর তোলা এবং বসানো ছিল এক বিস্ময়কর প্রযুক্তিগত কীর্তি।

 মন্দির চত্বর ও অলংকরণ

মন্দির চত্বরের আয়তন প্রায় ২৪০ মিটার x ১২০ মিটার, যা চারপাশে উঁচু প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত।মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা বিভিন্ন নাট্য ও নৃত্য দৃশ্য, দেব-দেবীদের মূর্তি এবং যুদ্ধের চিত্র চোল সাম্রাজ্যের গৌরব প্রকাশ করে।এখানে প্রায় ১০০০-এরও বেশি খোদাইকৃত ভাস্কর্য রয়েছে, যেগুলি চোল যুগের কাহিনি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনকে তুলে ধরে।


ঐতিহাসিক গুরুত্ব

 রাজরাজা চোলের গৌরবের প্রতীক

রাজরাজা চোল I ছিলেন চোল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা। তিনি তার সাম্রাজ্যের শক্তি, ঐশ্বর্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটানোর জন্য এই মন্দির নির্মাণ করেন।মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর, রাজা নিজেকে “শিবের প্রতিনিধি” ঘোষণা করেন এবং এই মন্দিরকে সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র বানান।

 চোল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের প্রতিচ্ছবি

চোল রাজারা কেবল দক্ষ যোদ্ধাই ছিলেন না, তারা বিজ্ঞান, স্থাপত্য, সাহিত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন।বৃহদীশ্বর মন্দিরে চোল যুগের প্রশাসনিক নথি, দানপত্র ও সামরিক কৌশল সম্পর্কিত তথ্য খোদাই করা আছে, যা ঐ সময়ের সমাজব্যবস্থার ধারণা দেয়।

 মন্দিরের প্রাচীন শিলালিপি

এখানে ৬০টিরও বেশি তামিল শিলালিপি পাওয়া গেছে, যেখানে রাজা রাজরাজা চোলের দান, মন্দিরের অর্থব্যবস্থা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে তথ্য রয়েছে।এগুলো চোল সাম্রাজ্যের অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ দলিল।


মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো ও মূর্তি

 নটরাজ মূর্তি ও শিবলিঙ্গ

এই মন্দিরটি ভগবান শিবকে উৎসর্গ করে তৈরি করা হয়েছে এবং এর গর্ভগৃহে বিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হয়েছে, যার উচ্চতা প্রায় ৪ মিটার (১৩ ফুট)।শিবের নটরাজ মূর্তি এখানে বিশেষ আকর্ষণীয়, যা চোল যুগের সেরা ব্রোঞ্জ শিল্পের নিদর্শন।

 বিশাল নন্দী মূর্তি

মন্দিরের প্রবেশপথে প্রায় ৬ মিটার দীর্ঘ ও ৪ মিটার উঁচু বিশালাকার নন্দী মূর্তি রয়েছে।এটি একটি একক গ্রানাইট পাথর থেকে তৈরি এবং ভারতের অন্যতম বৃহৎ নন্দী মূর্তি বলে বিবেচিত।

 সুবিশাল প্রাকার ও গোপুরাম

মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ৩০ মিটার উচ্চতার গোপুরাম বা রাজকীয় প্রবেশদ্বার রয়েছে, যা অসাধারণ নকশা ও অলংকরণে সজ্জিত।মন্দিরের চারদিকে প্রশস্ত করিডোর ও স্তম্ভের সারি রয়েছে, যা তৎকালীন স্থাপত্যশৈলীর চূড়ান্ত নিদর্শন।


বর্তমান অবস্থান ও ঐতিহ্য

১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো বৃহদীশ্বর মন্দিরকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের (UNESCO World Heritage Site) স্বীকৃতি দেয়।এটি এখন “গ্রেট লিভিং চোল টেম্পলস” নামে পরিচিত, যা তামিলনাড়ুর সবচেয়ে বড় পর্যটন ও ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোর একটি।প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থী ও ভক্ত এখানে আসেন, বিশেষত মহা শিবরাত্রি ও নটরাজ উত্সবের সময়।

কিভাবে পৌঁছাবেন বৃহদীশ্বর মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর তিরুচিরাপল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Trichy Airport), যা মন্দির থেকে প্রায় ৬০ কিমি দূরে। সেখান থেকে ক্যাব বা বাসে তাঞ্জাভুর পৌঁছানো যায়।
  • রেলপথ: তাঞ্জাভুর রেলওয়ে স্টেশন মন্দির থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে অবস্থিত। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে এখানে ট্রেন পরিষেবা রয়েছে।
  • সড়কপথ: তাঞ্জাভুর শহর তামিলনাড়ুর অন্যান্য বড় শহর যেমন চেন্নাই, মাদুরাই ও তিরুচিরাপল্লির সঙ্গে ভালোভাবে সংযুক্ত। সরকারি ও বেসরকারি বাস, ট্যাক্সি বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে সহজেই মন্দিরে পৌঁছানো যায়।

কোনার্ক সূর্য মন্দির, ওড়িশা: স্থাপত্য ও ইতিহাসের এক মহাবিস্ময়

ভারতের অন্যতম চিত্তাকর্ষক ও রহস্যময় মন্দিরগুলোর মধ্যে কোনার্ক সূর্য মন্দির এক অনন্য নিদর্শন। এটি ওড়িশার পুরী জেলার কোনার্ক শহরে অবস্থিত এবং ১৩শ শতাব্দীতে রাজা নরসিংহদেব I নির্মাণ করেন। সূর্যদেবকে উৎসর্গকৃত এই মন্দিরটি ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর একটি এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত।

এটি কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং প্রাচীন ভারতের অসাধারণ কারিগরি ও জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানকে প্রতিফলিত করে। মন্দিরটির গঠনশৈলী এমনভাবে পরিকল্পিত হয়েছে যাতে সূর্যের আলো এক বিশেষ পদ্ধতিতে মন্দিরের বিভিন্ন অংশে প্রতিফলিত হয়।

