“ছাঁভা”—একটি সিনেমা নয়, এটি এক মহাকাব্য! রূপোলি পর্দায় যখন ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে, তখন দর্শক শুধু চোখে নয়, হৃদয় দিয়েও অনুভব করেন সেই মুহূর্তগুলো। “ছাঁভা” এমনই এক দুর্দান্ত সৃষ্টি, যেখানে রক্ত, ঘাম, দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগের মহিমা একসঙ্গে মিশে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক তৈরি করেছে।ছবিটি পরিচালনা করেছেন লক্ষ্মণ উতেকর। প্রযোজনার দায়িত্বে রয়েছে ম্যাডক ফিল্মসের অধীনে দীনেশ বিজন। ছবির সাউন্ডট্র্যাক এবং স্কোর পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী সুরকার এ.আর. রহমান। গানগুলোর কথা লিখেছেন ইরশাদ কামিল।

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-এ মুক্তি পেয়েছে ‘ছাঁভা’। হ্যাঁ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে প্রেমের সিনেমার বদলে দেশপ্রেম আর বীরত্বের গল্প নিয়ে বড় পর্দায় হাজির হয়েছে এই মুভি!

সূচিপত্র

সিনেমার প্লট – রাজকীয় ইতিহাস জীবন্ত

সময় থমকে দাঁড়ায়, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, দূর থেকে ভেসে আসে যুদ্ধের দামামা। ধুলোর ঝড় উঠছে, সূর্যের আলো অস্ত্রের উপর প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করছে এক ঝলমলে বিভ্রম। এমনই এক রাজকীয় দৃশ্যপটের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘ছাঁভা’—একটি ইতিহাস, একটি জীবন, একটি বীরগাথা।

এই সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম যেন একেকটি চিত্রপট, যেখানে সম্ভাজি মহারাজের শৈশব থেকে শুরু করে তার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ, ষড়যন্ত্রের ছক, রাজসভার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, তার অনমনীয় নীতি এবং আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী উপাখ্যান ফুটে উঠেছে। কাহিনি এগিয়ে চলে এক সুনিপুণ বাঁধনে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত দর্শককে বেঁধে রাখে গভীর আবেগের স্রোতে।

শুরুতেই আমরা দেখি, কিশোর সম্ভাজি মহারাজ তার পিতার ছায়ায় বেড়ে উঠছেন—মরাঠা বীরত্বের শিক্ষা নিচ্ছেন, রাজধর্মের কঠোরতা উপলব্ধি করছেন। সময়ের পরিক্রমায়, যখন রাজ্যরক্ষার গুরুদায়িত্ব তার কাঁধে আসে, তখন শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। রাজনৈতিক চক্রান্ত, মুঘলদের আগ্রাসন, ভেতরের বিশ্বাসঘাতকতা—সবকিছু মিলিয়ে সম্ভাজির জীবন হয়ে ওঠে এক চলমান সংগ্রাম।

সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যই এক অদ্ভুত মাধুর্য ও তীব্রতা বহন করে। যুদ্ধের ময়দানে সম্ভাজির দাপট, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘাত, এবং মহারাণী ইউশুবাইয়ের সঙ্গে তার সংলাপগুলো এতটাই তীক্ষ্ণ ও হৃদয়স্পর্শী যে, প্রতিটি শব্দই দর্শকের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে।

তবে কাহিনির আসল শিখর আসে সেই সময়, যখন সম্ভাজিকে শত্রুরা বন্দি করে, এবং তার সামনে উপস্থাপন করা হয় আত্মসমর্পণের প্রলোভন। কিন্তু তিনি যে ছাঁভা—তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর তরবারির সামনে দাঁড়িয়ে যেমন অবিচল ছিলেন, তেমনি মৃত্যুর মুখেও অনড় থাকেন। এখানেই সিনেমা নিজের আসল শক্তি প্রকাশ করে—একজন সত্যিকারের যোদ্ধার মনোবল, সাহস এবং চিরন্তন দেশপ্রেমের চিত্রায়ণ।