This sun temple in Odisha tells you what time it is | Condé Nast Traveller India


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

 রথাকৃতি নকশা: সূর্যদেবের মহান যান

  • কোনার্ক সূর্য মন্দিরটি এক বিশাল রথের আকারে নির্মিত, যা সূর্যদেবের রথকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করে।
  • মন্দিরের ভিত্তির উপর ২৪টি বিশাল চাকা রয়েছে, প্রতিটি চাকার ব্যাস ৩ মিটার (প্রায় ৯.৮ ফুট)
  • এই চাকার খোদাইগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এগুলো সূর্যের সময় গণনার জন্য সূক্ষ্মভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা মন্দিরের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গুরুত্বকে বোঝায়।

 সূক্ষ্ম খোদাই ও মূর্তির কারুকার্য

  • মন্দিরের গায়ে অসংখ্য সূক্ষ্ম খোদাই করা ভাস্কর্য রয়েছে, যা দেবদেবী, অপ্সরা, নর্তকী, রাজা-রানির জীবনচিত্র, পশুপাখি এবং পৌরাণিক যুদ্ধের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে।
  • এখানকার ভাস্কর্যগুলি সূক্ষ্মতা ও বাস্তবতার এক বিস্ময়কর নিদর্শন, যা প্রাচীন ওড়িশার কারুশিল্পের উৎকর্ষতার পরিচয় দেয়।

 স্তম্ভ ও কাঠামোর বৈচিত্র্য

  • মন্দিরের প্রবেশপথে একটি বিশাল নটমন্দির (নৃত্য মণ্ডপ) ছিল, যেখানে সূর্যদেবের উপাসনার সময় নৃত্য পরিবেশিত হতো।
  • মন্দিরের প্রধান গর্ভগৃহ, যা একসময় ৭০ মিটার উঁচু ছিল, বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্নাবশেষ এখনও স্থাপত্যশৈলীর বিস্ময় প্রকাশ করে।
  • মন্দিরের শীর্ষভাগে এক বিশাল সিংহ মূর্তি ছিল, যা হাতির উপর দাঁড়িয়ে, হাতিটি আবার এক মানুষের উপরে রয়েছে—এটি ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক।

 নির্মাণ উপকরণ ও প্রযুক্তি

  • মন্দিরটি প্রধানত খাঁটি চুনাপাথর ও বেলেপাথর দিয়ে নির্মিত, যা স্থানীয় খনি থেকে আনা হয়েছিল।
  • এক কৌশলগত চুম্বক পাথর এই মন্দিরের গঠনকে স্থিতিশীল রাখত বলে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
  • মন্দিরের কাঠামো এমনভাবে নির্মিত হয়েছিল যাতে এটি সূর্যের গতিপথ অনুসারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকিত হয়।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

 রাজা নরসিংহদেব I এবং মন্দির নির্মাণ

  • গঙ্গা রাজবংশের রাজা নরসিংহদেব I ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই মন্দির নির্মাণ করেন।
  • তিনি এই মন্দিরকে তার সাম্রাজ্যের শক্তির প্রতীক হিসেবে তৈরি করেন, যা সূর্যদেবের কৃপায় তার সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে তুলে ধরে।

 মুসলিম আক্রমণ ও মন্দিরের ক্ষতি

  • ১৬শ শতাব্দীতে দিল্লি সালতানাতের সেনারা এই মন্দির আক্রমণ করে এবং এর অনেক অংশ ধ্বংস করে দেয়।
  • মূল গর্ভগৃহটি ধ্বংস হয়ে গেলেও মন্দিরের রথাকৃতি নকশা ও স্থাপত্য এখনও অক্ষত রয়েছে।

 ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকদের পুনরাবিষ্কার

  • ১৮০০ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকরা মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান এবং এটিকে সংরক্ষণ করা শুরু করেন।
  • বর্তমানে এটি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ঐতিহাসিক ও পর্যটন কেন্দ্র।

কিভাবে পৌঁছাবেন কোনার্ক সূর্য মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর, যা কোনার্ক থেকে প্রায় ৬৫ কিমি দূরে অবস্থিত। সেখান থেকে বাস বা ক্যাব নিয়ে মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
  • রেলপথ: নিকটতম রেলস্টেশন পুরী রেলওয়ে স্টেশন, যা ৩৫ কিমি দূরে অবস্থিত এবং সেখান থেকে ট্যাক্সি বা বাসে যাওয়া যায়।
  • সড়কপথ: কোনার্ক ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত। পুরী ও ভুবনেশ্বর থেকে সরকারি ও বেসরকারি বাস, ট্যাক্সি সহজেই পাওয়া যায়।

হাম্পি মন্দির, কর্নাটক: ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক বিস্ময়

হাম্পি ভারতের অন্যতম বিস্ময়কর ঐতিহ্যবাহী শহর, যা কর্নাটকের বেল্লারি জেলায় অবস্থিত। এক সময়ের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হাম্পি এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত। এই শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন মন্দির, স্তম্ভ, পাথরের খোদাই, এবং বিশাল বিশাল স্থাপত্য নিদর্শন আজও তার গৌরবময় অতীতের সাক্ষ্য বহন করে।

হাম্পির সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির বিরূপাক্ষ মন্দির, যা এখনো কার্যকরী একটি তীর্থস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ভিট্টাল মন্দির, লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, হজারা রাম মন্দির, ও বাদবিলিঙ্গ মন্দির এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

A journey through the sacred sites of Hampi


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

 দ্রাবিড় স্থাপত্যশৈলী ও বিস্ময়কর খোদাই

  • হাম্পির মন্দিরগুলির নির্মাণশৈলীতে দ্রাবিড় স্থাপত্য এবং রাজকীয় কারুকার্যের অপূর্ব সমন্বয় রয়েছে।
  • মন্দিরগুলির বেশিরভাগের গঠন বেলেপাথর ও গ্রানাইট দিয়ে তৈরি, যা শত শত বছর পরেও টিকে আছে।
  • স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে বিশাল গোপুরাম, মণ্ডপ (অঙ্গন), গর্ভগৃহ, এবং নৃত্যশালা উল্লেখযোগ্য।
  • পাথরের স্তম্ভগুলিতে খোদাই করা আছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি, দেবদেবীর চিত্র, পশুপাখি, এবং নৃত্যরত অপ্সরাদের মূর্তি।

 বিরূপাক্ষ মন্দির: হাম্পির প্রাণকেন্দ্র

  • বিরূপাক্ষ মন্দির হাম্পির প্রাচীনতম ও সবচেয়ে কার্যকরী মন্দির, যা শিবকে উৎসর্গ করে নির্মিত।
  • মন্দিরটির প্রধান গোপুরাম প্রায় ৫০ মিটার উঁচু এবং এর উপরে সূক্ষ্ম খোদাই করা দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে।
  • মন্দির চত্বরে স্তম্ভযুক্ত মণ্ডপ এবং নন্দী মূর্তি রয়েছে, যা বিজয়নগর স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন।
  • গর্ভগৃহে থাকা শিবলিঙ্গের ওপর ছাদের একটি ছোট ছিদ্র দিয়ে সূর্যের আলো সরাসরি প্রবেশ করে, যা স্থাপত্যের অসাধারণ দৃষ্টান্ত।

 ভিট্টাল মন্দির ও রহস্যময় সংগীত স্তম্ভ

  • ভিট্টাল মন্দির হাম্পির অন্যতম বিস্ময়কর মন্দির, যা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে নির্মিত।
  • এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো “সঙ্গীত স্তম্ভ”, যা বিশেষভাবে এমনভাবে খোদাই করা হয়েছে যে, স্তম্ভগুলিতে আঙুল দিয়ে আঘাত করলে বিভিন্ন স্বরের কম্পন সৃষ্টি হয়।
  • মন্দিরের সামনে রয়েছে হাম্পির প্রতীকী স্থাপত্য “রথমন্দির”, যা একটি বিশাল পাথরের রথের মতো নির্মিত।

 হজারা রাম মন্দির: রাজাদের ব্যক্তিগত উপাসনাগৃহ

  • এই মন্দিরে রামায়ণের সম্পূর্ণ কাহিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা রয়েছে, যা স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন।
  • এটি ছিল বিজয়নগর রাজাদের ব্যক্তিগত উপাসনাস্থল, যেখানে শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যরা পূজা করতে পারতেন।

 বাদবিলিঙ্গ ও নারাসিমহা মূর্তি

  • এখানে প্রায় ৩ মিটার উঁচু এক বিশাল শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা সবসময় জলপূর্ণ থাকে।
  • এক বিশাল নারাসিমহা মূর্তিও রয়েছে, যা বিশাল গ্রানাইট পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

 বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গৌরব

  • ১৪শ শতাব্দীতে হরিহর ও বুক্কা রায়া এই শহরের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী করেন।
  • এটি ছিল ভারতের অন্যতম ধনী সাম্রাজ্য, যেখানে শিল্প, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল।
  • এখানে অনেক বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল, যেখানে সোনা, হীরা এবং মণিমাণিক্যের ব্যবসা হতো।

 ১৫৬৫ সালের তলিকোট যুদ্ধ ও পতন

  • ১৫৬৫ সালে তলিকোটের যুদ্ধে বিজয়নগর সাম্রাজ্য পাঁচটি মুসলিম শাসিত রাজ্যের হাতে পরাজিত হয়
  • শত্রুরা পুরো শহর ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে একসময়ের সমৃদ্ধ হাম্পি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
  • এরপর ধীরে ধীরে এটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয় এবং দীর্ঘদিন অজানার আড়ালে ছিল।

 ব্রিটিশ ও প্রত্নতাত্ত্বিক পুনরাবিষ্কার

  • ১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা হাম্পির ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পান এবং পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন।
  • বর্তমানে এটি ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে পরিচিত।

কিভাবে পৌঁছাবেন হাম্পি মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর হুবলি বিমানবন্দর, যা হাম্পি থেকে প্রায় ১৬০ কিমি দূরে অবস্থিত। এখান থেকে ক্যাব বা বাসে হাম্পি পৌঁছানো যায়।
  • রেলপথ: নিকটতম রেলস্টেশন হোসপেট রেলওয়ে স্টেশন, যা হাম্পি থেকে মাত্র ১৩ কিমি দূরে। হোসপেট থেকে স্থানীয় বাস ও ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

সড়কপথ: হাম্পি কর্নাটকের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত। হোসপেট থেকে নিয়মিত বাস ও ট্যাক্সি পরিষেবা রয়েছে।

রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার, পশ্চিমবঙ্গ: স্থাপত্য ও ইতিহাসের সাক্ষ্য

রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার, যা ভারত ও বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কর্নসুবর্ণে অবস্থিত। এই মহাবিহারকে অনেকেই কর্ণসুবর্ণ বৌদ্ধ বিহার নামেও চেনেন। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ যখন ভারতে আসেন, তখন তিনি এই মহাবিহার পরিদর্শন করেন এবং এর জৌলুস সম্পর্কে তার লেখায় উল্লেখ করেন।

এই বিহারটি পাণ্ডুরঙ্গী রঙের মাটির তৈরি হওয়ায় এর নামকরণ হয় “রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার”, যার অর্থ হলো লাল মাটির বিহার। এটি শুধুমাত্র একটি উপাসনাস্থল ছিল না, বরং প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত ছিল।

BONG ORIGINS – On the Trails of Vanga's Past

স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার একটি সুগঠিত বৌদ্ধ মঠ ছিল, যা মূলত গুপ্ত ও পাল যুগের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হয়েছিল। এর স্থাপত্যশৈলী ভারতের অন্যান্য বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার যেমন নালন্দা ও বিক্রমশিলার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

 চারকোণা পরিকল্পনায় নির্মিত বিশাল বিহার

  • বিহারটির মূল কাঠামো ছিল চারদিক ঘেরা একটি বিশাল আঙিনার মধ্যভাগে অবস্থিত
  • এটি একটি চতুষ্কোণ নির্মাণশৈলীর বিহার, যার চারদিকে অসংখ্য কক্ষ ছিল। এই কক্ষগুলো মূলত ভিক্ষুদের বসবাস ও শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো।
  • কেন্দ্রস্থলে ছিল প্রধান স্তূপ, যা প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