‘ছাঁভা’ শুধুমাত্র একটি জীবনীচিত্র নয়, এটি এক মহাকাব্যিক রূপক, যেখানে যুদ্ধ, ত্যাগ এবং আত্মমর্যাদার এক অনন্য সংমিশ্রণ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপ যেন দর্শকের মনে এক চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়—এক রাজপুত্রের অনন্ত যাত্রা, এক মহারাজের অমরত্ব।

Chhaava' movie review: Vicky Kaushal, Akshaye Khanna jostle for attention in this uneven sketch of a Maratha legend - The Hindu

সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা – এক কথায় দুর্দান্ত

রূপোলি পর্দার আলো ম্লান হয়ে যায়, যখন প্রকৃত চরিত্ররা প্রাণ পায় অভিনয়ের নিখুঁত ব্যঞ্জনায়। ‘ছাঁভা’ সিনেমার প্রতিটি অভিনেতা যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন চরিত্রের গভীরে, যেন শতাব্দী প্রাচীন কোনো রাজসভা আজ আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

ভিকি কৌশল, সম্ভাজি মহারাজের চরিত্রে, যেন আত্মার গভীরতম অংশ দিয়ে ধারণ করেছেন এক মহাযোদ্ধার বীরত্ব। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, দৃঢ় ভঙ্গিমা, রাজকীয় গাম্ভীর্য এবং সংলাপ বলার ধরণ প্রতিটি মুহূর্তে সম্ভাজিকে নতুন করে গড়ে তুলেছে। যুদ্ধের ময়দানে যখন তিনি ঘোড়ার পিঠে উঠে তরবারি উঁচিয়ে শত্রুকে চ্যালেঞ্জ জানান, তখন শুধু পর্দার মধ্যেই নয়, দর্শকের হৃদয়েও প্রতিধ্বনিত হয় তার শক্তি।

রশ্মিকা মন্দান্না, মহারাণী ইউশুবাইয়ের ভূমিকায়, এক অনবদ্য সংযম ও সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। তার সংলাপের প্রতিটি শব্দ, চোখের প্রতিটি ভাষা, রাজমহলের আলো-আঁধারির মধ্যে প্রতিটি দৃশ্যেই তিনি সম্ভাজির শক্তির প্রতিফলন হয়ে ওঠেন।

অক্ষয় খান্না, আওরঙ্গজেবের চরিত্রে, যেন নিঃশব্দ অথচ ধ্বংসাত্মক এক শক্তির প্রতিচ্ছবি। তার প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে থাকে এক গভীর ষড়যন্ত্র, প্রতিটি সংলাপে যেন ধ্বনিত হয় সাম্রাজ্য বিস্তারের নিষ্ঠুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা।

আশুতোষ রানা, হাম্বিরাও মোহিতের চরিত্রে, যুদ্ধের ময়দানে এক প্রবীণ যোদ্ধার মতো দৃঢ় ও অবিচল। তার চরিত্রটি শুধু সম্ভাজির অন্যতম শক্তি নয়, বরং এক ইতিহাসের প্রতীক।

প্রতিটি অভিনেতার অভিনয় যেন একেকটি কবিতা, যেখানে প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি অভিব্যক্তি সিনেমার সৌন্দর্যকে আরও একধাপ উঁচুতে নিয়ে যায়। ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে বীরত্বের এক অনবদ্য প্রতিচ্ছবি—যেখানে রক্ত ঝরে, কিন্তু আত্মমর্যাদা কখনও ভঙ্গ হয় না।

দর্শকদের প্রতিক্রিয়া – আবেগের জোয়ার

সিনেমার প্রথম দৃশ্য থেকেই যেন এক সম্মোহনী টান অনুভব করেন দর্শক। রাজসভার সুদৃশ্য অলিন্দ, যুদ্ধের কোলাহল, তরবারির ঝলকানি আর মরুপ্রান্তরের ধুলোর ঝড়—সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আলো নিভতেই পর্দায় যখন সম্ভাজি মহারাজের প্রথম আবির্ভাব ঘটে, পুরো হল নিঃশব্দ হয়ে যায়। যেন শতাব্দীর গণ্ডি পেরিয়ে বীর সম্ভাজি স্বয়ং উঠে এসেছেন রূপোলি পর্দায়।