 ইটের ব্যবহারে স্থাপত্যশৈলী

  • মহাবিহারটি নির্মাণের প্রধান উপাদান ছিল লালচে পোড়ামাটির ইট, যা তাকে অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছিল।
  • স্থাপনার প্রতিটি ইটের গায়ে সূক্ষ্ম খোদাই করা নকশা ছিল, যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন প্রতীক যেমন ধর্মচক্র, পদ্মফুল ও বিভিন্ন মুদ্রার চিত্র পাওয়া যায়।
  • স্থাপনার বিভিন্ন অংশে স্তম্ভ ও প্রবেশপথের খিলানগুলোতে অলঙ্করণ হিসেবে ফুল, লতা-পাতা এবং ধর্মীয় চিত্র খোদাই করা হয়েছে।

 বুদ্ধ মূর্তি ও ধর্মচক্রের নিদর্শন

  • বিহারের ভেতরে একাধিক বুদ্ধ মূর্তি ছিল, যেগুলো পাল রাজাদের সময় নির্মিত বলে ধারণা করা হয়।
  • মন্দির প্রাঙ্গনে ধর্মচক্র খোদাই করা একটি বড় স্তম্ভ পাওয়া গেছে, যা বৌদ্ধ ধর্মের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
  • এখানে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে মৃৎপাত্র, তাম্রশাসন, ও খোদাইকৃত ফলক রয়েছে, যা বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের প্রমাণ দেয়।

 জলসংরক্ষণ ব্যবস্থা ও নিকাশী ব্যবস্থা

  • এই বিহারে সুপরিকল্পিত নিকাশী ব্যবস্থা ছিল, যা বৃষ্টির জল নিষ্কাশন ও সংরক্ষণ করতে ব্যবহৃত হতো।
  • একটি ছোট পুকুর ও কুয়ো ছিল, যা ভিক্ষুদের জলসংস্থান নিশ্চিত করত।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

 গুপ্ত ও পাল যুগে বিকাশ

  • রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার মূলত গুপ্ত যুগের শেষ থেকে পাল রাজাদের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
  • পাল রাজারা যখন বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তখন এই বিহারে নানা শিক্ষা ও গবেষণা চলত এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মনেস্টিক ইউনিভার্সিটি ছিল।

 হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় মহাবিহার

  • সপ্তম শতাব্দীতে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এই বিহার পরিদর্শন করেন এবং তার লেখায় উল্লেখ করেন যে এটি ছিল একটি সমৃদ্ধ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র
  • তিনি লিখেছেন যে এখানে একসময় কয়েকশো ভিক্ষু বাস করতেন এবং তারা ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন ও অনুশীলন করতেন।

 রাজা শশাঙ্কের শাসন ও পতন

  • এই বিহার যখন গৌরবের শিখরে, তখন রাজা শশাঙ্কের শাসনকাল চলছিল। তিনি ছিলেন হিন্দু শাসক এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনাগ্রহী ছিলেন বলে জানা যায়।
  • রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর পাল রাজারা ক্ষমতায় এলে এই বিহার নতুন করে পুনর্গঠিত হয় এবং আরো প্রসার লাভ করে।

 মুসলিম আক্রমণ ও ধ্বংস

  • ১২শ শতাব্দীতে মুসলিম আক্রমণের ফলে এই বিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে এটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
  • পরবর্তীতে এটি কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এবং ব্রিটিশ শাসনামলে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এটি পুনরাবিষ্কার করেন।

কিভাবে পৌঁছাবেন রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারে

    • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা কর্নসুবর্ণ থেকে প্রায় ২০০ কিমি দূরে। কলকাতা থেকে ট্রেন বা গাড়ি নিয়ে এখানে আসা যায়।
    • রেলপথ: নিকটতম রেলস্টেশন বহরমপুর কোর্ট রেলস্টেশন, যা কর্নসুবর্ণ থেকে মাত্র ১০ কিমি দূরে অবস্থিত। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি বা অটো নিয়ে সহজেই বিহারে পৌঁছানো যায়।
    • সড়কপথ: বহরমপুর ও কর্নসুবর্ণের মধ্যে ভালো সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। কলকাতা থেকে NH34 জাতীয় সড়ক ধরে সরাসরি গাড়ি বা বাসে আসা যায়।

মীনাক্ষী মন্দির, তামিলনাড়ু: স্থাপত্য ও ইতিহাসের অপূর্ব মিশ্রণ

মীনাক্ষী মন্দির ভারতের অন্যতম বিস্ময়কর মন্দির, যা তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এই মন্দির শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থান নয়, এটি ভারতীয় স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, মীনাক্ষী দেবী (পার্বতীর এক রূপ) এবং সুন্দরেশ্বর (শিব) এই মন্দিরে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই এটি শুধু শিব উপাসনার কেন্দ্র নয়, বরং পার্বতী দেবীর পূজার জন্যও বিখ্যাত।

মীনাক্ষী মন্দিরের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো হলেও, বর্তমানে যে বিশাল মন্দিরটি দেখা যায়, তা মূলত নায়ক রাজবংশের শাসনামলে (১৬শ শতক) নির্মিত। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর নায়ক রাজারা এই মন্দিরের পুরাতন কাঠামোর পুনর্গঠন করেন এবং একে নতুন আকার দেন।

तमिलनाडु के मदुरई में है मीनाक्षी मंदिर, जहां सुन्दरेश्वर रूप में पूजे जाते हैं शिव और मीनाक्षी रूप में मां पार्वती


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

মীনাক্ষী মন্দির ভারতের দ্রাবিড় স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মন্দিরের প্রবেশপথ থেকে গর্ভগৃহ পর্যন্ত প্রতিটি স্থাপত্যকর্মে অপূর্ব সূক্ষ্ম খোদাই, বিশাল স্তম্ভ এবং জটিল নকশার ছোঁয়া রয়েছে।

গোপুরাম বা প্রধান মিনার

মীনাক্ষী মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ১৪টি বিশাল গোপুরাম বা প্রবেশদ্বার, যার মধ্যে দক্ষিণ গোপুরাম সবচেয়ে উঁচু (প্রায় ৫২ মিটার)। প্রতিটি গোপুরামে হাজার হাজার রঙিন মূর্তি খোদাই করা আছে, যা মূলত হিন্দু দেবদেবী, পৌরাণিক কাহিনি, ও দেবদূতদের চিত্র তুলে ধরে।

প্রত্যেকটি গোপুরামের গায়ে এত সূক্ষ্ম কাজ করা হয়েছে যে, প্রতিটি মূর্তি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে এই মন্দিরের মূল গোপুরাম সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং প্রতি দশ-বারো বছর অন্তর এর রং ও খোদাই নতুন করে সংস্কার করা হয়।

হাজার স্তম্ভের হল (Ayiram Kaal Mandapam)

মন্দিরের ভেতরে সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ হলো হাজার স্তম্ভের হল, যেখানে মোট ৯৮৫টি বিশাল স্তম্ভ রয়েছে। প্রতিটি স্তম্ভে ভিন্ন ভিন্ন নকশা ও দেবদেবীর চিত্র খোদাই করা আছে। এই স্তম্ভগুলোর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য হলো, কিছু স্তম্ভ থেকে বাদ্যযন্ত্রের মতো ধ্বনি বের হয়, যখন এগুলোতে আঘাত করা হয়।

এই হলটি একসময় তামিল রাজাদের সভাস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং বর্তমানে এটি মন্দিরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

গোল্ডেন লোটাস ট্যাঙ্ক (Porthamarai Kulam)

মন্দির চত্বরে একটি সুন্দর জলাধার রয়েছে, যাকে গোল্ডেন লোটাস ট্যাঙ্ক বলা হয়। হিন্দু ধর্মীয় কাহিনিতে উল্লেখ আছে, এই পুকুরের জল পবিত্র এবং এটি মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য। এই পুকুরকে ঘিরে রয়েছে একটি খোলা অঙ্গন, যেখানে একসময় শিক্ষার্থীরা ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন।

গর্ভগৃহ ও দেবদেবীর মূর্তি

মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে মীনাক্ষী দেবী ও সুন্দরেশ্বর (শিব) এর মূর্তি স্থাপন করা আছে। মীনাক্ষী দেবীর মূর্তি সাধারণত সবুজ রঙের পাথরে তৈরি, যা বিশেষ ধরনের পান্না খোদাই করে নির্মিত। শিবের মূর্তি এখানকার অন্যতম আকর্ষণ, কারণ এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পাথরের খোদাই করা এবং কোনো প্রকার জোড়া ছাড়াই নির্মিত।

নাট্যশালা ও অন্যান্য মণ্ডপ

মন্দিরের ভেতরে বেশ কয়েকটি নাট্যশালা এবং মণ্ডপ রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় নাটক পরিবেশিত হতো। এই নাট্যশালাগুলির স্তম্ভ ও ছাদে অসাধারণ কারুকাজ লক্ষ্য করা যায়, যা ভারতের অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় অনন্য।


ঐতিহাসিক গুরুত্ব

প্রাচীন যুগ ও চোল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা

মীনাক্ষী মন্দিরের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় সাঙ্গম যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ২০০-৩০০ খ্রিস্টাব্দ) সাহিত্যিক গ্রন্থে। প্রাচীন চোল রাজারা এই মন্দিরের প্রথম দিককার কাঠামো নির্মাণ করেন এবং ধীরে ধীরে এটি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাসনাকেন্দ্র হয়ে ওঠে।

নায়ক রাজাদের পুনর্গঠন ও বিস্তার

১৬শ শতাব্দীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর তিরুমালাই নায়ক এই মন্দিরকে নতুনভাবে সংস্কার করেন এবং বর্তমান মন্দিরের আকার দেন। বিশেষত, মন্দিরের বিশাল স্তম্ভযুক্ত হল এবং অসংখ্য খোদাই করা প্রতিমা এই সময়েই নির্মিত হয়।

ব্রিটিশ শাসনকাল ও সংরক্ষণ

ব্রিটিশ আমলে মন্দিরটি দীর্ঘদিন অবহেলিত অবস্থায় ছিল, তবে পরবর্তীকালে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থা একে পুনরুদ্ধার করে এবং বর্তমানে এটি ভারতের অন্যতম বিশ্ববিখ্যাত ধর্মীয় ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।


কিভাবে পৌঁছাবেন মীনাক্ষী মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর মাদুরাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা মন্দির থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে অবস্থিত। বিমানবন্দর থেকে ক্যাব বা বাস নিয়ে সহজেই মন্দিরে যাওয়া যায়।
  • রেলপথ: নিকটতম রেলস্টেশন মাদুরাই জংশন, যা ভারতের বিভিন্ন বড় শহরের সঙ্গে সংযুক্ত। স্টেশন থেকে অটো বা ট্যাক্সি নিয়ে মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
  • সড়কপথ: মাদুরাই ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে ভালোভাবে সংযুক্ত এবং চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, ত্রিচি থেকে সরাসরি বাস ও ট্যাক্সি পরিষেবা পাওয়া যায়।

জোড়বাংলা মন্দির, পশ্চিমবঙ্গ: স্থাপত্য ও ইতিহাসের নিখুঁত সংমিশ্রণ

জোড়বাংলা মন্দির ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন, যা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে অবস্থিত। মন্দিরটি ১৭শ শতকে মল্ল রাজাদের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি মূলত বাংলার ঐতিহ্যবাহী মন্দির স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। বিষ্ণুপুর ছিল মল্ল রাজাদের রাজধানী এবং এখানে একাধিক টেরাকোটা মন্দির নির্মিত হয়, যার মধ্যে জোড়বাংলা মন্দির অন্যতম।