যুদ্ধের দৃশ্যে তরবারির সংঘর্ষ যখন ধাতব শব্দে মুখরিত হয়, তখন দর্শকের হৃদস্পন্দনও যেন তাল মেলায় সেই প্রবল সংঘর্ষের সঙ্গে। সিংহাসনের জন্য নয়, ক্ষমতার মোহে নয়—স্বাধীনতার জন্য, আত্মমর্যাদার জন্য সম্ভাজির প্রতিটি যুদ্ধ এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে হলভর্তি দর্শকের মনে। হলজুড়ে মুহুর্মুহু করতালি, দেশাত্মবোধে উদ্বেলিত হয়ে অনেকে গলা ছেড়ে সম্ভাজির নামে জয়ধ্বনি দিতেও দ্বিধা করেননি।

কিন্তু এই গল্প শুধুই শক্তিমত্তার নয়, এটি আবেগেরও। সম্ভাজি যখন বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন, যখন তাকে বন্দি করা হয়, যখন তার সামনে আত্মসমর্পণের পথ খোলা রাখা হয়, তখন হলের নিস্তব্ধতা যেন এক অদৃশ্য যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে ওঠে। কেউ কেউ সিটের হাতল শক্ত করে ধরেন, কেউ আবার অজান্তেই চোখের জল মুছে নেন।

সিনেমার শেষ দৃশ্যে সম্ভাজির অপরাজেয় আত্মসম্মানের সামনে শত্রুর নিষ্ঠুরতা যখন হেরে যায়, তখন দর্শকের চোখে জল আর হৃদয়ে এক প্রবল উত্তেজনার স্রোত বইতে থাকে। হল থেকে বেরিয়ে আসার সময় কেউই যেন স্বাভাবিক থাকতে পারেন না—কারও চোখে গর্বের ঝলক, কারও মুখে এক চাপা বিস্ময়। সিনেমা শেষ হলেও আবেগের যে ঢেউ উঠেছিল, তা যেন দীর্ঘ সময় স্থির থেকে যায় দর্শকের হৃদয়ে।

এ এক বিরল মুহূর্ত, যেখানে সিনেমা আর বাস্তবের সীমারেখা মুছে যায়। যেখানে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে সম্ভাজি মহারাজ নতুন করে জায়গা করে নেন জনতার হৃদয়ে।

Director of Vicky Kaushal-starrer Chhaava confirms deleting dance scenes amid row

সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া – প্রশংসার ঝড়

যখন ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে এক মহাকাব্যকে পর্দায় জীবন্ত করে তোলা হয়, তখন সেটি শুধু একটি সিনেমা থাকে না, হয়ে ওঠে এক অনুভূতি। ‘ছাঁভা’ মুক্তির পরই সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া একযোগে প্রমাণ করে দিয়েছে যে এটি কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক অনন্য অধ্যায়।

সিনেমার নির্মাণশৈলী:


সমালোচকরা বিশেষভাবে প্রশংসা করেছেন ছবির নির্মাণশৈলী। লক্ষ্মণ উতেকরের পরিচালনা যেন এক নিখুঁত চিত্রপট এঁকেছে পর্দায়—প্রতিটি দৃশ্য যেন রঙ-তুলির নিখুঁত আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছে সম্ভাজি মহারাজের জীবনের বর্ণময় অধ্যায়। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, আলোর খেলা, ধোঁয়ার আড়ালে যুদ্ধের দৃশ্যায়ন—প্রতিটি শটেই এক রূপকথার মতো সৌন্দর্য। মেঘমন্দ্রিত যুদ্ধক্ষেত্র, সন্ধ্যার সূর্যালোকের নিচে মরুপ্রান্তরের ধুলোবালি, মুঘল প্রাসাদের ছায়াঘেরা কক্ষ—সব মিলিয়ে এক অনন্য দৃষ্টিনন্দন অভিজ্ঞতা।