মন্দিরটি রাজা রঘুনাথ সিং দ্বিতীয় (১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ) নির্মাণ করেন এবং এটি মূলত শ্রীকৃষ্ণের উপাসনার জন্য ব্যবহৃত হতো। জোড়বাংলা মন্দিরকে অনন্য করে তুলেছে এর বাংলার ঐতিহ্যবাহী দোচালা স্থাপত্যরীতি, যা বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কুঁড়েঘরের অনুকরণে নির্মিত।

Jor Mandir Group of Temples – Bishnupur – Kevin Standage


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

জোড়বাংলা মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ এর গঠনশৈলী। এটি দুইটি দোচালা কক্ষের সংমিশ্রণে তৈরি, যা একসঙ্গে যুক্ত হয়ে এক বৃহৎ কাঠামোর সৃষ্টি করেছে। এই ধরনের স্থাপত্যশৈলী বাংলার স্থানীয় ঘরবাড়ি থেকে অনুপ্রাণিত, যেখানে বাঁশ ও মাটির ছাউনিযুক্ত দোচালা ঘর দেখা যায়। তবে, জোড়বাংলা মন্দির সম্পূর্ণ পোড়ামাটির ইট দিয়ে নির্মিত, যা স্থায়িত্ব ও শৈল্পিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।

মন্দিরের মূল কাঠামো

  • এটি দুটি দোচালা ঘরের সমন্বয়ে নির্মিত—একটি সামনে, অন্যটি পেছনে, এবং এই দুইটি অংশ একটি যুক্ত প্ল্যাটফর্মের ওপরে অবস্থিত।
  • সামনের দোচালা অংশটি প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটি অপেক্ষাকৃত ছোট।
  • পেছনের অংশে মূল গর্ভগৃহ অবস্থিত, যেখানে মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা স্থাপিত ছিলেন।

টেরাকোটা কারুকার্য ও খোদাইকৃত প্যানেল

  • মন্দিরের দেয়ালজুড়ে অসাধারণ টেরাকোটা নকশা খোদাই করা আছে, যা বিষ্ণুপুরের অন্যান্য মন্দিরের মতোই চমৎকার।
  • এই টেরাকোটা ফলকে মহাভারত, রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
  • বিশেষত, কৃষ্ণের রাসলীলা, রথযাত্রা, পশুপালন ও যুদ্ধের দৃশ্য নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
  • মন্দিরের স্তম্ভ ও প্রবেশদ্বারে জটিল কারুকাজ রয়েছে, যা সেসময়ের মৃৎশিল্প ও স্থাপত্যরীতির উৎকর্ষতা প্রকাশ করে।

গোলাকার ভিত্তি ও ছাদের স্থাপত্য

  • সাধারণত বাংলা ঘরবাড়ির ছাদ বাঁশ বা খড়ের হয়, কিন্তু এখানে ছাদ সম্পূর্ণ ইটের তৈরি।
  • ছাদটি গোলাকৃতির এবং কিছুটা উঁচু হয়ে রয়েছে, যা ঐতিহ্যবাহী দোচালা ঘরের আকৃতির সঙ্গে মিল রেখে নির্মিত।
  • মন্দিরের ভিত্তি প্রশস্ত ও উঁচু, যা একে আরো দৃঢ়তা প্রদান করেছে এবং বর্ষার সময় জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করত।

নিকাশী ব্যবস্থা ও প্ল্যাটফর্ম

  • মন্দিরটি উঁচু ভিত্তির ওপর নির্মিত হওয়ায় এতে জল জমে না এবং এটি সময়ের সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি।
  • মন্দিরের চারপাশে নিকাশী ব্যবস্থা ছিল, যা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে সাহায্য করত।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

জোড়বাংলা মন্দির শুধু স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত নয়, এটি মল্ল রাজাদের শাসনকাল ও বাংলার মন্দির নির্মাণ ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন

মল্ল রাজাদের অবদান

  • ১৬শ ও ১৭শ শতকে মল্ল রাজারা বিষ্ণুপুরে একাধিক টেরাকোটা মন্দির নির্মাণ করেন, যার মধ্যে জোড়বাংলা মন্দির অন্যতম
  • বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং তারা মন্দির স্থাপত্যে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দেন।
  • এই মন্দিরের স্থাপত্যরীতি পরবর্তী সময় বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত হয় এবং নবদ্বীপ, নদীয়া, কৃষ্ণনগরসহ বিভিন্ন স্থানে এর প্রভাব দেখা যায়।

ব্রিটিশ শাসনকাল ও সংরক্ষণ

  • ব্রিটিশ আমলে মন্দিরটি দীর্ঘ সময় অবহেলিত ছিল, কিন্তু ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়।
  • বর্তমানে এটি ভারতের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত এবং পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।

বাংলার স্থাপত্যশিল্পের ঐতিহ্য

  • মন্দিরের টেরাকোটা কারুকার্য বাংলার প্রাচীন মৃৎশিল্পের উৎকর্ষতা প্রকাশ করে।
  • এটি স্থানীয় কারিগরদের দক্ষতার পরিচয় বহন করে এবং বাংলার মন্দির স্থাপত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে।

কিভাবে পৌঁছাবেন জোড়বাংলা মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা বিষ্ণুপুর থেকে প্রায় ২০০ কিমি দূরে। বিমানবন্দর থেকে ট্রেন বা গাড়ি নিয়ে বিষ্ণুপুর যাওয়া যায়।
  • রেলপথ: বিষ্ণুপুর রেলস্টেশন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বড় শহরের সঙ্গে সংযুক্ত। কলকাতা, আসানসোল, খড়গপুর ও দুর্গাপুর থেকে সরাসরি ট্রেন পাওয়া যায়।
  • সড়কপথ: কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিমি। NH16 ও NH314 জাতীয় সড়ক ধরে বাস বা গাড়িতে সহজেই বিষ্ণুপুর পৌঁছানো যায়।

লালজি মন্দির, পশ্চিমবঙ্গ: স্থাপত্য ও ইতিহাসের অপূর্ব সংমিশ্রণ

পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহর তার টেরাকোটা মন্দিরগুলোর জন্য বিশ্ববিখ্যাত। বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা ১৬শ ও ১৭শ শতকে যে সমস্ত অপূর্ব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, তার মধ্যে লালজি মন্দির অন্যতম। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা বির সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন এবং এটি মূলত রাধাকৃষ্ণের উপাসনালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মল্ল রাজারা বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী ছিলেন, তাই বিষ্ণুপুরের অধিকাংশ মন্দিরই কৃষ্ণ ও রাধার প্রতি নিবেদিত।

লালজি মন্দির শুধু ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি বাংলার প্রাচীন স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরটি ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও, এর টেরাকোটা খোদাই আজও বাংলার শিল্প ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

File:Lalji Temple at BIshnupur town in Bankura District of West Bengal.jpg - Wikimedia Commons


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

লালজি মন্দির বিষ্ণুপুরের অন্যান্য মন্দিরের মতোই একচালা রীতির নবরত্ন মন্দির। এই ধরনের স্থাপত্যশৈলী বাংলার মন্দিরগুলোর মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং এতে দেখা যায় মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব। মন্দিরটি পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি, যা একে দীর্ঘস্থায়ী করে তুলেছে।

নবরত্ন স্থাপত্যশৈলী

  • মন্দিরের প্রধান কাঠামোর উপরে নয়টি ছোট ছোট চূড়া বা রত্ন রয়েছে, যা একে “নবরত্ন মন্দির” নামে পরিচিত করেছে।
  • প্রতিটি রত্ন আলাদা উচ্চতায় স্থাপিত, যা এক অনন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নকশা তৈরি করেছে।
  • এই শৈলী মুঘল স্থাপত্যের সঙ্গে বাংলার নিজস্ব নির্মাণশৈলীর মিশ্রণ ঘটিয়ে এক বিশেষ রূপ তৈরি করেছে।

টেরাকোটা কারুকার্য

  • লালজি মন্দিরের টেরাকোটা ফলকগুলিতে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্য খোদাই করা রয়েছে।
  • বিশেষ করে কৃষ্ণলীলা, গোপীদের নৃত্য, যুদ্ধের দৃশ্য ও রাজকীয় সভা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
  • মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে কৃষ্ণের শৈশবলীলা, রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাথা এবং বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের গল্প চিত্রিত হয়েছে।
  • মন্দিরের প্রবেশদ্বারের স্তম্ভ ও দেওয়ালে দেখা যায় সূক্ষ্ম খোদাই করা পদ্মফুল, লতা-পাতা এবং ঐতিহ্যবাহী মোটিফ।

ভিত্তি ও কাঠামো

  • মন্দিরটি একটি উঁচু ভিত্তির ওপর নির্মিত, যাতে বন্যার জল প্রবেশ করতে না পারে।
  • ভিত্তি প্রশস্ত এবং চারপাশে বাঁধানো পাথর ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্থাপত্যগতভাবে একে মজবুত করেছে।
  • অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহটি তুলনামূলক ছোট এবং এখানে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছে।

অঙ্গন ও পার্শ্ববর্তী মন্দির

  • লালজি মন্দিরের সামনের অংশে একটি খোলা অঙ্গন রয়েছে, যা মূলত পূজা ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো।
  • কাছেই রয়েছে আরো কয়েকটি ছোট মন্দির, যা একসঙ্গে একটি ধর্মীয় কমপ্লেক্স গঠন করেছে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা

  • বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা শক্তিশালী হিন্দু রাজবংশ ছিলেন এবং তারা বাংলার মন্দির স্থাপত্যকে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।
  • রাজা বির সিংহের সময়কালে বিষ্ণুপুরের স্থাপত্যকলায় বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়, এবং এই মন্দির তারই অন্যতম প্রতিফলন।

টেরাকোটা শিল্পের বিকাশ

  • লালজি মন্দিরের টেরাকোটা কাজ বিষ্ণুপুরের স্বর্ণযুগের শিল্পচর্চার পরিচায়ক।
  • টেরাকোটা শিল্পের মাধ্যমে বাংলার লোকজ সংস্কৃতি, পৌরাণিক কাহিনি এবং সামাজিক জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
  • এই মন্দিরের টেরাকোটা ফলকগুলো সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে।

ঐতিহাসিক সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা

  • ব্রিটিশ আমলে এই মন্দির কিছুটা অবহেলিত থাকলেও, ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ একে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়।
  • বর্তমানে এটি ভারতের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত এবং পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।
  • যদিও মন্দিরের কিছু অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, তবে এর মূল কাঠামো আজও স্থিতিশীল রয়েছে।

কিভাবে পৌঁছাবেন লালজি মন্দিরে

  • বিমানপথ: কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিষ্ণুপুরের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিমি। বিমানবন্দর থেকে ট্রেন বা গাড়িতে বিষ্ণুপুর পৌঁছানো যায়।
  • রেলপথ: বিষ্ণুপুর রেলস্টেশন কলকাতা, আসানসোল, দুর্গাপুর ও খড়গপুরের সঙ্গে সংযুক্ত। স্টেশন থেকে রিকশা বা ট্যাক্সিতে সহজেই মন্দিরে যাওয়া যায়।
  • সড়কপথ: কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরের জন্য নিয়মিত বাস পরিষেবা রয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়িতেও NH16 ও NH314 সড়ক ধরে সহজেই পৌঁছানো সম্ভব।

রামেশ্বরম মন্দির, তামিলনাড়ু: স্থাপত্য ও ইতিহাসের মহাসমুদ্র

রামেশ্বরম মন্দির, যা শ্রী রামনাথস্বামী মন্দির নামে পরিচিত, দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য। এটি চারধাম তীর্থযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি মহাপবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ভগবান শ্রী রাম লঙ্কাযাত্রার আগে এখানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পূজা করেছিলেন, যার ফলে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শৈব তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে।

Rameswaram Temple | Ramanathapuram District | Tamil Nadu Tourism


স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব

রামেশ্বরম মন্দিরের স্থাপত্য দ্রাবিড় শৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। এটি বিভিন্ন রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ধাপে ধাপে নির্মিত হয়েছে এবং আজকের আকার পেয়েছে।