Chhaava' controversy: Dance scenes from Vicky Kaushal's film will be deleted respecting public sentiments, says director

চিত্রনাট্য ও সংলাপ:

সমালোচকদের মতে, ছবির অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো এর চিত্রনাট্য। ইতিহাসের বাস্তবতাকে অবিকৃত রেখে কাহিনির নাটকীয়তা এমনভাবে বুনন করা হয়েছে যে প্রতিটি মুহূর্তই দর্শকের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। সংলাপগুলো যেন একেকটি দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে—সম্ভাজির বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য একদিকে যেমন উদ্দীপ্ত করে, তেমনি রক্ত গরম করে তোলে।

Chhaava OTT Release Date Update: How Long Before You Can Watch Chava Movie (2025) Online? - Oneindia News

যুদ্ধের দৃশ্য ও আবহসংগীত:

সমালোচকদের অনেকেই তুলনা করেছেন হলিউডের ঐতিহাসিক সিনেমার সঙ্গে। যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে ব্যবহৃত ক্যামেরার কাজ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ছন্দ, আর তলোয়ারের প্রতিটি আঘাতের শব্দ যেন দর্শকদের যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে নিয়ে যায়। এ.আর. রহমানের সংগীত এই সিনেমাকে শুধু হৃদয়স্পর্শীই করেনি, বরং প্রতিটি দৃশ্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে—নিরব মুহূর্তেও তার সুর কথা বলে।

অভিনয়ের প্রশংসা:

সমালোচকদের ভাষায়, ভিকি কৌশলের অভিনয় এই ছবির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তার দেহভঙ্গি, সংলাপের ভঙ্গিমা, চোখের ভাষা—সব মিলিয়ে সম্ভাজির চরিত্রে যেন এক নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। রশ্মিকা মন্দান্নার সংযত কিন্তু দৃঢ় অভিনয়, অক্ষয় খান্নার নির্লিপ্ত অথচ ভয়ঙ্কর আওরঙ্গজেব, আশুতোষ রানার চোয়ালবদ্ধ যোদ্ধার রূপ—সব মিলিয়ে এক অনবদ্য অভিনয়ের সমারোহ ঘটেছে এই সিনেমায়।

Akshaye Khanna unrecognisable as Aurangzeb leaves fans confused in Vicky Kaushal's Chhaava teaser

সমালোচকদের চূড়ান্ত রায়:

বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচকরা ‘ছাঁভা’-কে শুধুমাত্র বছরের অন্যতম সেরা ছবি হিসেবেই নয়, ভারতীয় ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের এক নতুন মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কেউ বলেছেন, “এই সিনেমা একবার নয়, বারবার দেখার মতো,” কেউ আবার মন্তব্য করেছেন, “এই ছবি শুধু একটি মুভি নয়, এটি এক আবেগ, এক ইতিহাস, এক গৌরবের প্রতিচ্ছবি।”শেষমেশ, সমালোচকরাও একবাক্যে স্বীকার করেছেন—‘ছাঁভা’ শুধু এক সিনেমা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, যা যুগ যুগ ধরে দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে।

বক্স অফিস কালেকশন – রেকর্ড ব্রেকিং সাফল্য

সিনেমার মুক্তির প্রথম দিন থেকেই প্রেক্ষাগৃহের বাইরে দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। শহর হোক বা মফস্বল—প্রতিটি হলে ‘ছাঁভা’-র টিকিট যেন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছিল। একদিকে ইতিহাসপ্রেমী দর্শকের আবেগ, অন্যদিকে সম্ভাজি মহারাজের জীবনগাথার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা—সব মিলিয়ে সিনেমাটি মুক্তির প্রথম দিনেই রেকর্ড পরিমাণ দর্শক টানতে সক্ষম হয়।

প্রথম দিনের আয়:

বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, মুক্তির প্রথম দিনেই ছবিটি ₹৩৫-৪০ কোটি টাকার বিশাল আয় করেছে, যা সাম্প্রতিককালে ভারতীয় ঐতিহাসিক সিনেমার মধ্যে অন্যতম সেরা উদ্বোধনী আয়। বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের হলগুলোতে দর্শকের ঢল নেমেছিল।

প্রথম সপ্তাহে অভাবনীয় সাফল্য:

মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই ₹২০০ কোটির বেশি ব্যবসা করে ‘ছাঁভা’, যা বলিউডের সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক ছবিগুলোর তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য রেকর্ড। অনেক সমালোচকের মতে, ছবিটির ব্যতিক্রমী গল্প ও দুর্দান্ত নির্মাণশৈলীর কারণে দর্শকের রেসপন্স প্রথম দিনের পরেও অব্যাহত থাকে।

ভারত এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব:

শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও ‘ছাঁভা’ তুমুল সাড়া ফেলেছে। ইউকে, ইউএসএ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই সিনেমাটি ₹৭০ কোটি-এর বেশি আয় করে। বিশেষ করে ভারতীয় প্রবাসী দর্শকের কাছে ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

মহারাষ্ট্রে দর্শকদের উন্মাদনা:

মহারাষ্ট্রে ছবিটি যেন এক আলাদা আবেগের জন্ম দেয়। বিশেষত পুনে, মুম্বাই, নাসিক, সাতারা, কোলাপুরের মতো শহরগুলোতে প্রতিটি শো ছিল হাউসফুল। অনেক জায়গায় মধ্যরাতেও বিশেষ শো চালাতে হয় দর্শকের চাহিদার কারণে। কিছু স্থানে হল মালিকরা ভোর ৫টায় বিশেষ স্ক্রিনিংয়ের আয়োজন করেন, যা সাধারণত শুধু ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রেই দেখা যায়।

দ্বিতীয় সপ্তাহেও অপ্রতিরোধ্য গতি:

অনেক সময় প্রথম সপ্তাহের পরে বক্স অফিস কালেকশন কমে যায়, কিন্তু ‘ছাঁভা’-র ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটে। দ্বিতীয় সপ্তাহেও ছবিটি ₹৩৫০ কোটি ছাড়িয়ে যায় এবং আরও বেশি দর্শক হলে আসতে শুরু করেন। বিশেষ করে ওয়ার্ড অফ মাউথ-এর কারণে যারা প্রথম দিকে ছবিটি না দেখেছিলেন, তারাও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

মাসব্যাপী রাজত্ব এবং সর্বকালের রেকর্ড:

এক মাসের মধ্যে ‘ছাঁভা’ ভারতের অন্যতম ব্যবসাসফল ঐতিহাসিক সিনেমার তালিকায় স্থান করে নেয়। ছবিটি ₹৫৫০ কোটির বেশি আয় করে, যা অনেক সুপারহিট ঐতিহাসিক ছবির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এর আগে ‘বাজিরাও মস্তানি’, ‘তানাজি’ এবং ‘পদ্মাবত’-এর মতো ছবিগুলোর যা বক্স অফিস পারফরম্যান্স ছিল, তা এই ছবির তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে যায়।

Vicky Kaushal's Chaava miracle! Film shows unprecedented growth, sets stage for a glorious run - Glamsham

কেন দেখবেন ‘ছাঁভা’? এক মহাকাব্যিক অভিজ্ঞতা

সিনেমা শুধুই দৃশ্য আর সংলাপের সমাহার নয়, বরং এক চেতনাশীল শিল্পকর্ম। যেখানে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি দৃশ্যপট, প্রতিটি সুর একে এক অনন্য নাট্যকাব্যে পরিণত করে। ‘ছাঁভা’ সেই বিরল সৃষ্টি, যা শুধু চোখে দেখার জন্য নয়, বরং হৃদয়ে অনুভব করার জন্য নির্মিত। এটি এক যুদ্ধবীরের আত্মশক্তির কাব্য, এক সময়ের নিঃশব্দ সাক্ষ্য। এই সিনেমাকে শুধুমাত্র এক ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র বলে সীমাবদ্ধ করা যায় না, বরং এটি এক রক্ত-মাটির মহাকাব্য, যা যুগের পর যুগ ধরে দর্শকদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হবে।

 চরিত্রায়ণ – আত্মার গভীরে প্রবেশ

এই সিনেমার শক্তিশালী দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হল চরিত্রায়ণ। সম্ভাজি মহারাজ শুধুমাত্র এক রাজপুত্র নন, তিনি এক সংগ্রামী আত্মার প্রতিচ্ছবি। তার চোখে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের রক্তের ছাপ নয়, বরং জাতির সম্মানের আলো জ্বলে ওঠে।

ভিকি কৌশল এই চরিত্রে যেন এক অনবদ্য রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছেন। তার দেহভঙ্গি, সংলাপের গতি, চোখের ভাষা—সব মিলিয়ে তিনি সম্ভাজির চরিত্রে এক দ্রোণাচার্যর শিষ্যের মতো নিখুঁত অভিনয় উপহার দিয়েছেন। যখন তিনি যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেন—

“আমার অস্তিত্ব কোনো মুকুটের জন্য নয়, আমার অস্তিত্ব শুধুই আমার মাতৃভূমির জন্য।”

তখন প্রেক্ষাগৃহ স্তব্ধ হয়ে যায়, দর্শকদের শিরদাঁড়ায় এক শীতল শিহরণ বয়ে যায়।

অন্যদিকে, আওরঙ্গজেবের চরিত্রে অক্ষয় খান্না এক অদ্ভুত শীতলতা ফুটিয়ে তুলেছেন। তার প্রতিটি সংলাপে এক সম্রাটের নির্মম বাস্তবতা ধ্বনিত হয়—যেখানে ক্ষমতার জন্য কোনও আবেগের স্থান নেই, শুধুই কৌশল ও সংকল্পের লড়াই।

রশ্মিকা মন্দান্নার চরিত্র, সম্ভাজির স্ত্রী যশোবতী, শুধুমাত্র এক প্রেমময় স্ত্রীর ভূমিকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং তিনি এক ধৈর্য ও শক্তির প্রতিমূর্তি। তার চোখে প্রেম আছে, কিন্তু সেই প্রেম পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা নয়, বরং সে এক সেনানায়কের স্ত্রী, যে স্বামীকে রণক্ষেত্রে পাঠিয়ে নিজেও এক নীরব যোদ্ধায় পরিণত হয়।

 যুদ্ধের দৃশ্য – আগুনের কাব্য

এই সিনেমার যুদ্ধের দৃশ্যগুলো এক কথায় ভিজ্যুয়াল কবিতা। এখানে শুধুমাত্র তরবারির সংঘর্ষ নেই, আছে মৃত্যুর সঙ্গে সম্মানের দ্বন্দ্ব। ক্যামেরার চলন, স্লো-মোশনের নিখুঁত ব্যবহার, যুদ্ধের শব্দের প্রতিধ্বনি—সব মিলিয়ে দর্শক যেন সময়ের এক কুয়াশাচ্ছন্ন দরজার ওপারে পৌঁছে যায়

যখন সম্ভাজি তার সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখন ধুলো উড়ে যায়, আকাশ কালো হয়ে ওঠে। তলোয়ারের ঝলকানি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে—এক চিরন্তন দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। শত্রুর রক্তধারায় মাটি ভিজে যায়, তবুও সম্ভাজির চাহনিতে কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও পরাজয়ের ইঙ্গিত নেই।

Teaser [OV]

“যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত ঝরে, কিন্তু কিছু আত্মা কখনও পরাজিত হয় না।”

এই সংলাপ শুধু এক বীরের কণ্ঠস্বর নয়, বরং এক শতাব্দীর গর্জন

 আবহসংগীত – সুরের অনল

যে কোনও মহাকাব্যিক চলচ্চিত্রের আত্মা হলো এর সঙ্গীত, এবং এ.আর. রহমান এখানে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

যুদ্ধের দৃশ্যের নিচে বাজতে থাকা ঢোলের গর্জন যেন রক্তের তালে বাজতে থাকা এক সম্রাটের হৃদস্পন্দন। আবার নির্জনতার দৃশ্যে মৃদু বাঁশির সুরে এক নিঃশব্দ আত্মদহন ফুটে ওঠে।

সম্ভাজির শেষ যাত্রার সময়, যখন শুধু বাতাসের শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা এক সঙ্গীতের সুর শোনা যায়, তখন দর্শকদের চোখে এক অশ্রুজল টলমল করে ওঠে।

 দৃশ্যপট – রঙের ভাষায় ইতিহাস

‘ছাঁভা’-র প্রতিটি দৃশ্য একটি চলমান চিত্রকর্ম

  • প্রাসাদগুলোর রাজকীয় সোনালি আলো সম্ভাজির রাজপুত্র জীবনের প্রতীক, যেখানে সম্ভ্রান্ততার ছোঁয়া রয়েছে।
  • যুদ্ধক্ষেত্রের ধুলো আর আগুনে মোড়া সন্ধ্যার আলো যুদ্ধের নিষ্ঠুরতাকে তুলে ধরে, যেখানে শক্তি ও আত্মত্যাগ একসঙ্গে মিশে যায়।
  • রাত্রির নীলচে আলোয় সম্ভাজির একাকীত্ব ফুটিয়ে তোলে, যেখানে এক যোদ্ধার অন্তরের দোলাচল প্রকাশ পায়।

এ যেন সময়ের ক্যানভাসে রঙের ছোঁয়ায় আঁকা এক মহাকাব্য

Chhaava film review: A brutally violent version of Maratha history

 চূড়ান্ত রায় – এক চিরন্তন সৃষ্টি

‘ছাঁভা’ কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি এক অনুভূতির বিস্ফোরণ। প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি যুদ্ধ এক জাতীয় গৌরবের উৎসব

এটি এমন এক গল্প, যা শুধু দেখার জন্য নয়, বরং আত্মস্থ করার জন্য। একবার দেখলে মনে হবে, আমরা সময়ের সাক্ষী হয়ে গেছি, ইতিহাসের গতি আমাদের চোখের সামনে পরিবর্তিত হচ্ছে।

এই সিনেমা শুধুমাত্র এক ইতিহাস নয়, এটি এক অগ্নিস্নান, এক আত্মবিশ্বাসের পুনর্জন্ম, এক অমর যোদ্ধার মহাকাব্যিক চিৎকার!

চূড়ান্ত মূল্যায়ন – এক মহাকাব্যের পুনর্জন্ম

‘ছাঁভা’ শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক আবেগের বিস্ফোরণ। পরিচালক লক্ষ্মণ উতেকরের দক্ষ নির্মাণশৈলী, শক্তিশালী চিত্রনাট্য, এবং নায়ক ভিকি কৌশলের অনবদ্য অভিনয়—সব মিলিয়ে এই সিনেমাকে এক মহাকাব্যিক অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে। যুদ্ধের দৃশ্যের মহিমা, সংলাপের দৃঢ়তা, সংগীতের গভীরতা—প্রতিটি উপাদান একে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায় করে তুলেছে।

যারা ইতিহাস, বীরত্ব, এবং আবেগের সংমিশ্রণে নির্মিত দুর্দান্ত সিনেমা ভালোবাসেন, তাদের জন্য ‘ছাঁভা’ অবশ্যই এক আবশ্যক দর্শনীয় চলচ্চিত্র। এটি কেবল অতীতকে নয়, দর্শকের চেতনার গভীরে দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে।

আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ! ❤️আমরা সবসময় চেষ্টা করি আপনাদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ, আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট তৈরি করতে, যাতে আপনি নতুন কিছু জানতে শিখতে পারেন। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে বা আমাদের সঙ্গে আপনার মতামত শেয়ার করতে চান, তাহলে “যোগাযোগ করুনফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলুন। আমরা আগ্রহের সঙ্গে আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত এবং আপনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করি। এছাড়াও, ভবিষ্যতের আপডেট, নতুন নিবন্ধ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস না করতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুনএকসঙ্গে জানবো, শিখবো, আর নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দেখবো

Leave a Reply