বিশ্বের দীর্ঘতম করিডোর

  • মন্দিরের অন্যতম বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্বের দীর্ঘতম করিডোর, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১,২০০ মিটার
  • করিডোরের দুপাশে রয়েছে ১,২১২টি সুচিস্মিত স্তম্ভ, যা স্থাপত্যের সূক্ষ্মতা ও নিখুঁত গাণিতিক পরিকল্পনার সাক্ষর বহন করে।
  • স্তম্ভগুলোর উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট, এবং প্রতিটির পৃষ্ঠে সূক্ষ্ম খোদাই করা নকশা ও দেবমূর্তি রয়েছে।

গোপুরম বা প্রবেশদ্বার

  • মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার, বা রাজা গোপুরম, প্রায় ৫৩ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট, যা দক্ষিণ ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন।
  • প্রবেশদ্বারটি জটিল খোদাই ও রঙিন ভাস্কর্যে সজ্জিত, যেখানে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

গর্ভগৃহ ও শিবলিঙ্গ

  • মন্দিরের প্রধান গর্ভগৃহে রামনাথস্বামী শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত, যা কথিত আছে ভগবান রামের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • মন্দিরের অভ্যন্তরে আরও একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে, যাকে বিশ্বলিঙ্গ বলা হয়। এটি লঙ্কাপতি রাবণ দ্বারা আনা হয়েছিল এবং রামের নির্দেশে এখানে স্থাপন করা হয়।
  • এই দুই শিবলিঙ্গের পূজা আজও নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী করা হয়।

২২টি তীর্থকুণ্ড বা পবিত্র কূপ

  • মন্দিরের প্রাঙ্গণে রয়েছে ২২টি তীর্থকুণ্ড, যেগুলোতে স্নান করলে পাপমোচন হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।
  • এই জলাশয়গুলোর প্রতিটির জল ভিন্ন স্বাদ ও তাপমাত্রার, যা এক স্থাপত্যিক রহস্য।

পাথর খোদাই করা স্তম্ভ ও ছাদশিল্প

  • মন্দিরের করিডোর ও মণ্ডপের ছাদে রয়েছে রামায়ণের বিভিন্ন দৃশ্য খোদাই করা, যা স্থাপত্যের সূক্ষ্মতার চূড়ান্ত নিদর্শন।
  • স্তম্ভগুলোর খোদাই করা মূর্তিগুলোর মধ্যে দেবতা, যোদ্ধা ও পৌরাণিক চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

পৌরাণিক ব্যাখ্যা ও রামায়ণের সম্পর্ক

  • কথিত আছে, রাবণকে পরাজিত করার পর ভগবান রাম এখানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পূজা করেন, যাতে ব্রাহ্মণ হত্যার দোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • রামের সেনাপতি হনুমানকে কাশী থেকে শিবলিঙ্গ আনতে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তিনি সময়মতো ফিরে না আসায় সীতাদেবী বালুকার (বালি) থেকে একটি শিবলিঙ্গ নির্মাণ করেন এবং রাম সেটিকেই পূজা করেন।

রাজবংশ ও নির্মাণকাল

  • মন্দিরের মূল অংশ ১২শ শতাব্দীতে পান্ড্য রাজারা নির্মাণ করেন।
  • পরে নায়ক রাজারা (১৫-১৬শ শতাব্দী) মন্দির সম্প্রসারণ করেন এবং বৃহৎ করিডোর তৈরি করেন।
  • শেঠুপতি রাজবংশের রাজারা (১৭শ শতাব্দী) মন্দিরের গোপুরম নির্মাণ করেন এবং এর বর্তমান আকার দেন।

দক্ষিণ ভারতের ধর্মীয় কেন্দ্র

  • রামেশ্বরম মন্দির শুধু তীর্থস্থানই নয়, এটি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কেন্দ্র
  • এটি চারধামের অন্যতম তীর্থস্থান, যা হিন্দুদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র।

কিভাবে পৌঁছাবেন রামেশ্বরম মন্দিরে

  • বিমানপথ: নিকটতম বিমানবন্দর মাদুরাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা রামেশ্বরম থেকে প্রায় ১৭৫ কিমি দূরে।
  • রেলপথ: রামেশ্বরম রেলওয়ে স্টেশন ভারতের বিভিন্ন বড় শহরের সঙ্গে সংযুক্ত।
  • সড়কপথ: চেন্নাই, মাদুরাই এবং অন্যান্য শহর থেকে সরকারি ও বেসরকারি বাস বা ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

উপসংহার

ভারতের মন্দির স্থাপত্য শুধু প্রার্থনার স্থান নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং স্থাপত্যিক বিস্ময়। প্রতিটি মন্দিরেই লুকিয়ে আছে প্রাচীন স্থপতিদের অনন্য দক্ষতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও পৌরাণিক কাহিনির নিখুঁত উপস্থাপন। ভারতের পুরানো মন্দিরগুলোর অলঙ্কৃত স্তম্ভ, বিশালাকায় গোপুরম, সূক্ষ্ম খোদাই করা ভাস্কর্য এবং একশিলা নির্মাণশৈলী আধুনিক স্থাপত্যবিদদেরও বিস্মিত করে।

এই ১০ টি মন্দির শুধু ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ঐতিহ্যের অংশ। এগুলোর প্রতিটি ইট, খোদাই এবং ভাস্কর্যের গভীরে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। প্রতিটি মন্দির একেকটি পৌরাণিক কাহিনির জীবন্ত নিদর্শন, যা অতীতের সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপন করে।

যদি আপনি ভারতের প্রাচীন স্থাপত্য ও মন্দিরের স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য অনুভব করতে চান, তাহলে এই মন্দিরগুলো অবশ্যই আপনার ভ্রমণ তালিকায় থাকা উচিত। প্রতিটি মন্দিরে রয়েছে এক স্বতন্ত্র সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব, যা আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্যরকম সময়যাত্রায়। তাই, পরবর্তী ভ্রমণে ভারতের এই অসাধারণ মন্দিরগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভুলবেন না!

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুনফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুনএকসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply